২০ বছর পর হার! অর্জুনের দুর্বলতাকে কীভাবে কাজে লাগালেন পার্থ ভৌমিক?
Arjun Singh Barrackpore Lok Sabha: অর্জুন সিং ২০০১ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক। আর পার্থ ভৌমিক বিধায়ক হন রাজ্যে পালাবদলের বছর ২০১১ সালে।
দু'দশক পরে পরাজিত। মাঝের দু'দশকে ঘটে গেছে অনেক কিছুই। সিপিএম শূন্য হয়েছে। মেসি বিশ্বকাপ জিতেছে। কিন্তু কোনও কিছুই পারেনি, তাঁর নামের সঙ্গে 'অপরাজিত' ট্যাগ মুছতে। শেষবার যখন হেরেছিলেন, তখনও মোবাইল ইন্টারনেট কী জিনিস, তা জানেই না গোটা বিশ্ব। গঙ্গাপাড়ের চটকলিয়া মজদুর এলাকায় তখনও বেশ কিছু জুটমিল চালু ছিল। জুটমিলের সাইরেনে ঘুম ভাঙত মজদুর লাইনের। সেটা ২০০৪। সিপিএমের তড়িৎ বরণ তোপদারের কাছে লোকসভা নির্বাচনে শেষবার হেরেছিলেন অর্জুন সিং। তারপর হেন কোনও ভোট নেই যা তিনি জেতেননি। পৌরসভা, বিধানসভা, লোকসভা সব ভোটে বাজিমাত করেছেন। হয়েছেন কাউন্সিলর, পৌরপ্রধান, বিধায়ক, সাংসদ।
সেই তিনিই হারলেন, হার মানতে বাধ্যই হলেন। ফলাফল অনুযায়ী, হাড্ডাহাড্ডি লড়াইও বলা যায় না, একপেশে লড়াইয়ে ব্যারাকপুরের মানুষ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করল। হারের ব্যবধান ৬৪ হাজার পেরিয়ে গেছে। আগেরবার তিনি জিতেছিলেন মাত্র ১৪ হাজারের সামান্য বেশি কিছু ভোটে আর এবারে হারলেন তার প্রায় ৫ গুণ ভোটে! কে হারালেন তাঁকে? একদা তাঁরই রাজনৈতিক সতীর্থ পার্থ ভৌমিক। প্রথমবার লোকসভা নির্বাচনের ময়দানে নেমেই বাজিমাত পার্থর। ব্যারাকপুরের বাহুবলী সাংসদকে নিয়ে যখন একশ্রেণির সংবাদমাধ্যম ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করেছে, পার্থ তখনও ঠান্ডা মাথায় নিজের কাজটা করে গেছেন। ব্যারাকপুরের ফল দেখে অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরই চক্ষু চড়কগাছ। অনেকেই ভেবেছিলেন ব্যারাকপুর আর অর্জুন সমার্থক হয়ে যাওয়া শিল্পাঞ্চলে বাহুবলী বিদায়ী সাংসদ কিছুতেই হারবেন না। ঠিক কোন কৌশলে বাজিমাত করলেন পার্থ ভৌমিক?
ব্যারাকপুরের রাজনীতিকে যারা কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরা জানেন একই দলে থাকলেও পাশাপাশি দুই শহরের দুই বিধায়কের সুসম্পর্ক কোনওদিনই ছিল না। অর্জুন সিং ২০০১ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক। আর পার্থ ভৌমিক বিধায়ক হন রাজ্যে পালাবদলের বছর ২০১১ সালে। অভিজ্ঞতার নিরিখে অর্জুন এগিয়ে থাকলেও সাংগঠনিক দক্ষতা, মঞ্চে-সভায় বাগ্মীতা পার্থ ভৌমিকের দ্রুত উত্থান ঘটায়। দু'জনের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই ছিলই কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে চলে আসে ২০১৯ সালে। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস ফের একবার দীনেশ ত্রিবেদীকে প্রার্থী করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্জুন সিংয়ের অনুগামীরা সরাসরি অভিযোগ তোলেন, পার্থ ভৌমিকের কারসাজিতেই অর্জুন সিংয়ের পরিবর্তে তৃণমূল সুপ্রিমো প্রার্থী করেন দীনেশকে। এরপরেই নাটকীয়ভাবে অর্জুনের বিজেপিতে যোগদান এবং মাত্র ৪০ দিনের মধ্যে লোকসভার মনোনয়ন পাওয়া এবং জিতে যাওয়া। এই গোটা প্রক্রিয়াটা নিয়ে অর্জুন সিং এবং তাঁর অনুগামীদের গলায় শ্লাঘা ঝরে পড়েছে বারবার। 'ভাইয়াজি' চাইলে সব সম্ভব এমন একটা 'ইমেজ' ব্যারাকপুর জুড়ে চালু হয়। আর পাল্লা দিয়ে শুরু হয় সন্ত্রাস।
আরও পড়ুন- মোদি ম্যাজিক শেষ! বারাণসীতে কেন এত কম ভোট পেলেন মোদি?
গত লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয় ২০১৯ সালের ২৩ মে। সেই রাত থেকে পরের ১৫ দিন ভয়াবহ সন্ত্রাস শুরু হয় শিল্পাঞ্চল জুড়ে। ভাটপাড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। নৈহাটি পৌরসভায় হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। পৌরসভার কর্মীদের মারধর, মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ ওঠে অর্জুন সিং আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে, নৈহাটিতে ছুটে আসতে হয় স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে। নৈহাটি পৌরসভার গেটে দাঁড়িয়ে কর্মীদের আশ্বাস দিতে হয় তাঁকে। সেদিন নিজে হাতে কয়েকটি দলীয় কার্যালয়ও উদ্ধার করে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে সেদিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলেন নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক। ৫ বছর বাদে সেই পার্থ ভৌমিকই ব্যারাকপুরের সাংসদ নির্বাচিত হলেন। আর অর্জুন সিংয়ের গোটা রাজনৈতিক কেরিয়ারকেই ছুঁড়ে দিলেন চ্যালেঞ্জের মুখে!
বস্তুত, ২০১৯-এর সন্ত্রাসের দিনগুলোর পর থেকেই ব্যারাকপুরের হাওয়া ঘুরতে শুরু করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব দিয়ে যাওয়ার পর পরই বীজপুরে সুবোধ অধিকারীকে বিজেপি থেকে এনে এবং জগদ্দলে সোমনাথ শ্যামকে (যিনি তখন সদ্য কংগ্রেস ছেড়ে এসেছিলেন) এনে পালটা প্রতিরোধ শুরু করেন পার্থ ভৌমিক। উল্লেখ্য, এই দু'জনের সঙ্গেই তৃণমূলে থাকার সময় থেকে অর্জুন সিংয়ের সাপে নেউলে সম্পর্ক! সন্ত্রাস কবলিত ব্যারাকপুর আস্তে আস্তে ফের স্বাভাবিক হতে শুরু করে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে ৭টি বিধানসভার মধ্যে ৬টি-তে ঘাসফুল ফুটিয়ে নেত্রীর আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেন পার্থ ভৌমিক। আর ঠিক এর দশ মাসের মধ্যেই অর্জুনের ঘরওয়াপসি!
একুশের নির্বাচনে স্বঘোষিত 'বাহুবলী' নিজের লোকসভা ক্ষেত্রে নিজের ছেলেকে ছাড়া আর কাউকে জেতাতে পারেননি। তার সঙ্গে রাজ্য সরকারের তরফে একের পর এক মামলায় জর্জরিত অর্জুন সিং খানিকটা বাধ্য হয়েই ফিরেছিলেন তৃণমূলে। হয়তো ভেবেছিলেন, আগের মতোই কর্মীদের থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পাবেন। কিন্তু, ২০১৯-এর সন্ত্রাস ব্যারাকপুরের তৃণমূল কর্মীরা ভুলতে পারেননি। স্বাভাবিকভাবেই অর্জুন সিংও আর কর্মীদের মনে সেই স্থান ফিরে পাননি। আর ততদিনে সোমনাথ শ্যাম, রাজ চক্রবর্তী, সুবোধ অধিকারীরা নতুন বিধায়ক হয়েছেন। তাদের ঘিরে অনুগামীদের নতুন নতুন বৃত্ত নির্মিত হয়েছে। রাজনীতিতে শূন্যস্থান বলে কিছু হয় না। পোড়খাওয়া রাজনীতিক অর্জুন এই ভুলটাই করলেন। প্রায় ২ বছর তৃণমূলে থাকলেও আগের সেই সমাদর আর পাননি অর্জুন সিং। প্রশাসন থেকে পাড়ার ক্লাব কোনও কিছুই আর নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। বীজপুর, নৈহাটি, নোয়াপাড়া, জগদ্দল, এমনকী তাঁর নিজের এলাকা ভাটপাড়ার দলীয় অনুষ্ঠানেও তাঁকে ব্রাত্য রাখার বা না ডাকার অঘোষিত নিয়ম চালু ছিল তৃণমূলের অন্দরে। শুধু ব্যারাকপুর এবং আমডাঙার কিছু নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে তিনি টুকটাক এই দুই বিধানসভার নানা কর্মসূচিতে যেতেন। তারপরেও ২০২৩-এর শেষের দিক থেকে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন লোকসভার প্রার্থীপদ পাওয়ার জন্য৷
আর ঠিক তখনই জগদ্দলের তৃণমূল বিধায়ক সোমনাথ শ্যাম নিয়ম করে আক্রমণ শুরু করেন অর্জুন সিংকে। দলের বিধায়ক প্রকাশ্যে সংবাদমাধ্যমে আক্রমণ করছে দলেরই সাংসদকে এমন দৃশ্য দেখে বহু রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ভ্রূ কুঁচকালেও ব্যারাকপুরের রাজনীতির হালহকিকত যারা জানেন, তারা জানতেন এটাই স্বাভাবিক। তৃণমূল রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী ছুটে আসেন দু'তরফের সমঝোতা করানোর জন্য কিন্তু দলের রাজ্য সভাপতিকেই ঘণ্টা তিনেক বসিয়ে রেখে দিয়েও সেই বৈঠকে আসেননি সোমনাথ শ্যাম। বিফল মনোরথ হয়ে চলে যেতে হয় সুব্রত বক্সীকে, সঙ্গে অর্জুনকেও। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই ভিকি যাদব নামের এক তৃণমূল কর্মীর খুনের ঘটনায় গ্রেফতার হন পাপ্পু সিং। পাপ্পু সিং অর্জুন সিংয়ের ভ্রাতুষ্পুত্র। ব্যারাকপুরের মাটিতে কান পাতলেই শোনা যায়, অর্জুন সিংয়ের হয়ে ভোট 'করানো' সহ উত্তরপ্রদেশ-বিহার থেকে বাহুবলী নিয়ে আসা, বন্দুক-গুলি-বোমের বন্দোবস্ত সহ যাবতীয় অনৈতিক কাজ নাকি পাপ্পুই করতেন! সেই পাপ্পুকেই ভিকি যাদবের খুনের মামলায় গ্রেফতার করিয়ে অর্জুন সিংকে প্রথম 'ঝটকা' দিয়েছিলেন সোমনাথ শ্যাম- সুবোধ অধিকারীরা। লোকসভা ভোটের দিন যত এগিয়েছে তত গোটা ব্যারাকপুর জুড়ে বিভিন্ন দলীয় সভায় অর্জুন সিংকে একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ করে গেছেন দুই বিধায়ক, সুবোধ এবং সোমনাথ। যাঁদের দু'জনেরই নেতা বা 'মেন্টর' পার্থ ভৌমিক। পার্থ ভৌমিক যদিও এই গোটা প্রক্রিয়ায় একবারও সামনে আসেননি। নিজে নীরব থেকেছেন। যা বলার শুধু সোমনাথ আর সুবোধই বলে গেছেন৷ পালটা ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন অর্জুন সিংও! অর্জুন সিং এবং তাঁর অনুগামীদের তখনও বিশ্বাস ছিল, তৃণমূল তাঁকেই লোকসভার মনোনয়ন দেবে এবং ব্যারাকপুর থেকেই দেবে! কানাঘুষো শোনা যায়, সেই সময় নাকি তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁকে আসানসোল বা হুগলির মতো অন্য কোনও আসনে লড়তে বলেন কিন্তু অর্জুন জেদে অটুট। তিনি লড়লে ব্যারাকপুর থেকেই লড়বেন।
আরও পড়ুন- সিপিএমের ছায়াতেই বেড়েছে অর্জুনের শক্তি! কেন হারলেন ব্যারাকপুরের বাহুবলী?
১০ মার্চ ২০২৪। ব্রিগ্রেড সমাবেশের মঞ্চে সকাল সকাল পৌঁছে যান অর্জুন সিং। ট্রেডমার্ক, সাদা জামা সাদা প্যান্ট। চোখে বিদেশি রোদ চশমা। সুন্দর করে ছাঁটা রাজপুতদের অলংকার 'গোঁফ'। বয়স ষাটের বেশি হলেও চুল যেভাবেই হোক এখনও কুচকুচে কালো। ভাটপাড়া জগদ্দলে সেদিন অর্জুন অনুগামীরা মিষ্টি বিলি শুরু করেন। ভাইয়াজি টিকিট পাচ্ছেনই কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন পার্থ ভৌমিকের নাম। নিমেষে বদলে গেল চিত্র। ঠিক সেই মুহূর্তে অর্জুন সিংয়ের মুখ দেখা যায় টিভির পর্দায়। থমথমে মুখ, সাদা গাল যেন লাল হয়ে গেছে দুঃখে, কষ্টে, রাগে, অভিমানে। সেদিনই দুপুরে সাংবাদিক সম্মেলন করে হিন্দি আর বাংলা মেশানো তাঁর 'সিগনেচার' বাচনভঙ্গিতে বলেন, "তৃণমূল আমাকে ঠকালো! আমাকে আমার ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে!” ব্যারাকপুর বুঝে গেছিল আবার দল পাল্টানোর জন্য তৈরি হচ্ছেন ভাইয়াজি। অর্জুন সিংয়ের বাসভবন 'মজদুর ভবনে'র দেওয়ালে রাতারাতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি বদলে চলে এল নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অর্জুন সিংয়ের ছবি৷ আবার সেই চেনা আত্মবিশ্বাস! সাদা জামা-সাদা প্যান্ট, সাদা ব্রান্ডেড ঘড়ি, সাদা ফরচুনার এবং আবার বিজেপিতে যোগ দিয়েই টিকিট পেয়ে যাওয়া!
রাজ্য বিজেপি মহিলা মোর্চার সভানেত্রী ফাল্গুনী পাত্রের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ সেদিন অনেক পুরনো বিজেপি কর্মীদের কানেই গেছিল, যারা ২০২১-এ দলের অমন বিপর্যয়ের পরেও বিজেপিতে থেকে গেছিলেন। কিন্তু ভাইয়াজির অনুগামীদের উল্লাসে সেই সমস্ত বিজেপি কর্মীদের কথা শোনেনি কেউ! তৃণমূলে ব্রাত্য কিছু নেতাও যোগ দিলেন বিজেপিতে। যেন ২০১৯-এর 'অ্যাকশন রিপ্লে' চলছে!
কিন্তু অর্জুন সিং ভুলে গেছিলেন মণীশ শুক্লার কোনও বিকল্প আজও ব্যারাকপুর লোকসভায় নেই। মণীশ খুন হন ২০২১-এর নির্বাচনের কয়েক মাস আগে। তাঁর বিকল্প মুখ বিজেপি বা তৃণমূল কেউই পায়নি। শিল্পাঞ্চলের রাজনীতিতে বিশেষত, হিন্দিভাষী এলাকায় মণীশ শুক্লার একটা প্রশ্নাতীত জনসমর্থন ছিল। এছাড়া অর্জুন সিংয়ের যে ভোট মেশিনারি, যার জোরে তিনি এত বছর একটার পর একটা নির্বাচনে জিতে এসেছেন সেই ভোট মেশিনারিই তো ভেঙে দিয়েছিলেন পার্থ ভৌমিক। মণীশ মৃত। নিজের ভাইপো পাপ্পু সিং জেলে। আরেক ভাইপো তথা ভাটপাড়া পৌরসভার প্রাক্তন পৌর প্রধান সৌরভ সিং তৃণমূলে। সৌরভ আবার পার্থ ভৌমিকের মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট হয়ে গেলেন। ২০১৯-এ অর্জুন সিংয়ের হয়ে ভোট করানো, এলাকা দাপিয়ে বেড়ানো একাধিক বাহুবলী নয় তৃণমূলে নয় জেলে!
অর্জুন ভেবেছিলেন মানুষ তাঁকে ভোট দেবে কিন্তু ২০১৯-এর সন্ত্রাস অর্জুন সিংয়ের 'রবিনহুড' ইমেজকে একেবারে ধ্বংস করে দেয়। আর পার্থ ভৌমিকও এই নির্বাচনে একটিই ট্যাগলাইন বারবার ব্যবহার করেন, "গুন্ডারাজ নয়। শান্তি চাই।" প্রতিটা বক্তব্যে যত না বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করেছেন পার্থ, তারচেয়েও বেশি একটাই কথা বলেছেন, "ব্যারাকপুরের গুন্ডারাজকে আমি খতম করবই! গুন্ডারাজের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমার পাশে থাকুন!" অর্থাৎ, 'গুন্ডারাজ' এবং 'অর্জুন সিং' সমার্থক, এমন একটা 'ন্যারেটিভ' মানুষের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিলেন পার্থ। নির্বাচনের ফলাফলই বলছে এ কাজে তিনি ১০০% সফল। বাঙালি ভোট একতরফা পেয়েছেন পার্থ। আমডাঙার সংখ্যালঘু ভোট প্রত্যাশিতভাবেই গেছে তৃণমূলের ইভিএমে। একইসঙ্গে ভাটপাড়া জগদ্দলের হিন্দিভাষীদের খানিকটা ভোটও অর্জুনের থেকে কেটে নিতে সফল হয়েছেন। এই গুন্ডারাজ এবং অর্জুন সিংয়ের নিজেই নিজেকে 'বাহুবলী' দেখাতে চাওয়া আদতে তাঁর বিপক্ষে গেছে।
আরও পড়ুন- মাত্র ৯ টি আসন পেত বিজেপি! যে সমঝোতা হলে বাংলাছাড়া হতো গেরুয়া দল
আর বিপক্ষে গেছে তাঁর এই বারবার দল বদল! ব্যারাকপুরের দিকে দিকে 'পল্টুরাম' লিখে প্রচার হয়েছে। সেখানে কার্টুনে অর্জুন সিংয়ের ব্যঙ্গচিত্র! একসময়ের কংগ্রেস কাউন্সিলর, সেখান থেকে তৃণমূল, তারপর বিজেপি, আবার তৃণমূল, টিকিট না পেয়ে আবার বিজেপি। এসব তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতাকেই ধ্বংস করে দিয়েছে। ব্যারাকপুরের চালু রসিকতা, অর্জুন সিং কখন কোন দলে থাকবেন, সেটা তাঁর বাড়ির লোকজনও জানেন না। গত লোকসভায় টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে যাওয়ায় যে সহানুভূতির ভোট তিনি পেয়েছিলেন, এবার সেই সহানুভূতি তিনি পাননি। কারণ, এবার তিনি স্বেচ্ছায় তৃণমূলে এসেছিলেন। টিকিট না পেয়েই বিজেপিতে চলে যাওয়ায় এবার সহানুভূতির পরিবর্তে লোকজন তাকে 'পদলোভী' হিসেবে দেখেছে। মূলত এই দু'টি কারণ, অর্জুন সিংয়ের বিপক্ষে গেছে। যে ভাটপাড়ায় গত লোকসভায় প্রায় ২৮ হাজারের লিড পেয়েছিলেন সেই ভাটপাড়াতেও তাঁর লিড এসে নেমেছে মাত্র সাড়ে ১৭ হাজারে! এই একটি বিধানসভাতেই তিনি লিড পেয়েছেন বাকি সবগুলোতেই হেরেছেন।
ভোটের দিন হোক বা গণনার দিন, বারবার মেজাজ হারিয়েছেন। নিজের ছেলের চেয়েও ছোট বিপক্ষ দলের কর্মীকে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। প্রকাশ্যে খুনের হুমকি দিয়েছেন, গণনা কেন্দ্রের মধ্যেই বিপক্ষ দলের কাউন্টিং এজেন্টের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়েছেন। বাহুবলী নেতা বুঝতে পারছিলেন, তাঁর রাজনৈতিক জীবন এক গভীর খাদের সামনে দাঁড়িয়ে। ইস্টবেঙ্গলের অন্ধ সমর্থক পার্থ ভৌমিক হালকা ডজ করে তাঁর তেকাঠিতে বল জড়িয়ে দিয়েছেন৷ তিনি দেখতে পাচ্ছেন রেফারি শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছে, তাঁর আর কিচ্ছু করার নেই। তিনি এবার 'পরাজিত'! দীর্ঘ ২০ বছর বাদে হারের স্বাদ ফের একবার পেলেন অর্জুন সিং।
হারের স্বাদ খানিক তেতো, অস্বস্তিজনক। এই গভীর খাদ থেকে কি ফের একবার উঠতে পারবেন অর্জুন সিং? এই হারের পরে বিজেপি যে তাঁকে আর আগের মতো সমাদর করবে না, আর তৃণমূলের দরজাও যে তাঁর জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে তা খুব ভালো করে জানেন ষাট বছরের এই প্রবীণ রাজনীতিক। অর্জুন সিং প্রায়ই নিজের বাড়িতে বসে সকালবেলা সাংবাদিক সম্মেলন করেন জার্মানির ফুটবল জার্সি পরে! অর্জুন সিং জার্মানির সমর্থক নাকি কোনও ভক্ত জার্সি উপহার দিয়েছেন, জানা যায় না। জার্মানির ফুটবল দলকে জার্মানরা বলেন "ডাই মানচফাট্', যার চলতি অর্থ করলে দাঁড়ায় 'দ্য টিম' বা 'দল'। বারবার দলবদলু অর্জুন সিং কি পারবেন জার্মান ফুটবল দলের ইস্পাত কঠিন মানসিকতা নিয়ে ফিরে আসতে? নাকি পার্থ ভৌমিকের ঠান্ডা মাথার কাছেই শেষ হয়ে গেল ষাটোর্ধ্ব রাজপুত রাজনীতিকের রাজনৈতিক জীবন?