জ্যান্ত বিড়াল হল টেলিফোন, ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম পরীক্ষার জন্য বিখ্যাত যে দুই বিজ্ঞানী
Cat Telephone: ১৯২৯ সালের কথা সেটা। আর্নেস্ট গ্লেন ওয়েভার ও তাঁর সহকারী চার্লস উইলিয়াম ব্রে একবার একটা উদ্ভট গবেষণায় মাতলেন।
ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল। তাই বলে ছিল বিড়াল, হয়ে গেল আস্ত একটা টেলিফোন! গল্প নয়, এমন ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল। বিজ্ঞানের নামে এমন অনেক কাণ্ডই পৃথিবীতে ঘটে, ঘটে এসেছে, যার কোনও ব্যাখ্যা মানবতার কাছে নেই। যেমন ধরুন, এই যে পরমাণু বোমা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এত এত গবেষণার ফলে একটা ভয়াবহ অস্ত্র তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা, যা মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিল দু-দু'টো শহর, প্রাণ কেড়ে নিল এত এত মানুষের! ইতিহাসের কাছে চিহ্নিত হয়ে রইলেন ওপেনহাইমারের মতো বিরাট বিজ্ঞানী। আদৌ কি এসবে মানুষের একচুলও ভালো হল! বিজ্ঞানীরা প্রগলভ হয়ে এমন অনেক জিনিসই বানিয়ে ফেলেন, যার যুক্তি মানবতা, মানবিকতার কাছে পাওয়া কঠিন। ঠিক তেমনই ছিল ১৯২৯ সালে বিড়ালের উপর করা মানুষের এই পরীক্ষা। যেখানে একটি জীবন্ত বিড়ালকে বানিয়ে ফেলা হয়েছিল আস্ত একটি টেলিফোন।
আরও পড়ুন: আঘাত পেলে গাছেরাও ‘চিৎকার’ করে ওঠে মানুষের মতোই! মাইক লাগিয়ে শুনলেন বিজ্ঞানীরা
হ্যাঁ, বহুসময়েই এমন নৃশংসতা দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানের নেশায় ভুলেছেন মানবতার পাঠ। বিড়াল বরাবরই মানুষঘেঁষা প্রাণী। মানুষের পায়ে পায়ে ঘুরতে তারা ভালোবাসে, আহ্লাদ পেতে ভালোবাসে। পোষ্য হিসেবে তাই জনপ্রিয়তম প্রাণী এই বিড়াল। তবে একটা সময় এমন ছিল, বিড়ালের সঙ্গে কালোজাদু, 'উইচক্রাফ্ট'-র মতো বিষয়গুলি এক করে দেখা হত। যে কারণে নির্বিচারে হত্যাও করা হয়েছে অসংখ্য বিড়াল। এখনও কালো বিড়ালকে ঘিরে কুসংস্কার কমেনি একচুলও। এখনও রাস্তায় বিড়াল পারাপার করলে দাঁড়িয়ে পড়েন, দশবার কপালে হাত ঠেকান, এমন মানুষ ঝুড়ি ঝুড়ি দেখতে পাওয়া যায়। ফলে বিড়ালকে যেমন পোষ্য হিসেবে কোলে তুলে নেয় মানুষ, তেমনই 'ডাইনি' ভেবে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার লোকও কম নেই এ পৃথিবীতে। তবে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই অধ্যাপক কোন ধারায় পড়তেন বলা কঠিন।
১৯২৯ সালের কথা সেটা। আর্নেস্ট গ্লেন ওয়েভার ও তাঁর সহকারী চার্লস উইলিয়াম ব্রে একবার একটা উদ্ভট গবেষণায় মাতলেন। যা শুনলে কার্যত চমকে উঠবেন পশুপ্রেমীমহল। তাঁদের নতুন গবেষণার জন্য তাঁরা খুঁজে আনলেন একটি হৃষ্টপুষ্ট বিড়াল। ঘুমের ওষুধ দিয়ে প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন করা হল সেটিকে। তবে তার প্রতিটি স্নায়ু রইল সজাগ। আর সেই বিড়ালটিকে পরিণত করা হল একটি চলমান টেলিফোনে।
হ্যাঁ, শিউরে ওঠার মতোই ঘটনা বটে। বিড়ালটির অডিটোরি স্নায়ুর উপর বিস্তর গবেষণা করলেন তাঁরা। এরপর অস্ত্রোপচার করে বিড়ালটির করোটিটি খুলে ফেললেন। যাতে আরও ভালো ভাবে বিড়ালটির অডিটরি স্নায়ুর কাছে পৌঁছতে পারেন । এরপর ওই স্নায়ুর সঙ্গে জুড়ে দিলেন টেলিফোন তারের একটি অংশ। অন্য অংশটি জোড়া রইল রিসিভারের সঙ্গে।
এই পরীক্ষার যা ফলাফল মিলল, তাতে চমকে উঠলেন দুই বিজ্ঞানী। বিড়ালের কানে কথা বললেন বিজ্ঞানী ব্রে। পঞ্চাশ মিটার দূরে একটি শব্দনিরুদ্ধ ঘরে বসে রিসিভারের মাধ্যমে ওই কথা স্পষ্ট শুনতে পেলেন ওয়েভারের। আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠলেন দুই বিজ্ঞানী। বিড়ালটি একেবারে টেলিফোনের ট্রান্সমিটেড প্রান্তের মতো কাজ করছিল।
সেই সময়ে একটি প্রচলিত তত্ত্ব ছিল, শব্দ যত চড়া হয়, তার কম্পাঙ্ক তত উচ্চতর হয়। আর এই পরীক্ষা যেন সেই তত্ত্ব একেবারে হাতেকলমে প্রমাণ করে দিল। অডিটরি নার্ভ বা শ্রবণ স্নায়ু যে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত তা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছিলেন এই বিজ্ঞানীযুগল। পরে এই গবেষণা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর প্রভুত কাজে এসেছিল। এই দুই বিজ্ঞানীই বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সাইকোলজিক্যাল সায়েন্টিস্ট হিসেবে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল ও নৌবাহিনীকে সাহায্য করেন ব্রে। অন্যদিকে, নৌবাহিনী ও অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার বিভাগে পরামর্শদাতা হিসেবে যোগ দেন ওয়েভার। শুধু যুদ্ধের ক্ষেত্রেই নয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বড় সাহায্য় করেছিল এই গবেষণা।
আরও পড়ুন: ডিম্বাণু আর শুক্রাণু ছাড়াই তৈরি হচ্ছে ভ্রূণ! আশ্চর্য আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের
যদিও ওই পরীক্ষা নিয়ে সেসময় বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। ছুটে এসেছিলেন পশু অধিকার আন্দোলন কর্মীরা। অনেকেই ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন বিড়ালের উপর এমন নৃশংস একটি পরীক্ষা চালানোর জন্য। তবে সেই বিতর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ওই কাজের জন্য প্রথম হাওয়ার্ড ক্রসবি ওয়ারেন মেডাল সোসাইটি পুরস্কারও পান ওই দুই বিজ্ঞানী। তবে সেই পুরস্কারের পাশাপাশি নৃশংসতম একটি বিজ্ঞানপরীক্ষার জন্যে ইতিহাসের তিরষ্কার সারাজীবন তাদের জন্য রাখা আছে বোধহয়। আসলে মানুষের মধ্যে একটা চিরহিংসুটে স্বার্থপর দৈত্যসত্তা বাস করে বোধহয়। যা পৃথিবীকে নিজের প্রয়োজনে নিজের মতো করে গড়েপিটিয়ে নিতে চায়। তার জন্য গাছ কেটে ফেলে, পশুহত্যা করে, কখনও কখনও নগর ধ্বংস করে দেয়। পরমাণু বোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু বানিয়ে তুলতে দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। ভুলে যায়, পৃথিবীটা পাখি, গাছ, মানুষ- সকলের। সেই সত্তার ভয়াবহ রূপের কাছে খেলনা হয়ে ওঠে বিজ্ঞান। আর মানুষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করে সর্বময়ের কর্তা। আর এই পরীক্ষা বোধহয় মানুষের সেই উলঙ্গ রূপকেই প্রমাণ করে দিয়েছিল আরও একবার।