ডিম্বাণু আর শুক্রাণু ছাড়াই তৈরি হচ্ছে ভ্রূণ! আশ্চর্য আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের

গবেষকরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছাড়াই, কেবল স্টেম সেল থেকে তৈরি করলেন সম্পূর্ণ একটি ভ্রূণ।

একটি ভ্রূণ তৈরি হতে সবার প্রথমে প্রয়োজন একটি ডিম্বাণু এবং একটি শুক্রাণুর নিষেক হওয়া। এমনকী, ভ্রূণ নিয়ে গবেষণার সময়েও ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর নিষেককেই ভ্রূণ গঠনের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এবারে 'ওয়াইজ়মেন ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স'-এর গবেষকরা ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ছাড়াই, কেবল স্টেম সেল থেকে তৈরি করলেন সম্পূর্ণ একটি ভ্রূণ। তা-ও আবার প্রাণীদেহের বাইরে গড়ে তোলা হলো সেই ভ্রূণ। চলতি মাসেই সেই গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে 'সেল' নামের এক বৈজ্ঞানিক প্রতিবেদনে।

এই গবেষণাটি করা হয়েছে ইঁদুরের ভ্রূণ নিয়ে। ইঁদুরের এই ভ্রূণটি সাড়ে আট দিন অবধি কেবল ইঁদুরের শরীরের বাইরে বেড়েই ওঠেনি, তার পাশাপাশি একাধিক অঙ্গের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়গুলিও সম্পূর্ণ হয়েছে ভ্রূণটির মধ্যে। দেখা যাচ্ছে, ভ্রূণটিতে বেড়ে উঠেছে একটি হৃদযন্ত্র, যার স্পন্দন শুরু হয়ে গেছে ততক্ষণে। পাশাপাশি শুরু হয়েছে রক্তের স্টেম সেলের প্রবাহ; গড়ে উঠেছে একটি ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক, যার মধ্যে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের মতো ভাঁজও দেখা যাচ্ছে।

এই ঘটনা বিশ্বে প্রথম তো বটেই। কিন্তু তার পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্টেম সেল থেকে তৈরি হওয়া একটি ভ্রূণ যখন বাড়তে থাকে, সেই বাড়ন্ত ভ্রূণে স্টেম সেল থেকে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গড়ে ওঠে কীভাবে, তা এই গবেষণার ফলে ভবিষ্যতে আরও স্পষ্ট হবে গবেষকদের কাছে।

আরও পড়ুন: সন্তানধারণে অক্ষম, অন্য নারীর গর্ভের সাহায্য নিতে যে নিয়মগুলি মানতেই হবে

হয়তো ভবিষ্যতে কখনও অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সময় যখন সুস্থ অঙ্গের প্রয়োজন হবে, তখন হয়তো স্টেম সেল থেকে তৈরি কৃত্রিম ভ্রূণের মডেল থেকেই পাওয়া যাবে একটি সম্পূর্ণ এবং কর্মক্ষম অঙ্গ। হয়তো তখন আমাদেরকে অঙ্গদাতাদের ওপর ভরসা করতে হবে না, বা দাতার অঙ্গ রোগীর অঙ্গের পক্ষে উপযুক্ত কি না, সেই চিন্তাও করতে হবে না।

মলিকিউলার জেনেটিক্স বিভাগের গবেষক এবং অধ্যাপক জ্যাকব হ্যানার তত্ত্বাবধানে এই গবেষণাটি করা হয়েছে। ওয়াইজ়মেন ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের একটি প্রেসে রিলিজে অধ্যাপক হ্যানা জানিয়েছেন, "একটি ভ্রূণ আদতে অঙ্গ তৈরি করার জন্য উপযুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র। এবং এটি উৎকৃষ্ট একটি ত্রিমাত্রিক জৈব-মুদ্রণ যন্ত্র (ত্রি-ডি বায়োপ্রিন্টার)। একটি ভ্রূণ যা যা করতে সক্ষম, আমরা তা নকল করার চেষ্টা করেছি মাত্র।"


দেহের বাইরে ভ্রূণ যাতে বেড়ে উঠতে পারে, তার জন্য প্রফেসর হ্যানার তত্ত্বাবধানে ইতিমধ্যেই তাঁর ল্যাবের গবেষকরা টানা সাত বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর একটি বিদ্যুতচালিত যন্ত্র নির্মাণ করেছেন।

সেই গবেষণা ২০২১ সালের মার্চ মাসে 'নেচার'-এ প্রকাশিত হয়েছিল। সাম্প্রতিক এই গবেষণায় যখন স্টেম সেল থেকে ভ্রূণের মডেল তৈরি করছিলেন তাঁরা, তখন আবার ব্যবহার করা হয় সেই যন্ত্র। এই বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মূল কাজ হল বাড়ন্ত ভ্রূণটিকে পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ তরল মাধ্যমে নিমজ্জিত রাখা; ঠিক যেভাবে দেহের মধ্যে রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আমাদের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেইরকম।

তবে এই যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করার আগে স্টেম সেলগুলি দীর্ঘদিন ধরে বেড়ে উঠছিলো কাঁচের তৈরি পেট্রি ডিশে। এই স্টেম সেলগুলিকে 'নাইভ স্টেম সেল' বলা হয়। আর ঠিক এই পর্যায়ে থাকাকালীন স্টেম সেলগুলির বিভিন্ন ধরনের কোশে (যেমন রক্ত কোশ, হৃদযন্ত্রের কোশ, নার্ভ কোশ, প্রভৃতি) পরিণত হওয়ার ক্ষমতা থাকে।

এই স্টেম সেলগুলিকে সেই বৈদ্যুতিন যন্ত্রে স্থানান্তরিত করার আগে, কোশগুলিকে তিনটি দলে ভাগ করা হয়। প্রথম দলে যে কোশগুলিকে রাখা হয়, এম্ব্রায়োনিক অর্গানে পরিণত হওয়াই তাদের পরিণতি ছিল। সেই প্রথম দলের কোশগুলিকে কোনওরকম পরিবর্তিত না করেই তাদের বৈদ্যুতিক যন্ত্রে স্থানান্তর করা হয়। কিন্তু বাকি দুই দলের কোশকে আগে থেকেই জেনেটিকভাবে পরিবর্তন করা হয়েছিল, যাতে দু'টি দলের প্রত্যেকটিতে দু'টি ভিন্ন ভিন্ন জিন নিজেদের কাজ করতে পারে। এদের মধ্যে একটি জিন প্লাসেন্টা বা অমরার কোশ উৎপাদনের জন্য দায়ী; অপরটি ভ্রূণের বাইরে থাকা কুসুম কোশ উৎপাদনের জন্য। এই দুই প্রকার কোশের প্রভাবেই একটি ভ্রূণ একদম অন্তিম পর্যায় অবধি বৃদ্ধি পেতে থাকে।

তারপর ধীরে ধীরে এক-একটি কোশ বিভাজিত হতে হতে একসঙ্গে সংঘবদ্ধ একগুচ্ছ কোশ তৈরি হয়। যদিও সঙ্গবদ্ধ থাকা বেশিরভাগ কোশই মারা যায়। তবু ০.৫ শতাংশ কোশগুচ্ছ ধীরে ধীরে গোলাকার বলের মতো আকার ধারণ করে, এবং বাড়তে বাড়তে এক সময় লম্বাটে আকার ধারণ করে, যারা আবার ঠিক ভ্রূণের মতোই দেখতে।

এদিকে যে দলে প্লাসেন্টা গড়ে ওঠার কথা, এবং যে দলে কুসুম কোশ বা ইয়ক স্যাক গড়ে ওঠার কথা, তা-ও গড়ে ওঠে। সাড়ে আট দিনের মাথায় বিভিন্ন অঙ্গের বেড়ে ওঠার প্রাথমিক পর্যায়গুলিও চোখে পড়ে গবেষকদের।

যখন ডিম্বাণু এবং শুক্রাণূর নিষেকে গড়ে ওঠা ভ্রূণের সঙ্গে, স্টেম সেল থেকে কৃত্রিমভাবে গড়ে ওঠা এই এম্ব্রায়নিক মডেলের তুলনা করেন গবেষকরা, তাঁরা দেখেন, তাদের মধ্যে পঁচানব্বই শতাংশ মিল রয়েছে। প্রফেসর হ্যানা জানাচ্ছেন, "স্টেম সেল কী করে জানে, তারা পরবর্তী ধাপে কী ধরণের কোশে পরিণত হবে? কী করে তারা স‌ংঘবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন ধরনের অঙ্গের রূপ নেয়! আর কীভাবেই বা ভ্রূণের এক-একটি স্থানের স্টেম সেল, নির্দিষ্ট এক-একটি অঙ্গে পরিণত হয়! আমাদের পরবর্তী চ্যালেঞ্জ কিন্তু এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া।"

More Articles