আবর্জনামুক্ত জীবন, পৃথিবীকে বাঁচাতে আপনাকে যে দায়িত্ব এখনই নিতে হবে
শিল্প বিপ্লব ঘটার আগে মানুষের ব্যবহার্য দ্রব্যের পরিমাণ বেশ মার্জিত মাত্রাতেই ছিল। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পরে পণ্যকে বাজারজাত করতে চাইলেন উৎপাদকরা। আবার ক্রেতাদের মধ্যেও তৈরি হল আরও বেশি করে পণ্য কেনার লোভ। হঠাৎ করেই মানুষের জীবন ভরে যেতে থাকে এমন সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসে, যা ক্রমে পরিণত হয় আবর্জনায়। সেইসময় দাঁড়িয়ে একেবারেই বোঝা যায়নি, এই বৃদ্ধি পাওয়া দ্রব্যের ভার টানতে গিয়ে গোটা পৃথিবীকে একদিন হিমশিম খেতে হবে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালে পৃথিবীতে আবর্জনার পরিমাণ ছিল ২.২৪ বিলিয়ন টন এবং বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে যদি এই অনুপাতে আবর্জনা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে ২০৫০ সালে ল্যান্ডফিলের অভাব দেখা দেবে।
আবর্জনায় সমস্যা কোথায়?
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যাবতীয় অবর্জনাগুলি যে জায়গায় স্তুপাকারে সঞ্চিত করা হয়, তাকেই এক কথায় বলা হয় ল্যান্ডফিল। আপনি হয়তো জানলে অবাক হবেন, এই ল্যান্ডফিল পরিবেশ দূষণ, বিশ্ব উষ্ণায়ন বা জলবায়ু পরিবর্তনের মত গুরুতর সমস্যা সৃষ্টিতে হয়ে অন্যতম ভূমিকা পালন করে থাকে। ল্যান্ডফিলে স্তুপাকারে সঞ্চিত আবর্জনা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পচে গিয়ে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন করে, যা পরিবেশের জন্য বিষেশভাবে ক্ষতিকারক। এই মিথেন গ্যাস, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের থেকেও ৮৪ গুণ বেশি সূর্যের তাপ শোষণ করতে সক্ষম। শুধু মিথেন গ্যাসই নয়, ল্যান্ডফিলের আশেপাশে অবস্থান করা অঞ্চলগুলিতেও এর ক্ষতিকারক প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। এই কারণগুলির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যেই প্রায় দশ হাজারেরও বেশি ল্যান্ডফিল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তাহলে উপায় কী?
রিসাইকেল এবং প্রাত্যহিক জীবনে নূন্যতম দ্রব্য ব্যবহার করাই এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় এবং এই চিন্তা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ‘জিরো ওয়েস্ট লাইফস্টাইল’। আশির দশক থেকে এই রিসাইকেলিং-এর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হলেও, ২০০৯ সালে বিএ জনসন নামে এক মহিলার হাত ধরে ‘জিরো ওয়েস্ট’ জীবনযাপনের বিষয়টি সকলের সামনে আসে, ক্রমে তা একটি আন্দোলনের রূপ নেয়। বর্তমানের বিশ্বের বহু মানুষই এই আন্দোলনে এগিয়ে এসেছেন।
প্রাত্যহিক জীবনের সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে আপনিও এই আন্দোলনের একজন অংশীদার হয়ে উঠতে পারেন-
প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা দরকার, ‘জিরো ওয়েস্ট’ জীবনযাপন করার জন্য আলাদা করে নতুন জিনিস কেনার দরকার একেবারেই নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই আন্দোলনের মূল কথা পুরানো জিনিসের পুনর্ব্যবহার করা এবং যতটা সম্ভব কম জিনিস ব্যবহার করা। তাই নতুন জিনিস না কিনে, বাড়িতেই যে জিনিসগুলি রয়েছে তা দিয়েই পথ চলা শুরু করতে হবে। এছাড়াও –
বাড়ি থেকে জলের বোতল নিয়ে যান – জল পান করা আমরা
কোনোভাবেই ত্যাগ করতে পারি না আর করাও উচিত নয়, বিশেষত ভারতে যেখানে বেশিরভাগ সময়ই তাপমাত্রার পারদ উঁচুতেই অবস্থান করে, সেখানে জলের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যে রয়েছে, তা বলার অবকাশ রাখে না। অনেকক্ষেত্রে বাইরে গেলে, আমরা অতি পিপাসার কারণে বাধ্য হয়েই দোকানের প্লাস্টিকে মোড়া জলের বোতল কিনে ফেলি, যা পরিবেশের জন্য এবং আমাদের শরীরের জন্যও সমানভাবে ক্ষতিকর, তাই পরেরবার বাড়ির বাইরে গেলে সঙ্গে নিয়ে যান জলের বোতল।
কেনাকাটার জন্য নিজের ব্যাগই হোক আপনার ভরসা
শহুরে জীবনে এখন অনেকেই সুপার মার্কেট থেকে কেনাকাটা করতে বেশি পছন্দ করেন। খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাবসার খাতিরে তাঁরা আপনাকে অতিরিক্ত কিছু টাকার বিনিময়ে কাগজের ব্যাগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন, বেশিরভাগ
সময়েই কিন্তু সেই কাগজের ব্যাগগুলি আমরা পরে আর ব্যবহার করি না। তাই পরেরবার থেকে নিজের প্রিয় দোকানে গেলে, সঙ্গে অবশ্যই বাড়ি থেকে ব্যাগ নিয়ে যেতে ভুলবেন না যেন।
একবার ব্যবহারের চামচ বর্জন
ব্যস্ত জীবনে আমরা অফিস কিম্বা বাড়ির ছোটখাটো অনুষ্ঠানে অনেকসময়েই রেস্তোরা থেকে খাবার অর্ডার করে থাকি। পরেরবার খাবার অর্ডার করার সময় প্লাস্টিকের চামচ নেওয়া থেকে বিরত থাকুন। অফিসের ব্যগেও একটি চামচ রাখার অভ্যেস করে ফেলা যেতে পারে। এই চামচ যতখানি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, ঠিক ততখানিই আপনার শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।
পকেটে থাকুক রুমাল
আমাদের বাবা-কাকাদের বেলায় টিস্যু পেপার কিম্বা ‘ওয়েট ওয়াইপ্সে’র চল প্রায় ছিল না বললেই চলে। তখন রুমালই ছিল তাঁদের একমাত্র আশা ভরসা। আমাদের ‘জিরো ওয়েস্ট’ জীবনযাপন করতে গেলে কিন্তু এই বিষয়ে খানিকটা পিছিয়ে বাবা-কাকাদের সময় ফিরে যেতে হবে। টিস্যু পেপার কিম্বা ‘ওয়েট ওয়াইপ্স’ এর গন্তব্য কিন্তু সেই ল্যান্ডফিলেই, তাই
এখনই সতর্ক হওয়াই আমাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বিকল্প দ্রব্যের ব্যবহার
আমরা বাড়িতেই এরকম অনেক জিনিস ব্যবহার করে থাকি যা কিছুদিন পর পরেই আমাদের বদলে ফেলতে হয়। যেমন প্রথমেই বলা যায়, টুথব্রাশের কথা। প্লাস্টিকের ব্রাশের বদলে আমরা বাঁশের ব্রাশ ব্যবহার করতে পাড়ি কিম্বা প্লাস্টিকের গামলা, বালতি অথবা স্ট্র-এর বদলে আমরা যদি লোহা কিম্বা স্টিলের জিনিসপত্রের ব্যবহার করি তাহলে জিনিসগুলি যেমন
পরিবেশবন্ধবও হবে, আবার বারবার বদলানোর হাত থেকেও মিলবে মুক্তি।
রান্নাঘরের বর্জ্যদ্রব্য
ব্যবহার – আমরা রান্নার পর এমন অনেক জিনিসই অযত্নে ফেলে দিয়ে থাকি যা আসলে উচ্চমানের জৈব সার প্রস্তুতে সক্ষম। বাড়ির পিছনে ছোট্ট একটা গর্ত করে যদি সেইসব জিনিসগুলিকে ফেলে পচানো যায়, তাহলে যেখান থেকেই আপনার বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা প্রিয় গাছটির উচ্চমানের খাবার তৈরি হয়ে যাবে। এছাড়াও লেবুর খোসা ফ্রিজের মধ্যেকার দুর্গন্ধ কাটানোর কাজে কিম্বা ঘর মোছার কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আবার কমলালেবুর খোসা শুকিয়েও আপনি তৈরি করতে ফেলতে পারেন, রূপচর্চার একটি আদর্শ স্কাবার।
স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে
মেন্সট্রুয়াল কাপ – মহিলাদের ১২ বছর বয়স থেকে প্রায় ৫০ বছর বয়স অবধি ব্যবহৃত প্রতিটি স্যানিটারি ন্যাপকিনই কিন্তু ল্যান্ড ফিল্ড এর একটি উপাদানে পরিণত হয়েছে। এই বিষয়ে আমরা অনেকেই হয়তো সচরাচর কথা বলি না, কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলেই বুঝবেন, পৃথিবীতে ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিনও কিন্তু আবর্জনার এক বৃহত্তর অংশ জুড়ে অবস্থান করছে তাই স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিকল্প হিসাবে মেন্সট্রুয়াল কাপ
ব্যবহারের চেষ্টা করা যেতেই পারে।
সত্যি বলতে, আপনি যদি একদিন ঘুম থেকে উঠে মনে করেন, সেইদিন থেকেই আপনি সম্পূর্ণভাবে ‘জিরো ওয়েস্ট’ জীবনযাপন করবেন – তাহলে তা কখনই সম্ভব হবে না। এই আন্দোলন আসলে এক ধীর গতি সম্পন্ন যাপন প্রণালীর অভ্যেসের অন্যরূপ। তাই হঠকারিতায় নয়, বরং জীবনযাপনে পরিবর্তন আসুক ধীর গতিতেই।