কোনও ধর্মের জন্য আর আলাদা বিধি নয়! অভিন্ন দেওয়ানি বিধির নামে কী চাইছেন মোদি?
Uniform Civil Code: যে দেশে ১৪.২% মুসলমানের বাস, সেখানে ভারতের লোকসভায় নির্বাচিত মুসলমান সাংসদ ৫ শতাংশেরও কম।
এটা হওয়ারই ছিল। আজ নয় কাল। অনেক দিন হয়ে গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোনও বড় ধামাকা করেননি। হয়তো কোভিড মহামারির কারণে থমকে গিয়েছিলেন কিন্তু ধামাকা বিনা এই সরকার বড় ম্যাড়ম্যাড়ে। তাই মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনের আগে বিজেপির বুথ স্তরের কর্মীদের উৎসাহিত করতে গিয়ে মোদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গ তুলেছেন। একই পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম কীভাবে চলে তার উপমা টেনেছেন। ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এটাই তাঁর ধামাকা। সারা দেশে ধর্মের উপর ভিত্তি করে যে যে ব্যক্তিগত আইন রয়েছে তার বিলোপ ঘটিয়ে দেশের সবার জন্য একটিই দেওয়ানি বিধি তৈরি করা হবে। সব সম্প্রদায়ের মানুষকে সেটি মেনে চলতে হবে — দেশের যে কোনও আইনের মতো।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং বিজেপির এজেন্ডায় যে বড় বড় বিষয়গুলি রয়েছে তার মধ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি অন্যতম। বলা চলে, ২০২৫-এ আরএসএসের শতবর্ষের আগে বিজেপি সরকারের এটি শেষ উপহার (তালিকা অবশ্য আরও লম্বা)। বাবরি মসজিদ আগেই ভাঙা হয়েছে। সে জায়গায় অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরির কাজ চলছে। কোভিডের অপরিসীম কষ্টের মধ্যে জনগণ যখন বাঁচার রাস্তা খুঁজছে, তখনই তার শিলান্যাস করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। আগামী বছরে তা উদ্বোধনও হয়ে যাবে। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা অনুযায়ী কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতার বিলোপ হয়েছে রাতারাতি আইন এনে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে তাকিয়ে মুসলমানদের তিন তালাক প্রথাকে (তালাক-এ-বিদাত) যেই সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে, তখনই আইন এনে তাকে ফৌজদারি অপরাধের আওতায় এনেছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
আরও পড়ুন- সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলের বার্তা: সংখ্যালঘুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক নন
এবার পালা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির। এর ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপির ইস্তেহারে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে এর খসড়াও তৈরি হয়ে গেছে। খুব শিগগিরি তা আইনে পরিণত হবে।
সংসদে জল মাপার জন্য গত বছর ডিসেম্বর মাসে বিজেপি সাংসদ কিরোদিলাল মীনা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বিল ২০২২ বেসরকারি বিল হিসেবে রাজ্যসভায় পেশ করেছিলেন। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ৬৩ জন পক্ষে ও ২৩ জন বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বিজেপি সাংসদেরা এই বিল পেশ করাকে সমর্থন করলেও কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেস, আরজেডি এর বিরোধিতা করেছিল।
২০১৮ পর্যন্ত আইন কমিশন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির রূপায়ণ নিয়ে বিপক্ষে মত দিলেও, এই বছর ১৪ জুন জনগণের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে তাদের মতামত জানাতে বলেছে। তার জন্য এক মাসের সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছে। মনে করা হচ্ছে সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে (যেটি ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে এই সরকারের আমলে শেষ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন হবে) অভিন্ন দেওয়ানি বিধি পাশ করিয়ে আইন তৈরির কাজ সম্পূর্ণ হবে।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা শুনলেই আমাদের সংখ্যালঘু মুসলিমদের কথা ও তাদের শরিয়ত আইনের কথাই মাথায় আসে। শাসক দল তাই চায়। নির্বাচনের আগে আবার সম্প্রদায়ের বিভাজনের মাধ্যমে ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ করতে চায় এই সরকার। অথচ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি শুধু মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপার নয়। এর ফলে শুধু শরিয়ত আইন নয়, ধর্মের ভিত্তিতে যে যে ব্যক্তিগত আইন (পার্সোনাল ল) এই মুহূর্তে রয়েছে তা হিন্দুদের হোক, মুসলমানদের হোক, পার্সিদের হোক, খ্রিস্টানদের হোক বা শিখদের হোক — সব বিলুপ্ত হবে। অন্তত তাই হওয়া উচিত।
এই ব্যাক্তিগত আইনে যে যে বিষয়গুলি পড়ে তা হলো বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, খোরপোষ, সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও ভাগ বাঁটোয়ারা, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। হিন্দুদেরও যেমন হিন্দু বিবাহ আইন ১৯৫৫, হিন্দু উত্তরাধিকার আইন ১৯৫৬, হিন্দু সংখ্য়ালঘু ও অভিভাবকত্ব আইন ১৯৫৬, হিন্দু দত্তক ও খোরপোষ আইন ১৯৫৬ রয়েছে এবং তা হিন্দুরা মেনে চলে, তেমনই খ্রিস্টান বিবাহ আইন ১৮৭২-এর মাধ্যমে সেই সম্প্রদায়ের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ের ফয়সলা হয়। পার্সিদের জন্য আলাদা পার্সি বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ আইন ১৯৩৬ রয়েছে। শিখদের বিয়ের জন্য আনন্দ বিবাহ আইন ১৯০৯ রয়েছে। মুসলমানদের জন্য মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন ১৯৩৭ রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন উপজাতিদের নিজস্ব ব্যক্তিগত আইনও বলবৎ।
কাজেই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রসঙ্গ এলেই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের দিকে সব চোখ চলে যাওয়া অনুচিত। এই সমস্ত ব্যক্তিগত আইনের উৎসই হলো ধর্মীয় আচার আচরণ, শাস্ত্র, ধর্মগুরুর নির্দেশ ইত্যাদি। যেমন, মূলত মনুস্মৃতি ও বেদের বিভিন্ন শ্লোক ও নির্দেশের উপর ভিত্তি করে হিন্দুদের ব্যক্তিগত আইনগুলি তৈরি হয়েছে। তেমনই মুসলমানদের ক্ষেত্রে কোরাণকে মূল হিসেবে ধরা হয়েছে।
ব্যক্তিগত আইনগুলির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটিও যে এগুলি প্রায় সবই পুরুষ-ঘেঁষা। ব্যক্তিগত আইনগুলিতে মহিলাদের অধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষদের অধিকারের চাপের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। হিন্দুদের সম্পত্তির ক্ষেত্রে মেয়েদের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে এই ২০০৫ সালে এসে, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে বদল এনে। শরিয়ত আইনেও মহিলাদের অধিকার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুব সীমিত এবং এর জন্য মহিলাদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আলাদা ব্যক্তিগত আইন না রেখে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির কথা আমাদের সংবিধানের প্রণেতারা আলোচনা করেছিলেন। তাতে কোনও একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পেরে ভারতীয় সংবিধানের চতুর্থ অংশের ৪৪ নং অনুচ্ছেদে তাঁরা লিখেছেন, রাষ্ট্র ভারতবর্ষের সমস্ত নাগরিকদের জন্য একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরিতে সচেষ্ট হবে। নরেন্দ্র মোদিরা সংবিধানের এই নির্দেশমূলক নীতিকে হাতিয়ার করছেন।
খুব ভালো কথা। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে (সংবিধান অনুযায়ী ভারত এখনও তাই) ধর্মের বাইরে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকারের কথা মাথায় রেখে একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরির চেষ্টাকে প্রগতিশীল বলাই উচিত। বিশেষত যখন এই সব আইনের মাধ্যমে মহিলারা কোণঠাসা তখন একটি প্রগতিশীল সমাজে আইনের রদবদল দরকার।
সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু আইনের ক্ষেত্রে তা কিছুটা হলেও শরিয়ত আইনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। আবার অন্যদিকে বর্তমান সরকার এই সমাজ বদলের প্রক্রিয়ায় সামিল হয়ে এখনও সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকারের বিষয়টি মেনে নিতে পারছে না। তাই তারা সুপ্রিম কোর্টে সাধুসন্তদের সমর্থন করে সমলিঙ্গের বিয়ের অধিকারের বিরোধিতা করছেন। কাজেই একটি রক্ষণশীল দলের সরকার হঠাৎ অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে কতটা প্রগতিশীল হবে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ তো থাকেই।
যদিও সমাজ বদলের সঙ্গে আইনের বদল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই লক্ষ্যে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও একটি জরুরি বিষয়। কিন্তু তা কোনও একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে কখনই হতে পারে না। আইন কখনই জনপ্রিয়তা আদায়ের লক্ষ্যে তৈরি করা উচিত নয়। ১৯৮৫ সালে শাহ বানুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে কংগ্রেসের রাজীব গান্ধি সরকার তা উল্টে দিয়ে গোঁড়া মুসলমানদের খুশি করে নতুন আইন এনে যে ভুল করেছিল, নরেন্দ্র মোদিরও সেই রকম পদক্ষেপ (উল্টোদিক থেকে) না করাই উচিত। তিন তালাক নিয়ে মুসলমান মহিলাদের মধ্যে বিজেপি সরকারের ও নরেন্দ্র মোদির নিজস্ব জনপ্রিয়তা অর্জনের যে চেষ্টা ছিল তাও ভুল ছিল।
আরও পড়ুন- ইদ সবার উৎসব হোক, কেন চান না রাজনীতিবিদরাই?
তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ বলে চিহ্নিত করে এই সরকার জনপ্রিয় হয়েছে ঠিকই কিন্তু তৃণমূল স্তরে মুসলমান মহিলাদের কতটা উপকার হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেছে। তিন তালাক অবৈধ ঘোষণার পরে এভাবে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা কম হলেও (এর কোনও সরকারি পরিসংখ্যান যদিও এখনও নেই) পরিত্যক্ত মুসলমান মহিলাদের সংখ্যা বেড়েছে বলে দাবি উঠেছে মুসলমান মহিলাদের নিয়ে কাজ করা সংগঠনের পক্ষ থেকেই।
যে মুসলমান মহিলারা সুপ্রিম কোর্টে তিন তালাকের বিরুদ্ধে মামলা লড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যেই অনেকের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে শান্তিতে সংসার করছেন। না তো প্রথম স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়েছেন, না কোনও খোরপোষ দিয়েছেন। অনেকে তো সন্তানের অধিকারটুকুও পাননি। কাজেই সস্তা জনপ্রিয়তা আদায় ও একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করার জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আম জনতার কোনও লাভ হবে না।
অন্যদিকে, এটাও দেখতে হবে কারা এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি তৈরি করবেন, কী হবে তার মূল ভিত্তি! সেখানে সব সম্প্রদায়ের সমান প্রতিনিধিত্ব থাকবে তো? সংখ্যাগুরুর মতামত সংখ্যালঘুর উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না তো? ভারত একটি বহুমত-বহুপথের দেশ। আমাদের সংসদেও এই বহুমতের প্রতিনিধিত্ব ঠিক মতো হয় না।
যে দেশে ১৪.২% মুসলমানের বাস, সেখানে ভারতের লোকসভায় নির্বাচিত মুসলমান সাংসদ ৫ শতাংশেরও কম। গত ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে মাত্র ২৭ জন মুসলমান জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে এর সংখ্যা ছিল ২৩। অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা সহজেই অনুমান করা যায়। এর পরেও আছে বিরোধী দলগুলির নির্বাচনী লাভ-ক্ষতির হিসেব। সেখানে আদর্শ, যুক্তি, প্রগতিশীল ভাবনা-চিন্তা সব পিছনের সারিতে।
সুতরাং, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি হোক কিন্তু শুধুই ধামাকার উদ্দেশ্যে নয়। সংখ্য়াগুরুর মতামত সংখ্যালঘুর উপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। এ নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হোক। জনগণের সমান অধিকার স্থাপনের জন্য এটি জরুরি।