যৌন সংসর্গে সংক্রমণ, কতটা কার্যকর এই মারণ ভাইরাসের ভারতে তৈরি ভ্যাকসিন?
এবার সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া (Serum Institute of India) নির্মিত হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (Human Papillomavirus or HPV) ভ্যাকসিন, CERVAVAC-এর বাণিজ্যিকীকরণের অনুমতি দিল ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া বা ডিসিজিআই...
এবার সেরাম ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়া (Serum Institute of India) নির্মিত হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (Human Papillomavirus or HPV) ভ্যাকসিন, CERVAVAC-এর বাণিজ্যিকীকরণের অনুমতি দিল ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া বা ডিসিজিআই (DCGI)। ভারতে নির্মিত এই কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন (qHPV) নয় থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সি মহিলা ও পুরুষরা ব্যবহার করতে পারবে।
বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, CERVAVAC-এর তিনটি পর্বের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল আশাজনক। জানা যাচ্ছে, এই ভ্যাকসিনটির ফলে শরীরে তৈরি অ্যান্টিবডি, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর। তবে এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কেবল সুস্থ ব্যক্তিরাই অংশগ্রহণ করেছে। যাঁদের সেই সময়ে হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল, সেই পুরুষ ও মহিলাদের বাদ দেওয়া হয়েছে ট্রায়াল থেকে। সুতরাং, সুস্থদের ক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে গড়ে উঠলেও, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ওপর সার্ভাভ্যাক কতটা কার্যকর হবে, তার উল্লেখ আমরা পাইনি।
সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র অধিকর্তা (Director of Government and Regulatory Affair) প্রকাশকুমার সিং গত (Prakash Kumar Singh) ৮ জুন এই ভ্যাকসিনটিকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার জন্য ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া-র কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই পরিকল্পনামতোই ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার বিশেষজ্ঞরা ১৫ জুন বৈঠক সেরে CERVAVAC-এর বানিজ্যিকীকরণের অনুমোদন দেন। আশা করা হচ্ছে, চলতি বছরের শেষের দিকেই এই ভ্যাকসিন বাজারে পাওয়া যাবে।
আরও পড়ুন: শ্বাসের মধ্যে ভরে নেওয়া করোনা ভ্যাকসিন বেশি কার্যকরী? এবার জানিয়ে দিলেন গবেষকরা
হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের জেনেটিক বস্তু হিসেবে থাকে ডিএনএ। এই ভাইরাসটি প্যাপিলোমাভিরিডি পরিবারের (Papillomaviridae Family) অন্তর্ভুক্ত। হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের মূলত চারটি প্রকার ক্যানসারের জন্য দায়ী। এই প্রকারগুলি হল Human Papilloma Virus Type 6, 7, 16 এবং 18 ।
এই ভাইরাস মহিলাদের মধ্যে সার্ভিক্যাল ক্যানসারের (Cervical Cancer) অন্যতম একটি কারণ। ভারতীয় মহিলাদের ক্যানসারের কারণ হিসেবে দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে সার্ভিক্যাল ক্যান্সার। এবং মূলত ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে এই ক্যানসারের হার সবথেকে বেশি। ভারতে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ২৩,০০০ মহিলা সার্ভিক্যাল ক্যানসারে আক্রান্ত হন এবং মারা যান ৬৭,০০০-এরও বেশি মহিলা।
সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া নির্মিত এই ভ্যাকসিনে চারটি আলাদা আলাদা রাসায়নিক গঠনের অ্যান্টিবডি রয়েছে। ক্যানসার-সৃষ্টিকারী চার প্রকার হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করবে এক একটি প্রকারের অ্যান্টিবডি। ঠিক সেই কারণেই CERVAVAC ভ্যাকসিনকে কোয়াড্রিভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন বলা হচ্ছে।
আশা করা যায়, সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া নির্মিত এই ভ্যাকসিন মহিলাদের মধ্যে সার্ভিক্যাল ক্যানসারের সম্ভাবনা কমাবে হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের ভ্যাকসিন। যদিও পুরুষরা সার্ভিক্যাল ক্যানসারে আক্রান্ত হন না, কিন্তু হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের সংক্রমণের ফলে পুরুষদের যৌনাঙ্গে ছোট ছোট আঁচিলের (wart) মতো গঠন দেখা যায়। তার থেকেও ভয়ংকর হল, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের আক্রমণে লিঙ্গ এবং মলদ্বারে ক্যানসারও হতে পারে। সেন্টার ফর ডিজি়জ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের (CDC) সূত্রে জানা যাচ্ছে,হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস ছড়ায় মূলত যৌন সংসর্গের (Sexual Transmission) ফলে। যৌন সংসর্গের ফলে সংক্রমণ যোনি (Vaginal Intercourse), পায়ু (Anal Sex) এবং মুখ (Oral Sex) সঙ্গম, তিন ভাবেই হতে পারে। এমনকী, ওরাল সেক্সের ফলে মুখেও সংক্রমিত হতে পারে হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজে়শন বা হু-এর ইন্টারন্যাশানাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রি প্ল্যাটফর্ম থেকে জানা যাচ্ছে, ফে়জ ২/৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের দুই দলে ভাগ করা হয়। প্রথম দলে থাকে ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলে-মেয়েরা এবং দ্বিতীয় দলে ১৫ থেকে ২৬-এর নারী-পুরুষরা।
প্রতি দলেই কিছু নারী-পুরুষদের সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র বানানো কোয়াড্রিভ্যালেন্ট হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস ভ্যাকসিন দেওয়া হয়; বাকি নারী-পুরুষদের গার্ডাসিল (মার্ক নামের সংস্থার নির্মিত) নামের আরেকটি হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়। গারডাসিলও Human Papilloma Virus Type 6, 7, 16 এবং 18 -এর বিরুদ্ধে কার্যকর।
ট্রায়ালের শেষে দেখা যায়, সার্ভাভ্যাকের প্রভাবে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি, গারডাসিলের প্রভাবে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির থেকে ১,০০০ গুণ বেশি কার্যকর।
সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (Chief Executive Officer), ড. আদার পুনাওয়ালার (Dr. Adar Poonawalla) মতে, এ-যাবৎ আমরা হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের ভ্যাকসিনের জন্যে বিদেশি সংস্থাগুলির ওপরেই নির্ভরশীল ছিলাম। কিন্তু এই প্রথম আমরা সম্পূর্ণভাবে নিজেরাই এই ভ্যাকসিন বানালাম, অন্য কোনও দেশের ওপর নির্ভর না করেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণের স্বপ্নের কথা মাথায় রেখে এই ভ্যাক্সিন নির্মান করা হয়েছে, কোনও বিদেশি সংস্থার সাহায্য ছাড়াই, জানাচ্ছেন প্রকাশ সিং।
ড. পুনাওয়ালা জানাচ্ছেন, কেবল ভারতীয়ই না, সারা বিশ্বের জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে। এবং এই বাণিজ্যিকীকরণ হলে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যেই এই ভ্যাকসিনকে রাখা হবে।
২০০৯ সালে বিল গেটস ও তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী মেলিন্ডা গেটসের সংস্থা গেটস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে, তেলেঙ্গানা ও গুজরাতে আদিবাসী কিশোরীদের হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের ভ্যাকসিন গার্ডাসিল দেওয়া হয়। তখন অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশই ছিল। কিশোরীদের অভিভাবকদের অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা, বেশ কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে জানানোও হয়নি ভ্যাকসিন বা রোগটির বিষয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অনুমতিপত্রে সই করেছিল, সেই কিশোরীরা যে হোস্টেলে থাকত, সেই হোস্টেলের ওয়ার্ডেন। যা একেবারেই নিয়মবিরুদ্ধ। আবার কিছু ক্ষেত্রে গরিব ও নিরক্ষর অভিভাবকদের আঙুলের ছাপ নিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল কনসেন্ট ফর্মে। কিশোরীদেরও জানা ছিল না, তাদেরকে কীসের ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে বা কোন রোগের জন্য ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে।
তেলেঙ্গানায় ১৬,০০০-এর কাছাকাছি কিশোরীদের দেওয়া হয় এই ভ্যাকসিন। কয়েক মাস বাদে সেই মেয়েদের মধ্যে অনেকেই ধীরে ধীরে অসুস্থ হতে শুরু করে। ওই রাজ্যে পাঁচজন কিশোরী ২০১০ সালের মধ্যে মারা যায়।
সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া-র ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে নিশ্চিত করা হয়েছে, ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক যেন সাক্ষর করেন নিজেদের। ১৮ বছর বয়সের কমে অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে তাদের অভিভাবকদের সই সংগ্রহ করে, তবেই শুরু হয়েছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। অন্তত সেরকমই উল্লেখ আছে হু-এর ইন্টারন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রি প্ল্যাটফর্মে।