১৬ বছরেই গলায় চরম মাদকতা! 'স্নো হোয়াইট'-এর পর কোথাও কেন গলা দিলেন না গায়িকা?

Snow White and Seven Dwarfs: প্রচুর অফার এসেছিল। তবু “স্নো হোয়াইট”-এর পর আর কোথাও গলা দেননি কাসেলোটি। বলতেন " I don't want to spoil the illusion of Snow White"।

১৯৩৪-এর এক বিকেলে আচমকা ডিজনি স্টুডিওর সব অ্যানিমেটরদের ডেকে নিলেন ডিজনি। কোনও মিটিং না। তিনি এক গল্প শোনাবেন। চারিদিকে ফোল্ডিং চেয়ার পেতে বসে পড়ল সবাই। মাঝে দাঁড়িয়ে ডিজনি বলে যেতে লাগলেন অপরূপ এক কাহিনি। এক সুন্দরী দুষ্টু রানি, তার সৎ মেয়ে আর সাত বামনের গল্প। প্রতিটা চরিত্র, তাদের হাবভাব, কথাবার্তা, নকল করে দেখালেন পর্যন্ত। দেখালেন সেই ছোট্ট মেয়ের নাচ, বামনদের ঝুঁকে চলা, রানির শয়তানি হাসিতে, “হু ইজ দ্য ফেয়ারিয়েস্ট অব অল” বলা। গল্প যখন শেষ, সবাই রুমাল দিয়ে চোখ মুছছেন। তাদের থিতু হতে না দিয়েই আসল বোমটা ফাটালেন ডিজনি। “আমি ভাবছি এই গোটা গল্প নিয়ে ফুল লেন্থ একটা মুভি বানাব”। অনেকে এতটাই অবাক হয়ে গেছিল যে, চোখ মুছতেও ভুলে গেল। লোকটা কি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল? অ্যানিমেশন মানেই ছোট ছোট ছবি। সিনেমার আগে বা পরে দেখানোর জন্য। তাতে খাটনি কম। লাভ বেশি। ঝুঁকি প্রায় নেই বললেই চলে। তিন-চার মিনিটের সিলি সিম্ফনি আর মিকি মাউসের শর্ট অ্যানিমেশন দেখিয়ে ডিজনি তখন দেদার কামাচ্ছেন। সেই বাজারে এত বড় ঝুঁকি নেওয়া সোজা খাদে ঝাঁপ ছাড়া কিছু না। কয়েক বছর আগেই স্টুডিও চালাতে গিয়ে দেউলিয়া হয়েছেন ডিজনি। শেষ মুহূর্তে হাল ধরেছিলেন দাদা রয়। সেই রয় আর ডিজনির স্ত্রী লিলিয়ান খাতা কলম নিয়ে বসলেন হিসেব কষতে। খুব কম হলেও পাঁচ লক্ষ ডলার খরচ (যদিও আসল খরচ হয়েছিল এর তিন গুণের বেশি), বন্ধক রাখতে হবে স্টুডিও। এর পরেও এত বড় অ্যানিমেশন ছবি ধৈর্য ধরে দর্শক দেখবে কিনা সন্দেহ। এতেই শেষ নয়, সেই প্রথমবার অ্যানিমেশনে শুধু মজা বাদে, রাগ, দুঃখ, ভালবাসা, আবেগ সব ফুটিয়ে তুলতে হবে। অ্যানিমেটররা আগে কোনওদিন এমন কাজ করেননি। তারা কি পারবেন? আর না পারলে সব মাটি।

কিন্তু জিনিয়াসরা কবেই বা ঝুঁকির তোয়াক্কা করেছেন? বালককালে ওয়াল্টের দেখা প্রথম নির্বাক ছবি ছিল মার্গারিটা ক্লার্কের স্নো-হোয়াইট। আর সেটা এতটাই গেঁথে গেছিল মাথায় যে, তিনি সেই ছবির মিউজিক্যাল না বানিয়ে শান্তি পাচ্ছিলেন না। অগত্যা বন্ধু ডন গ্রাহাম শুরু করলেন আর্টিস্ট খোঁজা। শুধু এই ছবির জন্য বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে গোটা আমেরিকার সেরা আঁকিয়েরা উপস্থিত হলেন হাইপেরিয়ন স্টুডিওতে। সেখানে কিছুদিন চলল লাইভ জীবজন্তুদের হাবভাব দেখে তাদের ছবি আঁকার ক্লাস। সেই ক্লাস থেকে সেরা দেড়শকে নিজের হাতে বেছে নিলেন ডিজনি। তাদের সঙ্গে রোজ মিটিং চলত। প্রতিটা ফ্রেম নিয়ে, মুভ নিয়ে। এইখানে অদ্ভুত একটা টোপ দিলেন তিনি। কেউ কোনও জব্বর খণ্ডদৃশ্যের আইডিয়া দিলেই সঙ্গে সঙ্গে পাবে পাঁচ ডলার। আর গোটা দুই মিনিটের একটা দৃশ্যের আইডিয়ায় কুড়ি ডলার করে। তখনকার দিনে নেহাত কম না। রাত জেগে জেগে নিত্য নতুন আইডিয়া আর ছবিতে ভরে উঠল স্টোরিবোর্ড।

আরও পড়ুন- “এই ছেলেকে দিয়ে আমি গান গাওয়াব,” বাথরুমে কিশোরের গলা শুনে বলেছিলেন শচীন কত্তা!

একটা ব্যাপার শুরুতেই বলে দিয়েছিলেন ডিজনি। নায়িকার বিশেষ কিছু করার নেই, রাজকুমার প্রায় ক্যামিও, রানি হলেন টিপিক্যাল ভিলেন আর তাই গোটা গল্পের প্রাণ ওই সাত বামন। গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে কমিক রিলিফ সবটাই তাদের হাতে। তারাই শক অ্যাক্টর, আবার স্টক অ্যাক্টর। মূল কাহিনিতে এঁদের কোনও নাম নেই। কিন্তু এভাবে চলবে না। নাম দিতে হবে। আর এমন নাম যা দিয়ে তাদের চরিত্র চেনা যায় সহজেই। ব্রেইন স্টর্ম চলল নাম নিয়ে- জাম্পি, ডেফটি, সুইফট, লেজি, বাল্ডি, শর্টি… শেষে অনেক ঝাড়াইবাছাই করে পাঁচটা নাম ঠিক করলেন অ্যানিমেটররা। গ্রাম্পি, হ্যাপি, স্লিপি, স্নিজি আর ব্যাশফুল। বড় ভাইয়ের নাম ডিজনি নিজে দিলেন 'ডক' আর ছোটভাই 'ডোপি'। প্রথমে ঠিক ছিল ডোপি হবে বোকা। ডিজনি অন্য উপায় বাতলালেন। বললেন ডোপি কথা বলবে না, হাবভাব হবে অনেকটা বাড়ির প্রিয় পোষা কুকুরের মতো। আদুরে, অনুগত কিন্তু বুদ্ধিমান। ঠিক সেই কারণেই একমাত্র ডোপিই কান নাড়াতে পারে।

স্নো হোয়াইটের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য মারজোরি বেলচার নামে এক মেয়েকে নেওয়া হয়। সে কস্টিউম পরে অভিনয় করত। অ্যানিমেটররা তার হাবভাব, অঙ্গভঙ্গি নিখুঁত এঁকে ফেলতেন। সামনের চরিত্র আর পিছনের ব্যাকগ্রাউন্ডকে শুরুতে আলাদা করা যাচ্ছিল না। সামনের অবজেক্টকে বড় করতে গেলে ব্যাকগ্রাউন্ডও বেড়ে যাচ্ছিল সমান হারে। ডিজনির করিতকর্মা ক্যামেরা বিভাগ ৭০০০০ ডলার খরচ করে বানিয়ে ফেলল একটা মাল্টিপ্লেন ক্যামেরা যাতে প্রতি লেয়ারের আলাদা ছবি তুলে জুড়ে দেওয়া যায়। ভেবে দেখুন, কোথায় লাগে আজকের ভিএফএক্স!

এতক্ষণ সব ঠিক চলছিল। ফ্যাসাদে পড়লেন স্নো হোয়াইটের গলা নিয়ে। কিছুতেই ডিজনি তাঁর মনের মতো গলা পাচ্ছেন না। শেষে ডিজনি ঠিক করলেন নিজে একটা ঘরে গিয়ে বসবেন; অডিশন হবে অন্য ঘরে। যাতে অভিনেতার চেহারা ডিজনির বিচারে প্রভাব না ফেলতে পারে। ডিজনি চাইছিলেন এমন একটা আওয়াজ যার মধ্যে সারল্য আছে, পাখির কলতানের মূর্ছনা আছে, আবার তা একেবারে শিশুসুলভ নয়। এমন এক গলা যা শুনলে সত্যিকারের কিশোরীর মনে হয় আবার তাতে রূপকথার মায়াবী পরশও থাকে। কিন্তু চাইলেই কি পাওয়া যায়? অনেক খুঁজে যখন প্রায় হাল ছেড়ে দেওয়ার দশা একটা গলা শুনেই ডিজনি লাফিয়ে উঠলেন, “Thats the voice”। মেয়েটির নাম আদ্রিয়ানা কাসেলোটি, বয়স ষোল। কিন্তু গলায় অদ্ভুত এক মাদকতা। অপেরা শেখে। তাঁকেই বেছে নেওয়া হল স্নো-হোয়াইটের জন্য।

আরও পড়ুন- চারশো টাকা না পেলে হাসপাতাল থেকে ফিরত না স্ত্রী! যেভাবে আমজাদ খান হলেন গব্বর সিং

এদিকে তিন বছর কেটে গেছে। খরচ বাড়ছে হু হু করে। ডিজনি একাই যেন দশ জন হয়ে এই স্টোরিবোর্ড দেখছেন, তো পরমুহূর্তে গানের ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বলছেন, “গানকে কথার সঙ্গে মিশিয়ে দাও বুঝলে। গান গাইতে গাইতে কথা আসবে। কথা বলতে বলতে গান। কেউ যেন আলাদা না ভাবে”, আর তার পরেই দৌড়চ্ছেন স্টোরি বিভাগে। শেষ মুহূর্তে একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। সেটা ঢোকানো যাবে কিনা।

দেনার বিপুল দায় মাথায় নিয়ে ১৯৩৭ সালের বড়দিনে মুক্তি পেল “স্নো হোয়াইট অ্যান্ড সেভেন ডোয়ার্ফস”। এক বছরের কম সময়ে আয় করল ৮ মিলিয়ন ডলার। মনে রাখতে হবে, সেই সময় টিকিটের দাম ছিল মাত্র তিরিশ সেন্ট। শিশুদের এক ডাইম। সোজা কথা এক বছরে ৩ কোটির উপরে মানুষ এই ছবি দেখেছিল। এরপরের ইতিহাস সবার জানা। শুধু এটা অনেকের জানা নেই, প্রচুর অফার এসেছিল। তবু “স্নো হোয়াইট”-এর পর আর কোথাও গলা দেননি কাসেলোটি। বলতেন " I don't want to spoil the illusion of Snow White"।

সারা জীবন কাসেলোটি একটা চরিত্র হয়েছি বেঁচে রইলেন। সেই মেয়েটা, যে তুষারের মতো সাদা, গোলাপের মতো কোমল, বাঁশির মতো সুরেলা। আর যার মা ছোটবেলাতেই মরে গেছিল।

More Articles