আমেরিকায় ফের ক্ষমতায় ট্রাম্প! ভিসা নিয়ে বিপদ বাড়তে চলেছে ভারতীয়দের?
H-1B Visa Rules for Indian: পুনরায় সিংহাসনে ট্রাম্প। আরও একবার যে সেই এইচ-ওয়ানবি ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি বাড়তে চলেছে আমেরিকায়, তা কার্যত পরিষ্কার। যার জেরে বিপদে পড়তে পারেন অজস্র ভারতীয়।
ফের হোয়াইট হাউজের দখল রিপাবলিকানদের হাতে। ২০২০ সালে মেয়াদ ফুরোনোর পর আমেরিকার সর্বেসর্বার পদ ছেড়ে সরে যেতে হয়েছিল ট্রাম্পকে। ফের ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন বটে, তবে সেবার দুর্নীতির বোঝা মাথায় আর ফিরতে পারেননি মার্কিন এই ব্যবসায়ী। ২০২৪-এর ভোটে ফের রিপাবলিকানদের হয়ে প্রার্থী হলেন তিনি। শুধু হলেনই না, কার্যত বিপুল ভোটে জিতে তিনি ফিরলেন মসনদে। প্রায় ২৯৫টি আসন তিনি দখল করেছেন, প্রতিপক্ষ কমলা হ্যারিসের কাছে যখন রয়েছে ২২৬টি মাত্র। বুধবারই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, আগামী চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজ আপাতত রিপাবলিকানদের। তার পর থেকেই বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতাদের কাছ থেকে ভিড় করেছে শুভেচ্ছা। আমেরিকার হবু প্রেসিডেন্ট তথা 'প্রিয় বন্ধু' ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জয়ের শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর গোড়াতেই জানিয়েছিলেন, ভোটে জিতে যে-ই হোয়াইট হাউজের দখল নিক না কেন, ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তাঁর প্রভাব পড়বে না। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ট্রাম্পের পুনরায় গদিতে বসা, সত্যিই কি ভারতীয়দের জন্য কোনও আশঙ্কার জন্ম দেবে না? ওয়াকিবহাল মহল কিন্তু তেমন মনে করছে না মোটেই।
এর আগের দফাতেও ক্ষমতায় এসেই অভিবাসন নীতি নিয়ে কড়া অবস্থান নিতে দেখা গিয়েছিল ট্রাম্পকে। এবারেও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি জুড়ে বারবার উঠে এসেছে সেই অভিবাসন প্রসঙ্গ। বারবার মার্কিন সীমান্তে অনুপ্রবেশ বন্ধ করা নিয়ে কথা বলেছেন ট্রাম্প। কথা বলেছেন অভিবাসীদের নিয়েও। প্রতিবছর ভারত থেকে অসংখ্য মানুষ মার্কিন মুলুকে যান। কেউ পড়াশোনার প্রয়োজনে, কেউ বা চাকরির। কর্মসংস্থানের নিরিখে ভারতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের আজও পয়লা নম্বরের পছন্দ আমেরিকা। আর ট্রাম্পের কুর্সিদখল ঠিক এই জায়গাতেই ভারতীয়দের পক্ষে আশঙ্কার।
রেকর্ড বলছে, ২০২২ সালে প্রায় ৭৭ শতাংশ এইচ-ওয়ানবি ভিসা সুরক্ষিত করেছে ভারতীয়রা। আমেরিকার অভিবাসন দফতরে অনুমোদিত হয়েছে প্রায় ৩ লক্ষ ২০ হাজার আবেদন। যার ভিত্তিতে অসংখ্য ভারতীয় মার্কিন মুলুকে গিয়েছেন কাজের প্রয়োজনে। এর আগেও ট্রাম্পের শাসনে সেই এইচ-ওয়ানবি ভিসা অর্থাৎ যা ওয়ার্ক ভিসা হিসেবেই পরিচিত, তা নিয়ে বড়সড় বদল করা হয়েছিল আমেরিকায়। যা বাইডেন জমানায় ক্রমশ শিথিল হয়। কিন্তু পুনরায় সিংহাসনে ট্রাম্প। আরও একবার যে সেই এইচ-ওয়ানবি ভিসা নিয়ে কড়াকড়ি বাড়তে চলেছে আমেরিকায়, তা কার্যত পরিষ্কার। যার জেরে বিপদে পড়তে পারেন অজস্র ভারতীয়।
আরও পড়ুন: ইজরায়েলকে এত দিন ঢালাও অস্ত্রসাহায্য বাইডেনের, যুদ্ধ থামাতে চাইবেন ট্রাম্প?
মোদির সঙ্গে বরাবরই বন্ধুত্বের সম্পর্ক ট্রাম্পের। একাধিক বার ট্রাম্পের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি আমেরিকায় গিয়েছেন। এ দেশে পাল্টা এসেছেন ট্রাম্পও। বুধবার ট্রাম্পের জয়ের খবর পেয়েই একগুচ্ছ পুরনো ছবি খুঁজে বের করে নিজের এক্স হ্যান্ডেলে পোস্ট করেছেন মোদি। জানিয়েছেন শুভেচ্ছা। ভবিষ্যতে একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার বার্তাও দিয়ে রেখেছেন আগেভাগেই। কিন্তু এই সৌজন্যের জলে কি আমেরিকায় কাজ করতে যেতে চাওয়া ভারতীয়দের চিড়ে গলবে? নাকি ভিসা পাওয়া নিয়ে আগামী চার বছর অন্তত কাঠখড় পোড়ানো লেগেই রয়েছে ভারতীয়দের কপালে?
ট্রাম্প তাঁর প্রথমে মেয়াদে, অর্থাৎ ২০১৬ সালে ভোটে জিতে আসার পর অভিবাসন নীতি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে কঠোরতা জারি করেছিলেন। এই সংক্রান্ত একাধিক পরিকল্পনাও বাস্তবায়িত করেন তিনি। যার মধ্যে অন্যতম ছিল এইচ-ওয়ানবি ভিসা প্রোগ্রামের বিরোধিতা। আর তার পিছনে ট্রাম্পের যুক্তি ছিল, এই ওয়ার্ক ভিসা কালচার আসলে সচ্চা মার্কিনিদের কাছ থেকে চাকরির সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। অভিবাসন নীতিতে কড়াকড়ি আনতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপও নেওয়া হয়। বাড়ানো হয় নিরাপত্তা ও তথ্য যাচাইয়ের ব্যবস্থা। আবেদন প্রক্রিয়া তো আরও জটিল করাই হয়, তার সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিসা অনুমোদনের সময়ও। এমনকী সরকারি নির্দেশে বাড়তে থাকে ভিসা প্রত্যাখ্যানের প্রবণতাও।
রেকর্ডের খাতা বলছে, প্রাথমিক কর্মসংস্থানের এইচ-ওয়ানবি পিটিশন অস্বীকারের হার ২০১৫ সালে ছিল ৬ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ২৪ শতাংশ এবং ২০২০ সালের মধ্যে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। যেখানে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়ে তা ৩.২ শতাংশ ছিল, তা ট্রাম্প জমানায় হয়েছিল ১৮ শতাংশ। পাশাপাশি ট্রাম্প প্রশাসনের তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাতে ন্যূনতম মজুরির প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে স্ট্যান্ডার্ড মার্কিন কর্মীদের সঙ্গে সমান করা যায়। যা বিদেশি কর্মীদের উপর আর্থিক বোঝা বাড়াবে। পাশাপাশি সংস্থাগুলির পক্ষেও তাদের নিয়োগের বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। এখানেই শেষ নয়, ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন কর্মীদের সঙ্গে বিদেশি কর্মীদের বেতনও ৪৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭১ শতাংশ করার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন চূড়ান্ত নিয়ম (Interim Final Rule) জারি করে ট্রাম্প প্রশাসন। যদিও তাদের জারি করা এই নিয়মটি নিয়ে আইনি জলঘোলা হয় এবং শেষমেশ ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে ফেডারেল আদালত এই আইনের উপর স্থগিতাবস্থা জারি করে। জল্পনা ছড়ায় ট্রাম্প প্রশাসন এইচওয়ানবি ভিসার ক্ষেত্রে বার্ষিক ক্যাপ কমাতে পারেন বা উন্নত ডিগ্রি বা বিশেষ দক্ষতাযুক্ত আবেদনকারীদেরই অগ্রাধিকার দিতে পারেন। তেমনটা হলে অনেকেই মার্কিন মুলুকে চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, বিশেষত ভারতীয়রা।
কিন্তু এ তো গেল ট্রাম্পের প্রথম দফার কথা। ২০২০ সালে ভোটে জেতার জন্য বাইডেনের ট্রামকার্ড যেমন ছিল স্বাস্থ্যসুরক্ষার মতো বিষয়গুলি, সেখানে ট্রাম্প খেলেছেন এই অভিবাসন নীতি নিয়ে কড়াকড়ির ঘুঁটি। ২০২৪ সালের নির্বাচনী প্রচারেও দেখা গেল, সেই বিষয়টিকেই পুনরায় তুলে আনলেন ট্রাম্প। বারবার প্রচারে উঠে এল আমেরিকায় অভিবাসন সীমিত করার জন্য অতিরিক্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। এই ধরনের নীতির লক্ষ্য মার্কিন কর্মীদের অগ্রাধিকার দেওয়া, সে কথা ১০০ ভাগ খাঁটি। আর ট্রাম্পের সেই তাস যে ভোটবাজারে ভালোই কাজ করেছে, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন:ম্যাজিক সংখ্যা পেরিয়ে হোয়াইট হাউজের পথে ট্রাম্প, যা যা বললেন বিজয়ভাষণে
তবে আপাতত ট্রাম্পের সেই প্রতিশ্রুতিরাশিই বড়সড় ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমেরিকায় যেতে চাওয়া ভারতীয়দের জন্য। প্রচারেই ট্রাম্প দাবি করেছেন, ক্ষমতায় এসে এইচ-ওয়ানবি ভিসার সংখ্যা হ্রাস করার পাশাপাশি ওয়ার্কিং ভিসা দেওয়ার জন্য কঠোর যোগ্যতার মানদণ্ডও কার্যকর করবেন তিনি। এতে মার্কিনিদের সুবিধা হলেও বিপদে পড়তে পারে বিদেশি দক্ষতার উপর নির্ভরশীল একাধিক সংস্থা। আমাজন থেকে শুরু করে গুগলের মতো বহু বহুজাতিক সংস্থাই বিভিন্ন দেশের কর্মীদের নিয়ে কাজ করতে অভ্যস্ত। শুধু ভারত নয়, বিভিন্ন দেশ থেকেই মার্কিন মুলুকে এই সব সংস্থায় শ্রম দিতে আসেন তাঁরা। কিন্তু ট্রাম্পের এই নয়া পরিকল্পনা যেমন কাজের বাজারে ছাপ ফেলবে, তেমনই এই সব সংস্থার উৎপাদনকেও প্রাভাবিত করতে পারে আশঙ্কা। সবচেয়ে বিপদে পড়তে পারেন থার্ড পার্টি ক্লায়েন্ট সাইটসে যাঁরা কার করে থাকেন তাঁরা। কারণ রিপোর্ট বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন এইচ-ওয়ানবি ভিসা নিয়ে আমেরিকায় থাকার মেয়াদও কমিয়ে দিতে পারে অনেকটাই। কর্মীর পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থার উপরেও ছাপ ফেলবে বলেই আশঙ্কা করা হয়েছে রিপোর্টে।
এতদিন পর্যন্ত এই এইচ-ওয়ানবি ভিসার একটা বড় অংশ পেতেন ভারতীয়রা। মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের যতই বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকুক না কেন, ভিসা নিয়ে তাঁর এই কড়াকড়ির প্রভাব স্বাভাবিক ভাবেই প্রভাব ফেলবে ভারতীয়দের কর্মসংস্থানের উপরে। তথ্যপ্রযুক্তি-সহ একাধিক সেক্টরে ভারতীয় কর্মীদের সুযোগ অনেকটাই কমিয়ে দেবে ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ। সমস্যা শুধু সেখানে নয়। যেসব ভারতীয়রা এইচ-ওয়ানবি ভিসায় ইতিমধ্যেই আমেরিকায় রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পরিজনেরা এইচ-ওয়ানবি-র ডিপেন্ডেন্ট ভিসায় বিদেশে পাড়ি দিতেন। ট্রাম্পের কড়াকড়ির জেরে বিপদে পড়তে চলেছেন তাঁরাও। ফলে আমেরিকায় যাঁরা কাজের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছেন, আগামী চার বছর তাঁদের জন্য খুব একটা আশাজনক হবে না বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। এ নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোর চর্চা।