স্বামীশ্রেষ্ঠ, পুরুষোত্তম নন, রামায়ণে রামকে আসলে যেভাবে এঁকেছেন মহিলারা...

Brahminism and Women: মহিলা রচিত রামায়ণে রাম হয়ে যাচ্ছেন দুর্বল চরিত্রের একজন পুরুষ, মহিলারা রামের বর্ণনা করেছেন পাষণ্ড ও পাপিষ্ঠ বলে।

বর্তমানে আরএসএস ও বিজেপি সরকারের যে হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা, তার ইতিহাস কিন্তু নিহিত রয়েছে সুদূর আর্য সভ্যতা থেকেই। জার্মানির হিটলার যেমন আর্যদের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রচার করেছেন, আর্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাঁর একনায়কতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য, তেমনই আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদ ও হিন্দুরাষ্ট্রের কাঠামো সেই একই আর্যবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে বহু দশক ধরে। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কোনওকালেই যে নারীদের অবস্থান বেশ উচ্চমার্গীয় ছিল, এমন হলফ করে বলা যায় না। ব্রাহ্মণ্যবাদের জাতিভেদ প্রথার আগেও নারীদের উপর ক্ষমতা প্রদর্শন ছিল পরিচিত সামাজিক কাঠামো।

আর্যদের যুগে মেয়েদের অবস্থান:

আনুমানিক পূর্ব বৈদিক যুগ থেকেই ভারতবর্ষ আর্য জনজাতির দখলে চলে আসে। আর্যরা ছিল মূলত পশুপালক, একাংশের তত্ত্ব বলে, তারা জোর করে যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের প্রাচীন অনার্য জনজাতির থেকে তাঁদের জমি ছিনিয়ে নেয়। এই ইতিহাস রাহুল সাংকৃতায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গা ও সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রাচীন ভারত গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে বহুবার। ভোলগা থেকে গঙ্গাতে দেখা গেছে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর সাম্য কীভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে হস্তান্তরিত হয়েছে এবং সমাজে লিঙ্গবৈষম্য কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক স্থান হয়ে উঠেছে। আবার সুকুমারী ভট্টাচার্যের প্রাচীন ভারতে আর্যদের জীবনযাপন, সমাজ ও ধর্মাচরণের ব্যাখ্যায় উঠে এসেছে তৎকালীন মহিলাদের সামাজিক অবস্থান। প্রাচীন ভারতে সুকুমারী দেবী লিখছেন, আর্যদের সমাজ ছিল মূলত পশুপালন ও পুরুষতান্ত্রিক। আনুমানিক ঋকবৈদিক যুগে নারীর ভূমিকা ছিল কেবলই সন্তান উৎপাদন, গবাদি পশুর পরিচর্যা ও স্বামী-শ্বশুরবাড়ির পরিবারে সেবাযত্ন আর কুটিরশিল্পের কাজ করা। এর বাইরে যজ্ঞ বা অন্যান্য ধর্মীয় আচারে নারীর কোনও ভূমিকা পাওয়া যায়নি।

আজকের যে মনুবাদী ঐতিহ্যকে সামনে রেখে পুরুষতান্ত্রিকতার আগ্রাসনের কথা ওঠে তা মনুর চেয়ে ঢের প্রাচীন, আর্যদের প্রতিষ্ঠা করা সামাজিক ব্যবস্থা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কখনই ভারতের আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়নি, আদিবাসী জনজাতির মধ্যে সাম্য ও মাতৃতান্ত্রিক কিছু প্রথা দেখতে পাওয়া যায় আজও। মূলত হিমালয় ও হিমালয়ের পাদদেশ, উত্তর ভারতের লাদাখ, জম্মু, হিমাচলের বেশ কিছু গ্রাম জুড়ে দেখা যায় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর ছাপ। এছাড়া বাংলাও যে একসময় আদিম মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারাই পরিচালিত ছিল, এমনটা মনে করেছেন অনেকেই। বাংলা ও প্রাচীন তিব্বতের বুকে আদিকাল থেকেই শক্তি সাধনার চল ছিল, কিন্তু আর্যদের মূল আরাধ্য ছিলেন পুরুষ দেবতারা, নারীদের সংখ্যা খুবই কম ছিল। সুকুমারী দেবীও ঋকবেদের যুগ বর্ণনার আলোচনায় এই তথ্যটি উল্লেখ করেছেন। যদিও রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভোলগা থেকে গঙ্গায় তিনি লিখেছেন, অসুরদের সমাজে নারীর অবস্থান ছিল বিপর্যস্ত, আবার তার পাশাপাশি আর্যদের মধ্যেও নারীদের যুদ্ধের স্বাধীনতা পুরুষ কীভাবে খর্ব করছে পরবর্তীকালে সেই ইতিহাস ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।

আরও পড়ুন- বাইজি গলি থেকে মুম্বই শাসন! ভারতের প্রথম দুই মহিলা সুরকারকে ভুলেছে সিনেমা

ইতিহাস কী বলে:

ইদানীংকালের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসনকে বুঝতে গেলে তার উৎপত্তিকে জানতে হবেই। যে কোনও অবস্থানই কখনও আকস্মিক নয়, প্রতিটি অবস্থান ও ঘটনার পশ্চাতে আছে তার গড়ে ওঠার ইতিহাস, যেখান থেকে তার বীজ বপনের শুরু। সেই বুনিয়াদকে পিছিয়ে গিয়ে না দেখলে গোড়ার থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয় কোনও অবস্থানেরই। জাতিভেদ প্রথাই হোক বা শ্রেণি বিভাজন অথবা লিঙ্গবৈষম্যের চর্চা; চর্চা লিখলাম কারণ, যুগের পর যুগ ক্ষমতাশালীরাই সমাজকে নির্দিষ্ট কাঠামো দিয়েছে নিজেদের সুবিধা ও ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য। তারা কিছু সামাজিক নিয়ম, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম ও ধর্মীয় নিয়মকে বছরের পর বছর ধরে চর্চা করতে বাধ্য করেছে বা কখনও কখনও ভুল বুঝিয়েছে তার অধস্তন শ্রেণির মানুষদের, এমনভাবেই তা পরবর্তীকালে সমাজের ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজ কাঠামো আদতে কী ছিল তা খুঁজে বের করা কঠিন। তবু দেখা গেছে, সাম্যবাদী, সমাজতান্ত্রিক সমাজকাঠামোই মানব সভ্যতার প্রাচীনতম সমাজ ব্যবস্থা, পরে তা কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ নিজেদের সুবিধার জন্য বিকৃত করতে থেকেছে বিবিধ নিয়ম-কানুন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

নারী ও ভূমির সংযোগ:

আর্যবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের ইতিহাসের সেকাল ও একালকে নেড়েঘেঁটে দেখাই আমাদের উদ্দেশ্য। দার্শনিক হেগেলের ‘ফেনোমেনোলজি’ বেশ কিছুটা অনুপ্রাণিত করেছে আর্যবাদের ইতিহাস থেকে বর্তমানে তার যোগসূত্রকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। জমি অধিগ্রহণ যেমন আজকের ঘটনা নয়, তার বীজ রোপণ করা আছে আর্যদের এদেশে প্রতিপত্তি স্থাপনের মধ্যেই, তেমনই পুরুষতান্ত্রিকতাও বর্তমান সমস্যা নয়। এর বীজ রোপণ করা হয়েছে সেই আদিকাল থেকেই। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারোর সময় সমাজে সাম্যবাদ স্থাপিত ছিল বলে মনে করেছেন অনেক ইতিহাসবিদই কিন্তু দেখা গেছে সেই সময় শ্রেণিগত বিভাজন ছিল সমাজের মধ্যে। নগর পরিকল্পনা থেকে তার অনুমান পাওয়া যায়। বৈদিক যুগ থেকে নারীদের অবস্থানের ক্রমে পতন ঘটেছে তার নজির পেয়েছি ক্ষিতিমোহন সেনের ‘প্রাচীন ভারতের নারীরা’ থেকে। এক সময় ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারী ও পুরুষের সম্পত্তির উপর ছিল সমান অধিকার, পরে তা পরিবর্তিত হয়ে নারীই হয়ে উঠল জমির সমান, সম্পত্তি, যা রক্ষা করার দায়িত্ব পুরুষের।

১৯৬২ সালে নূর আলম আলোচনা করেছেন নারীদের অধিকার সম্পর্কে। ভারতীয় সমাজে মহিলাদের প্রাথমিক অবস্থানই ছিল তাঁর আলোচ্য। তিনি আলোচনা প্রসঙ্গে দেখিয়েছেন, মহিলাদের যৌনতা আদিকাল হতেই এদেশে জমি বা ভূমির সঙ্গে সমতুল্য হিসাবে দেখা হয়েছে। জমির মালিকানাও পুরুষের হাতেই থেকেছে। সেই সঙ্গে মহিলা শরীর ও মহিলাদের অধিকারও ছিল পুরুষদের মুষ্টিবদ্ধ। পুরুষরা বুঝেছিলেন মহিলাদের যৌনতার সিদ্ধান্তকে নিজেদের অধীনে না নিয়ে এলে কোনওভাবেই তাঁদের ওপর ক্ষমতা কায়েম করা সম্ভব নয়। সেই আদি প্রথা আজও প্রচ্ছন্নভাবে চলে আসছে। কখনও রাষ্ট্র তো কখনও রাষ্ট্ররূপী পরিবার মেয়েদেরকে বলে দিচ্ছে তাঁর যৌনতা সংরক্ষিত তাঁর স্বামীর জন্যই।

বৈদিক যুগে দেখা গেছে, উচ্চবর্ণের মহিলা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নিম্নবর্ণের পুরুষকে বিবাহ করলে তার সামাজিক দণ্ড ছিল সাংঘাতিক, সেই বিবাহ থেকে সন্তান জন্ম নিলে মা এবং সন্তানকে ডুবিয়ে মারা হতো নদীগর্ভে। মহিলাদের পবিত্রতা সম্পর্কেও যোগসূত্র সেই যৌনতারই। জাতিগত শুদ্ধতা রক্ষার্থেই ব্রাহ্মণরা চালু করেছিল বাল্যবিবাহ। এই শুদ্ধতার সঙ্গে জমি বা ভূমির শুদ্ধতাকে সংযুক্ত করার রাজনীতি আজকের নয়। খুব সন্তর্পণে কেবলই নারীর যৌনতার উপর একচ্ছত্র অধিকার বজায় রাখার জন্য ব্রাহ্মণরা ভূমি বা প্রকৃতির সঙ্গে মহিলাদের বেঁধে দিয়েছিল সেই সময়।

প্রাচীন সাহিত্যে নারীদের অবস্থান: রামায়ণ পর্ব

নারীদের অবস্থান এ দেশিয় মহাকাব্যের মধ্যেও ধরা পড়েছে। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো ঐতিহাসিক মহাকাব্য তৎকালীন সমাজে মেয়েদের অবস্থান বিচারের আকর গ্রন্থ। নবনীতা দেবসেনের ‘উইমেন রিটেলিং মহাভারত’ প্রবন্ধে তিনি যখন মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চাইছেন চন্দ্রাবতীর রামায়ণকে, তখন ধরা পড়ছে একের পর এক পুরুষতান্ত্রিক প্রথা। অপহরণ করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিবাহ যেমন খুবই সাধারণ উদাহরণ ছিল এই সময়ের। নারীর সম্মতি বা ইচ্ছার যে কোনও স্থান ছিল না তা খুবই স্পষ্ট। এছাড়াও স্ত্রীকে আর্য পুরুষরা ত্যাগ করত এবং সেখান থেকে মহিলাদের নির্বাসিত, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের দিকটিও তুলে ধরেন নবনীতা। তিনি বারবার তুলে ধরতে চেয়েছেন, ব্রাক্ষণ্যবাদী ও আর্যবাদী সমাজে মহিলাদের যৌনতার কোনও স্বাধীনতাই আসলে ছিল না। পুরুষের ইচ্ছে, পুরুষের বাসনা চরিতার্থ করাই ছিল নারীদের একমাত্র পরিচয়, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে। নারী অন্য কোনও বলশালী পুরুষের দ্বারা অপহৃত হলে তাঁকেই শাস্তি পেতে হতো। নবনীতা বলছেন, যখন মেয়েরা রামায়ণ লিখছেন তখন তাঁদের উপর হওয়া দমন-পীড়নের দিকটি প্রকট হয়ে উঠে আসছে। মহিলা রচিত রামায়ণে রাম হয়ে যাচ্ছেন দুর্বল চরিত্রের একজন পুরুষ, মহিলারা রামের বর্ণনা করেছেন পাষণ্ড ও পাপিষ্ঠ বলে। অপর দিকে সীতাকে তাঁরা গড়ে তুলছেন বলিষ্ঠ ভাবে। যদিও তখনও সীতা একজন নির্যাতিতাই তবু সে সাহস দেখাচ্ছে নিজের উপর ঘটা অনাচার সম্পর্কে প্রকাশ্যে কথা বলার, বিচার চাওয়ার। ভারতীয় লোককথায় একটি উক্তি আছে, মেয়েরা যে ভাষাতেই কথা বলে তা একাকীত্বের ভাষা, দুঃখ-দুর্দশার ভাষা।

ব্রাহ্মণ্যবাদী সমাজ কাঠামো স্বামী-স্ত্রীর যে সম্পর্কের নিদর্শন রেখে গেছে তার ঝলক আমরা পাই রামায়ণেই। স্বামী সতীত্বের জন্য স্ত্রীর পরীক্ষা নেয়, অথচ পুরুষকে কোনও পরীক্ষা দিতে হয় না নিজের সততা প্রমাণ করার জন্য। যে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা, সেখানেও এই 'ঐতিহ্য' চলছে। একবার, নাবালিকা স্ত্রীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করার পরেও সুপ্রিম কোর্ট এক ব্যক্তিকে বেকসুর খালাস করে দেয়। প্রমাণ হিসাবে বিবাহ ও সন্তান উৎপাদনকে হাতিয়ার করে আদালত এবং আশ্চর্য বিষয় হলো মেয়েটির তরফেই দায় ছিল ধর্ষণের প্রমাণ জমা করার। এই ঘটনা কি সীতার অগ্নিপরীক্ষার সঙ্গে সাদৃশ্যমূলক নয়?

ভোলগা থেকে গঙ্গা পর্ব:

ভোলগা থেকে গঙ্গা উপন্যাসেও দেখা গেছে, দুই গোষ্ঠীর যুদ্ধের সময় পরাজিত গোষ্ঠীর নারীদের-সহ তাদের সমস্ত সম্পত্তি, জমি, গবাদিপশু, অস্ত্র, শস্য বিজিত গোষ্ঠী লুঠ করে নিয়ে আসত। অর্থাৎ আর্যবাদী সমাজেও নারী ছিল জমি, ফসল ও সম্পত্তির সমান, ধন-সম্পদের প্রতীক। অনেক সংস্কৃত কাব্যেই নারীকে ‘শ্রী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যা মূলত ধন-সম্পদ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। জাতিভেদ প্রথা নিম্নবর্গের পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে মেয়েদের জীবনে। ব্রাহ্মণ্যবাদের ফসল এই জাতিভেদ প্রথার একটি নিয়ম ছিল (প্রতিলোম) যেখানে উচ্চবর্ণের নারীর সঙ্গে নিম্ন বর্ণের পুরুষের বিবাহ থেকে সন্তান জন্ম নিলে, সেই মহিলাকে সন্তান সহযোগে নদীতে ডুবিয়ে মারা হত। জলপাত্র প্রথাও সেই নিম্নবর্গীয় নারীদের উচ্চবর্গের পুরুষদের শোষণের রূপেরই প্রতিনিধিত্ব করেছে সমাজের বুকে। এই প্রথা অনুযায়ী, বিত্তবান উচ্চবর্গীয় পুরুষ চাইলে একজন অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলাকে নিজের রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করা যেত, শারীরিক শোষণ চালানো যেত তার উপর। সেখানে সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তানের কোনও পিতৃমর্যাদা থাকত না। যে সময় দাঁড়িয়ে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষদের অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছিল, সেই একই সময় একই শ্রেণির মহিলাদের উপর শারীরিক শোষণ চালাতে পিছপা হয়নি উচ্চবর্গের মানুষরা।

আরও পড়ুন- দ্রৌপদী একা নয়! জানেন, এক নারীর বহুস্বামীর প্রথা কীভাবে এল বিশ্বে?

সম্পত্তি জনিত দমন-পীড়ন: সতীদাহ প্রথা

ভারতীয় সমাজকাঠামোর শুরুর দিকে সহমরণের কোনও দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়নি। ক্ষিতিমোহন সেনের লেখায় দেখা গেছে, ঋকবৈদিক ও তার পরবর্তী যুগে সহমরণ প্রথাটি সমাজে চালু করা হয় একেবারেই ক্ষমতা কায়েম করার জন্য। সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যাতে পুরুষের আধিপত্য বজায় থাকে তার জন্যই এমন ব্যবস্থার উৎপত্তি। আগে স্বামী মারা গেলে জীবিত মহিলা অন্য কোনও ব্যক্তিকে বিবাহ করে সন্তান উৎপাদন করবে এমন নিয়মই চালু ছিল আর্য সমাজের মধ্যে। বিবাহের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে আদি আর্য সমাজে বাল্য বিবাহের চল ছিল না, পরবর্তীকালে জাতিগত শুচিতা বজায় রাখতে ক্ষমতাশীল মানুষরা বাল্যবিবাহের প্রচলন চালু করে। এছাড়াও মহিলাদের নিজের পছন্দে বিবাহ করার রীতিও বিকৃত হয়েছে একই কারণে।

ব্রাহ্মণ মহিলাদের উপর দমন:

অন্ত্যজ শ্রেণির মহিলাদের পাশাপাশি ব্রাহ্মণ মহিলাদের উপরেও পুরুষতন্ত্রের প্রভাব ছিল বীভৎস। কুলীন প্রথা বা ব্রাহ্মণ পুরুষের বহু বিবাহ প্রথাকে কেন্দ্র করে সম্পত্তির জন্য বহু মহিলাকেই খুন হতে হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে অনেকেই। বৈধব্য পালনের মধ্য দিয়ে মহিলাদের যৌনতাকে দমন করা ও তাদের সমস্ত রকমের সামাজিক অধিকার ও ভূমিকা থেকে বহিষ্কার করে দেওয়ার প্রথা দেখা গেছে পরবর্তীকালে যার উৎস আবারও সেই সম্পত্তির মালিকানা। অনেকক্ষেত্রে কেবল সামাজিক অধিকারের দিক দিয়ে বিধবাদের শোষণ করা হতো তা নয়। পরিবারের মধ্যে তাদের শারীরিকভাবেও শোষিত হতে হতো।

আরএসএস ও বিজেপির শাসনে নারীর অবস্থান:

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আম্বেদকরের আইন, নারীবাদী আইন ভারতীয় সংবিধানের অংশ হলেও অবস্থা সেই একই। মহিলাদের সম্পত্তির মতোই রক্ষা করা, পরিবার ও স্বামীর সেবা ও সন্তান উৎপাদনই যে মহিলাদের প্রধান লক্ষ্য বর্তমান সরকার সেই বার্তা বহুভাবেই দিয়ে আসছে। গোলওয়ালকার নিজেও একথা লিখে গিয়েছিলেন যে, ঐতিহ্যময় ভারতীয় নারীর ভূমিকা স্বামী ও তার পরিবারের সেবা ও সন্তান উৎপাদন।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যে সব রাজ্যে বিজেপির সরকার সেই সব রাজ্যেই মহিলাদের উপর শোষণের হার বেশি। কর্ণাটকে এক নার্সকে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়ে যৌন হেনস্থা করার পর উচ্চবর্ণের ডাক্তার মহিলাকে জাত তুলে গালাগাল করেন। জঙ্গলের ১১ জন আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণ করে বেকসুর খালাস হয়ে যায় ২১ জন পুলিশকর্মী। রাজস্থানে আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণের পর জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। কিছুই নতুন নয়, কেবল পোশাক বদলেছে।ইতিহাসকে হাতিয়ার করে তুলে তা বিকৃত করে কেবলই নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধার স্বার্থে যেটুকু সমাজের উপর আরোপ করা যায় তাই চাপিয়ে দিয়ে এসেছে মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশীল মানুষ, আজও ব্যতিক্রম নেই। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ যাওয়া যেমন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, তেমনই মহিলাদের উপর পুরুষতন্ত্রের প্রকোপও হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা নয়। প্রগতিশীলতার মধ্যেও সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে এই প্রথা। মাঝেসাঝেই অনুঘটক পেলে তা জেগে ওঠে।

 

More Articles