বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো
Durgapuja 2022: রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর কন্যা প্রতিদিন বাড়ি সংলগ্ন বাগানে তাঁর বন্ধু পদ্মাবতীর সঙ্গে খেলত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, জমিদার বাড়ির কেউ পদ্মাবতীকে দেখেননি।
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো। শুধুই কি বাঙালির! দুর্গা পুজো তো সর্বজনীন। এই পুজো মানেই ‘বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্যের এক অমলিন ছোঁয়া’। বাঙালির উৎসব, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুর্গাপুজো। আর এখন দুর্গাপুজো মানেই প্রায় বারোয়ারি পুজো। অলিতে গলিতে শুধু থিমের লড়াই। তবে থিম আর বিজ্ঞাপনের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে এখনও কিছু বনেদি বাড়ির পুজো টিকে আছে শতাব্দী পেরিয়ে। কলকাতার পাশাপাশি জেলার পুজোগুলির সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে কিছু তাক লাগানো গল্প। তেমনই এক বনেদি বাড়ির পুজো হল হাওড়ার শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো। সাবেকিয়ানা এবং ঐতিহ্যের অপরূপ মেলবন্ধন এই পুজো। আনুমানিক ৩৪০ বছর ধরে চলে আসছে এই পুজো।
রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস
হাওড়া জেলার শিবপুরের রায়চৌধুরী বংশের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামব্রহ্ম রায়ের (মুখোপাধ্যায়) আদি বাসভূমি ছিল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার ব্যারাকপুর মহকুমার চানক মণিরামপুর। এঁদের সাবেকি বাড়ি পলতার জলাধার তৈরির সময় অবলুপ্ত হয়ে যায়। আবার ভিন্নমতে, এই বংশের একাংশ গোবিন্দপুর (ফোর্ট উইলিয়ামের আদি কেন্দ্রস্থল) গ্রামে বাস করতেন। আনুমানিক ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ জমিদার রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী পৈতৃক জমিদারির তেরোটি গ্রাম (শিবপুর, রামকৃষ্ণপুর, ব্যাতাইতলা, ভাসি, সলপ, নিবড়া, মাঝের হাটি, বাঁকড়া, গোদা, বেতড়, চামরাইল, নিতাঙ্কুর ও দেবীপাড়া প্রভৃতি) নিজের ভাগে পেয়ে শিবপুরে বসতি শুরু করেন। ‘হাওড়া জেলার ইতিহাস’ লেখক অচল ভট্টাচার্যের মতে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি) ফরমানে রায়চৌধুরীরা এই অঞ্চলের জমিদারির মালিক হন এবং ‘রাজা’ উপাধি পান। শিবনারায়ণ শাস্ত্রীর মতে, নবাব আলীবর্দীর (১৭৪০-৫৬ খ্রি) আনুকুল্যে হাওড়ার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্বত্ব পান রামব্রহ্মের পুত্র সুকদেব। সাত্ত্বিক রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী সংসারী হয়েও ব্রহ্মচারীর মতো জীবন যাপন করতেন। অনেকে মনে করেন, শিবপুরের বেত্রচণ্ডিকা মন্দিরটি রায়চৌধুরী বংশের পূর্বপুরুষদেরই প্রতিষ্ঠিত।
রায়চৌধুরী বাড়ির এক সদস্য অরুণবাবুর কথায়, তাঁদের প্রকৃত পদবি মুখোপাধ্যায়। তাঁরা আগে জমিদার ছিলেন। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে তাঁর পূর্বপুরুষরা লড়াই করেছিলেন। সে সময় মুর্শিদকুলি খাঁ সাহসিকতার পুরস্কার স্বরূপ তাঁদের ‘রায়চৌধুরী’ খেতাব দেন।
পুজোর ইতিহাস
রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো আনুমানিক কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। তবে নানা মতভেদ থাকলেও ১৬৮৫ সাল থেকে এই পুজো শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়। পুজো শুরু করেছিলেন রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। রায়চৌধুরী বাড়ির ঠাকুরদালানে শুরু হয় এই পুজোর।
আরও পড়ুন- তারকাদের মেলা! মুম্বইয়ের যে যে দুর্গাপুজোর গ্ল্যামার চোখ ধাঁধিয়ে দেয় আজও
কথিত আছে, একটা সময় এই পরিবার দেবী চণ্ডীর ভক্ত ছিল। রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরীর কন্যা প্রতিদিন বাড়ি সংলগ্ন বাগানে তাঁর বন্ধু পদ্মাবতীর সঙ্গে খেলত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, জমিদার বাড়ির কেউ পদ্মাবতীকে দেখেননি। প্রতিদিনই নিজের মেয়ের মুখ থেকে এই কাল্পনিক বন্ধুর কথা শুনে রামব্রহ্মের একদিন ইচ্ছে হল তাঁর সঙ্গে দেখা করার। মেয়েদের খেলার ফাঁকে একদিন তিনি নিজেই চলে যান পদ্মাবতীকে দেখতে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, রামব্রহ্ম পৌঁছনোর আগেই পদ্মা সেই স্থান ছেড়ে চলে যায়। আদতে পদ্মা বলে কেউ নেই, মনে মনে ভেবে নেন রামব্রহ্ম। কিন্তু বাগানের নরম মাটিতে সেই মেয়ের পায়ের ছাপ তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেয়। সেদিন রাতেই তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে তাঁর মেয়ের বন্ধু পদ্মা আর কেউ না স্বয়ং মা দুর্গা। বলা হয়, সেই থেকেই নাকি পুজোর শুরু।
আবার আরেক মতে, রাজা রামব্রহ্ম ছিলেন দেবী চণ্ডীর উপাসক। তিনি স্বপ্নাদেশ পান দুর্গাপুজো করার জন্য। সেইমতো রাজা রামব্রহ্ম তৎকালীন পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বললেন কারণ তিনি তো চণ্ডীর উপাসক। কী করে তিনি দুর্গাপুজো করবেন! এই ভেবেই মানসিক দ্বন্দ্বে পড়েন তিনি। কিন্তু তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছিলেন, দেবী দুর্গা তাঁকে বলছেন, তিনি দেবী চণ্ডীর আরেক রূপ। তখন স্বপ্নের মধ্যেই রামব্রহ্ম জিজ্ঞেস করেছিলেন, দেবী কতদিন তাঁর বাড়িতে থাকবেন। দেবী বলেছিলেন, “যতদিন তোর বংশধরেরা আমায় ভক্তিভরে ডাকবে ততদিন আমি এখানে আসব”। এরপর রামব্রহ্ম তাঁর সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে বাড়িতে মহাসমারোহে দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন।
মূর্তির বৈশিষ্ট্য এবং পুজোর রীতি-বিশেষত্ব
রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গা মূর্তি সাবেক তিনচালা ডাকের সাজের। সাঁজের আটচালায় মায়ের বোধন হয় মহালয়ার আগের নবমীতে। পুজো হয় প্রাচীন রীতিনীতি মেনে অর্থাৎ বৃহত্তর নান্দিকার মতে। বেলুড় মঠে এই রীতি অনুসরণ করেই পুজো করা হয়। দো-মেটে প্রতিমা সম্পন্ন হওয়ার পরে অঞ্চলের বহু ব্রাহ্মণ আমন্ত্রিত হন এই বাড়িতে। মায়ের মূর্তি দর্শন করে সেখানে কোনও ত্রুটি আছে কিনা তাঁরা তা দেখে নেন। নিখুঁত মূর্তির ছাড়পত্র পাওয়ার পরেই শুরু হয় চূড়ান্ত পর্বের মূর্তি গড়ার কাজ। এই বাড়িতে পুজোর জন্মলগ্ন থেকেই এই প্রথা চলে আসছে।
রায়চৌধুরী বাড়ির পুজোয় মূর্তির সামনে কোনও ঘট বাঁধা হয় না। ঘট বাঁধা হয় আটচালা সংলগ্ন একটি বেলগাছে। বেলগাছের জন্য একটি আলাদা ঘরও আছে। কথিত আছে, দুর্গা ওই বেলগাছের মধ্যে দিয়ে ধরাতলে নেমে আসেন। সেই জন্য ওই বেলগাছকে ঘিরেই রামব্রহ্ম দুর্গাপুজোর উপাসনা শুরু করেন। তবে প্রাচীন বেলগাছ অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়ে গেছে এখন সেখানে নতুন বেলগাছ লাগানো।
এই বাড়ির পুজোর আরেকটি রীতি হল পাঁঠাবলি। সেই প্রথা এখনও চালু আছে। সপ্তমীর দিন একটি এবং নবমীর দিন দুটো করে পাঁঠাবলি হয় এবং পুজোর সংকল্প করা হয় বাড়ির প্রবীণতম ব্যক্তির নামে। এই বাড়ির আরেকটি বড় রীতি হল, ব্যাতাইচণ্ডীর মুকুট এনে দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে ঠাকুর দালানে পুজো করা হয়। তারপর দুর্গার মাথার মুকুট দশমীর দিন ব্যাতাইচণ্ডীর মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ব্যাতাইচণ্ডীর পুরনো মুকুটটি ঠাকুরদালানের পাশে বেলগাছের তলায় রেখে দেওয়া হয়। দক্ষিণা কালী পুজোর সময় এই মুকুট বিসর্জন দিয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন- ধূম জ্বর গায়েই পুজো! বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় দ্বিতীয়বার রইতে পারেননি খোদ স্বামীজিই
পুজোর ভোগ
নবমীর দিন হোম সম্পন্ন হলে, হাঁড়িকাঠ উঠিয়ে বাড়িতে পংক্তিভোজনের আয়োজন করা হয়। এ ছাড়াও নানা রকম মিষ্টান্ন, ঘরে তৈরি নারকেল নাড়ু, বিভিন্ন রকম ফল থাকে ভোগ হিসেবে। দুর্গাকে প্রত্যেকদিন অন্নভোগ দেওয়া হয়, খিচুড়ি, ১২ রকম ভাজা, তরকারি, মাছ, পরমান্ন, মিষ্টি ও ভাত, এর সঙ্গে অন্যান্য পদ, মাছ ও বলির মাংস রান্না করে নিবেদন করা হয়। পুজোর দায়িত্বে থাকা অরুণ রায়চৌধুরী জানান, আগের মতো আড়ম্বর না থাকলেও এখনও যথেষ্ট নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতি বছর পুজো করে চলেছে রায়চৌধুরী পরিবার। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, অঞ্চলের বহু মানুষ ভিড় জমান শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো দেখতে। দশমীতে পুজোর শেষে পুজোর ঘট ও দুর্গার মুকুটের বিসর্জন হয় না। ওই মুকুট ও জলভরা ঘট চলে যায় অনতিদূরের ব্যাতাইচণ্ডীর মন্দিরে। বলা হয়, এই মন্দির রায়চৌধুরীদের পরিবারিক মন্দির।
এইভাবেই প্রাচীন রীতিনীতি মেনে মুঘল জমানার সাক্ষী শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির এই পুজো। থিমের পুজো আর বারোয়ারি পুজোর থেকে যদি অন্য দিকে একটু মন দিতে চান তাহলে বনেদি বাড়ির এই পুজো দেখতে যেতে পারেন। প্রাচীন আর আধুনিকতার এক মিশেল এই পুজো গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছে আজও।
কীভাবে যাবেন– হাওড়া স্টেশন থেকে মেদিনীপুর লোকাল ধরে রামরাজাতলা স্টেশন। তারপর টোটো করে মন্দিরতলার দিকে এগোলেই হিন্দু গার্লস স্কুল। সেখান থেকে ডানদিকের রাস্তা ধরে মিনিট খানেক এগোলেই দেখা মিলবে আটচালার দেবী দুর্গার।