দিনের পর দিন বিনিদ্র ডিউটি! চালক নাকি রেলকর্তৃপক্ষ, দুর্ঘটনার আসল দায় কার?

Kanchenjunga Express Tragedy: অনেকেই দুর্ঘটনার দায় ঠেলেছেন চালকের ঘাড়ে। কিন্তু সত্যিই কি দোষ দেওয়া যায় তাঁদের। সিগন্যালজনীত ত্রুটি, আনুষাঙ্গিক ভুল-ভ্রান্তির সঙ্গে যে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে যে বিষয়টি বারবার উঠে আসছে,...

কখনও করমণ্ডল তো কখনও লোকমান্য তিলক জ্ঞানেশ্বরী, কখনও বা গাইসাল। বারবার ভয়াল বিভীষিকাময় ট্রেন দুর্ঘটনা এসে কেড়েছে অসংখ্য প্রাণ। সেই তালিকায় দু'দিন আগেই নাম লিখিয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস। কার্যত গ্যাঁটের টাকা খরচ করে মৃত্যু কিনছেন যাত্রীরা, ভারতীয় রেলের পরিকাঠামো নিয়ে উঠে গিয়েছে তেমন অভিযোগও। ঠিক কী কারণে দুর্ঘটনা। কেন শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে এসে ধাক্কা মারল মালগাড়িটি। সিগন্যালের গণ্ডগোল নাকি চালকের গাফিলতি, দুর্ঘটনার নেপথ্যে আসলে রয়েছে কোন সত্য?

ইতিমধ্যেই দুর্ঘটনা নিয়ে একাধিক তথ্য সামনে এসেছে। রেলকর্মীদের একাংশের মতে, দুর্ঘটনার কবলে পড়া মালগাড়িটির চালক সিগন্যাল মানেননি। সেই কারণেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের লাইনে চলে এসেছিল মালগাড়িটি। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে তবে কি সিগন্যাল বিভ্রাটেই এত বড় দুর্যোগ? 

আরও পড়ুন: এনডিআরএফ আসতে ১ ঘণ্টারও বেশি দেরি! ইদ ফেলে উদ্ধারে ছুটে এসেছিলেন স্থানীয়রাই

কিন্তু রেলের একটি সূত্রের দাবি, সোমবার ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে রাঙাপানি এবং চটের হাট অংশের স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল অকেজো ছিল। যার ফলে ওই অংশে খুবই ধীর গতিতে ট্রেন চলাচল করছিল। বহু সময় ট্রেন থামিয়ে দেওয়াও হয় বলে খবর। সোমবার সকাল ৮টা ২৭ মিনিট নাগাদ শিয়ালদহগামী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস রাঙাপানি স্টেশন ছেড়ে এগোনোর পরই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল বন্ধ থাকায় খুব ধীর গতিতে কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস চলছিল। ওই ট্রেনের জন্য ছিল বিশেষ কাগুজে ছাড়পত্র। রেলের পরিভাষায় যাকে ‘পেপার লাইন ক্লিয়ার টিকিট’(পিএলসিটি) বলে।

রেলের ওই সূত্রের দাবি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে রাঙাপানি স্টেশনের স্টেশনমাস্টার ‘টিএ ৯১২’ ফর্ম দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশের ভিত্তিতেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস চালাচ্ছিলেন চালক। কী এই ‘টিএ ৯১২’? স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ হয়ে গেলে ওই নির্দেশের ভিত্তিতেই ট্রেন চালিয়ে থাকেন চালক। সিগন্যাল লাল থাকলেও যার ফলে নিয়ন্ত্রিত গতিতে ট্রেন চালাতে পারবেন চালক। সকাল ৮টা ৪২ মিনিট নাগাদ রাঙাপানি স্টেশন থেকে ছাড়ে মালগাড়িটি। তার পরই কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের পিছনে সজোরে ধাক্কা মারে। খেলনাগাড়ির মতো মালগাড়ির উপর উঠে পড়ে এক্সপ্রেসের পিছনের দিকের একাধিক বগি। লাইনচ্যুত হয় মালগাড়িও।

প্রশ্ন উঠছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসকে যখন ম্যানুয়াল মেমো দেওয়া হল, তখন মালগাড়ি কী ভাবে এগিয়ে গেল? তাকেও কি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছিল? রেলের একটি সূত্রের ব্যাখ্যা, ধরা যাক দু’টি ট্রেনের চালককেই ম্যানুয়াল মেমো দেওয়া হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী, ওই ছাড়পত্র থাকলে চালক ট্রেন ধীরে ধীরে চালাবেন। ট্রেনের গতি কখনওই ঘণ্টা প্রতি ১০ কিলোমিটারের বেশি থাকবে না। তা হলে কাঞ্চনজঙ্ঘা এবং মালগাড়ির মধ্যে ১৫ মিনিটের ব্যবধান থাকার পরেও কেন একই লাইনে কাছাকাছি চলে এল দু’টি ট্রেন? উঠেছে সেই প্রশ্নও।

শুধু কাগুজে সিগন্যালের ব্যাপারটিই নয়। উঠেছে আরও একাধিক প্রশ্ন। অনেকেই দুর্ঘটনার দায় ঠেলেছেন চালকের ঘাড়ে। কিন্তু সত্যিই কি দোষ দেওয়া যায় তাঁদের। সিগন্যালজনীত ত্রুটি, আনুষাঙ্গিক ভুল-ভ্রান্তির সঙ্গে যে দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে যে বিষয়টি বারবার উঠে আসছে, তা হল লোকো পাইলটদের শারীরিক ক্লান্তি। নিয়ম অনুযায়ী, ৮-১০ ঘণ্টা মালগাড়ির লোকো পাইলট পরিষেবা দিতে পারেন। অর্থাৎ একটানা গাড়ি চালাতে পারেন। কিন্তু রেল দফতরে কর্মীর অভাব। ফলে একজন লোকো পাইলটকে বাধ্য করা হচ্ছে ১৬-১৭ ঘণ্টা একটানা রেক চালাতে। শীতের সময়ে শারীরিক ক্লান্তি সামলানো তবু খানিকটা সম্ভব। কিন্তু এই গরমের দিনে তা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তাদের পক্ষে। ফলে যা ঘটবার তা-ই ঘটছে। বহু সময়ই চোখ লেগে যাচ্ছে তাদের। শরীর খারাপ হওয়ার ফলে বহু সময়েই দায়িত্ব ঠিকমতো সামলাতে পারছেন না তাঁরা। আর তার ফলে যা হওয়ার তা-ই ঘটছে। তার মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ যাত্রীদের, যাঁরা ভারতীয় রেলকে ভরসা করে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠেছেন।

আরও পড়ুন:রিল তৈরিতেই ব্যস্ত! রেলের কবচের ব্যবস্থা কেন করতে পারলেন না রেলমন্ত্রী অশ্বিনী?

এমন নয়, এ সবকিছু হচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষের চোখের আড়ালে। এ বিষয়টি রেল মন্ত্রক এবং রেল বোর্ডের কাছে বারবার উত্থাপন করা হলেও, লোকো পাইলট নিয়োগের ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ। ফলে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। রেলের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, মালগাড়ির গতিবেগ ছিল ১০০-১১০ কিলোমিটার। ক্রসিং পেরিয়ে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে মালগাড়িটি। তখনও গতিবেগ ১১০ কিলোমিটার ছিল বলেই জানা গিয়েছে। কিন্তু কীভাবে সিগন্যাল ফেল করলেন চালক? আর সেই প্রশ্নের উত্তরটা বুঝতে বোধহয় তেমন অসুবিধা হয় না। সোমবার কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের ওই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০। আহত অন্তত ৪০। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন রেলের দুই কর্মীও। এই দুর্ঘটনার অভিশাপ আর কদ্দিন। একদিকে প্রধানমন্ত্রী যখন বন্দে ভারত থেকে শুরু করে বুলেট ট্রেনের উপর জোর দিয়ে চলেছেন, ততই খারাপ হচ্ছে সাধারণ ট্রেনের পরিকাঠামো। এই নিয়ে কবে নড়েচড়ে বসবেন কর্তৃপক্ষ? কবে ফিরবে যাত্রীসুরক্ষা? প্রশ্ন বোধহয় থেকেই যায়!

 

More Articles