চোখ বনাম ক্যামেরা।

কখনও ভেবে দেখেছেন আমাদের চোখ দিয়ে আমরা কীভাবে দেখি? এত রং, এত আকাশ, এত চেনা অচেনা মুখ সব সব কীভাবে দেখতে পাই আমরা? তবে কি আমাদের চোখ ও আসলে ক্যামেরার মতন?

বিভিন্ন দিক দিয়ে দেখতে গেলে আসলে আমাদের চোখ অনেকটা ক্যামেরার মতনই। মানুষের চোখ মানুষকে পৃথিবীকে দেখতে সাহায্য করে নিজেদের নার্ভ সিস্টেমে বিভিন্ন ধরণের প্ররোচনা প্রেরণ কোরে। আমাদের চোখ আর আমাদের মস্তিষ্ক একসাথে কাজ করলে তবেই আমরা ঠিক করে দেখতে পাই। যাদের চোখ আর মস্তিষ্কের তালমিল ঠিক থাকে না তারা ঠিক ভাবে দেখতেও পায় না। চোখের সামনে দিয়ে হুশ করে পাখি উড়ে যায় কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে চোখের তালমিল না থাকায় দেখতেই পায় না। মানুষের চোখের সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্কের ইভলিউশন লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। আমাদের চোখ আসলে একটা ক্যামেরার মতনই সব সময় ছবি তুলতে থাকে। আমাদের চোখ এমন একটা ক্যামেরা যে যা দেখে তারই ছবি তোলে। আর সেটা জমা করে রাখে স্মৃতি হিসাবে।

আসুন জেনে নেওয়া যাক চোখ এবং ক্যামেরার মধ্যে মিল এবং অমিল গুলো।

  • মিল:

একটা চোখ এবং ক্যামেরা দুজনেরই লেন্স থাকে এবং থাকে আলো সংবেদনশীল পৃষ্ঠতল বা সারফেস। আমাদের চোখের Iris নিয়ন্ত্রণ করে কতটা আলো আমাদের চোখের ভিতরে ঢুকবে। তারপর চোখের লেন্স সাহায্য করে সেই আলোর মাধ্যমে ফোকাস করতে। চোখের ভিতরের রেটিনাই হলো আলো সংবেদনশীল পৃষ্ঠতল বা Light-Sensitive Surface যা চোখের একদম পিছনের অংশে বর্তমান। রেটিনা আমার যার দিকেই তাকিয়ে থাকি তার ছবি তুলতে থাকে এবং সেই ছবি পাঠাতে থাকে আমাদের মস্তিষ্কে এবং অপ্টিক নার্ভ সিস্টেমে। এবং অবশেষে মস্তিষ্ক আমাদের বুঝতে সাহায্য করে আমরা কিসের দিকে তাকিয়ে আছি। এভাবেই মানুষ দেখতে পায়।

উল্টোদিকে ক্যামেরার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় এক। প্রথমে আলো ক্যামেরার লেন্সের পৃষ্ঠতলে ধাক্কা খায়। ক্যামেরার অ্যাপারচার সিদ্ধান্ত নেয় কতটা আলো সে ক্যামেরার ভিতর পাঠাবে। এরপর সেই আলো আলো সংবেদনশীল পৃষ্ঠতলে পৌঁছায় যেটাকে একসময় আমরা ক্যামেরার রিল বা ফিল্ম বলে চিনতাম কিন্তু এখন তা পরিবর্তিত হয়ে এই পৃষ্ঠতল চিপে রূপান্তরিত হয়েছে।

রেটিনা, রিল কিংবা সেন্সর চিপ এই সব ধরণের আলো সংবেদনশীল পৃষ্ঠতলে একটা জিনিস ভীষণ সাদৃশ্যজনক আর সেটা হলো এরা প্রত্যেকেই যে কোনও বস্তুর উল্টো প্রতিকৃতি সৃষ্টি করে। এবার আপনি ভাববেন উল্টো প্রতিকৃতি সৃষ্টি করলে আমরা সোজা দেখি কী করে? কেন মানুষকে মাথা নিচু করে হাঁটতে দেখি না বা কেন দেখিনা গাছের কান্ড ওপরে ডালপালা নীচে? কারণ আমাদের মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্ক এই সময়েই সাহায্য করে চোখ কে। আমাদের মস্তিষ্ক জানে পৃথিবী সোজা হয়ে থাকে, উল্টো ভাবে নয়। তাই আমাদের মস্তিষ্ক সমস্ত উল্টো ছবিকে সোজা করে দেয়। ডিজিটাল ক্যামেরাতে এই পদ্ধতি নিজে নিজে করার জন্য প্রোগ্রাম সেট করাই থাকে। আর নন ডিজিটাল ক্যামেরায় একটা প্রিজম বা কাঁচ লাগানো থাকে যাতে উল্টো ছবি আবার সোজা হয়ে ফেরত আসে।

  • অমিল :

দুভাবে চোখ আর ক্যামেরার অমিল খুঁজে বার করা যায়। ১. ছবির দিকে তাকিয়ে ফোকাস করা এবং ২. রং প্রসেস করায়।

আমাদের চোখের ভিতরের লেন্স নিজের আকার পরিবর্তনে সম্ভব যখন সে কোনও চলন্ত বস্তুর দিকে তাকায় যাতে সে ফোকাসড থাকতে পারে বস্তুটির ওপর। মানুষের চোখের লেন্সের থিকনেস এর ও পরিবর্তন ঘটে এই প্রক্রিয়ায়। মানুষের চোখ এই কার্য্য নিজে নিজে করতে সক্ষম কারণ মানুষের চোখের লেন্স ছোট ছোট মাসেল বা মাংসপেশির সাথে যুক্ত যা নিজে নিজে ছোট বা বড় করে নিতে ওয়ারে নিজের আকার।

উল্টোদিকে একটি ক্যামেরার লেন্স এই কর্মকান্ড করতে সক্ষম নয়। যার জন্যই ফটোগ্রাফারদের বারবার লেন্স চেঞ্জ করতে হয় ছবির বিষয় অনুযায়ী, দূরত্ব অনুযায়ী।

এরপর আসি রং প্ৰসেস করার প্রক্রিয়ায় কীভাবে মানুষের চোখ এবং ক্যামেরা আলাদা। আমাদের চোখের রেটিনার দুই ধরণের ছবি রিসেপ্টর আছে যথা রডস এবং কোনস। রোডস আমাদের কম আলোয় দেখতে সাহায্য করে, এ আমাদের রং চিনতে সাহায্য করে না। উল্টোদিকে কোনস আমাদের রং চেনাতে সাহায্য করে। তিন ধরনের কোনস থাকে আমাদের চোখের ভিতর। এরা বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বা ওয়েভ লেংথ এ আলাদা আলাদা আচরণ করে। লাল কোনস বড় ওয়েভ লেংথ এ সারা দেয়, নীল সারা দেয় ছোট ওয়েভ লেংথে এবং সবুজ কোনস সারা দেয় মিডিয়াম ওয়েভ লেংথে। যখন আমাদের মস্তিষ্ক কোনস এর বিভিন্ন সম্মেলন কে চালু করে দেয় তখন আমরা পৃথিবীকে রঙিন দেখি।

অপরদিকে ক্যামেরার ও ছবি রিসেপ্টর আছে, কিন্তু সেটা কেবল এক ধরণের। মানুষের মতো রোডস এবং কোনস নেই ক্যামেরার।

  • আর কী কী ভাবে মানুষের চোখ ক্যামেরার থেকে আলাদা? :

যেহেতু ক্যামেরার লেন্সের সমস্ত জায়গায় ফটো রিসেপ্টর আছে তাই ক্যামেরা সবসময়ই একটা ছবিকে পুরোপুরি দেখতে পায়। কিন্তু মানুষের চোখে ব্লাইন্ড স্পট থাকে। ব্লাইন্ড স্পট মানে যে পয়েন্টে আমাদের অপ্টিক নার্ভ রেটিনার সাথে যুক্ত হয়। মানুষের চোখের এই পয়েন্টে কোনও ফটো রিসেপ্টর নেই। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই আমরা আমাদের চোখের ব্লাইন্ড স্পট চিহ্নিত করতে পারি না। কারণ যখন আলো একটা চোখের ব্লাইন্ড স্পটে এসে পড়ে তখন আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের অন্য চোখ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এই শূন্যস্থান পূরণ করে দেয়। ক্যামেরার ক্ষেত্রে যেহেতু গোটা লেন্স জুড়ে ফটো রিসেপ্টর আছে তাই তাদের কোনও ব্লাইন্ড স্পট নেই।

এ তো গেল মিল এবং অমিল। কিন্তু স্রষ্টার সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব এর দিক দিয়ে বিচার করলে মানুষের চোখের থেকে আশ্চর্য্যজনক ক্যামেরা বোধহয় আর হয় না। লক্ষ্য মাইল দূরে থাকা মৃত তারার আলো এসে আমাদের চোখে ঠিকরে পড়ে মুহূর্তেই। চাঁদের বুড়ির কালো কালো দাগ দেখতে পাই কোনও এক্সট্রা লেন্স ছাড়াই। নিশুতি পাহাড়ী উপত্যকায় কোনও গভীর রাতে একলা বসে খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই ছায়াপথ। এসবের যে কী অপরিসীম মায়া তা ক্যামেরায় কই। তাছাড়া ক্যামেরা বড্ড যান্ত্রিক, বন্ধ করলেই অন্ধ হয়ে যায়। এদিকে চোখের একটা ভারী অদ্ভুত ব্যাপার আছে, তাকে বন্ধ করলে, সে স্বপ্ন দেখায়...

 

রেফারেন্স : https://letstalkscience.ca/educational-resources/stem-in-context/eye-vs-camera

More Articles