Honor killing: অন্য ধর্মে প্রেম মানেই খুন! হায়দ্রাবাদের ঘটনা যে যে প্রশ্ন তুলছে...

"আমার রাজুকে ওরা ট্র্যাফিক সিগন্যালে, সবার সামনে মেরে ফেলল। আমি সবার পায়ে পড়েছি, কিন্তু কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল না। কেন কেউ সাহায্য করল না?"


প্রশ্নটা সৈয়দ আশরিন সুলথানার। তাঁর স্বামীকে হায়দ্রাবাদের ব্যস্ত রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর দোষ? তাঁরা পরস্পরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন এবং ছেলেটির ধর্ম ইসলাম নয়, এবং সে একজন দলিত পরিবারের ছেলে। ভারতে আরও একজন শিকার হল ধর্মীয় অন্ধত্বের, আরও একবার দেশ সাক্ষী থাকলো অনার কিলিং এর।

বিল্লিপুরম নাগারাজুকে এগারো বছর ধরে চেনেন সুলথানা। স্কুলে পড়েছেন একসঙ্গে, তখন থেকেই বন্ধুত্ব এবং দশম শ্রেণি থেকে প্রেম। কিন্তু ধর্মীয় কারণে নাগারাজুকে মেনে নেয়নি সুলথানার পরিবার। এমনকী, নাগারাজু সুলথানার মাকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাঁরা রাজি হননি।

আরও পড়ুন: ভারতে গণহিংসার সম্ভাবনা ঠিক কতটা, কেন সিঁদুরে মেঘ দেখছে আন্তর্জাতিক মহল?

সুলথানা বিপদ আঁচ করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর পরিবার এই সম্পর্কের এতটাই বিরোধী যে, তাঁদের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
"আমি রাজুকে বলেছিলাম যে, আমি ওকে বিয়ে করব না। আমি কাউকেই বিয়ে করে ওর বিশ্বাসভঙ্গ করব না। আমি এভাবেই বেঁচে থাকব। বিয়ের আগে প্রায় দু'মাস আমি ওর সঙ্গে কথা বলিনি (উনি ভেবেছিলেন এতে তাদের সম্পর্কে ছেদ পড়বে)। আমি ওকে বলেছিলাম, আমার জন্য ওর প্রাণ চলে যেতে পারে। ও যেন অন্য কাউকে খুঁজে নেয়। কিন্তু ও এটা শুনে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর আমি ওকে বিয়ে করি।"

পুলিশ দুই মূল অভিযুক্ত, সুলথানার দুই ভাই, সৈয়দ মোবিন আহমেদ এবং মহম্মদ মাসুদ আহমেদকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে।

সিসিটিভি-তে দেখা যাচ্ছে, রাত ন'টা নাগাদ হায়দ্রাবাদের সারুরনগরের রাস্তায় এই দু'জন স্কুটারে করে যাচ্ছিলেন। তখনই দুই মূল অভিযুক্ত তাঁদের রাস্তা আটকায় এবং রাজুকে লোহার রড দিয়ে মারতে শুরু করে। রাজুর হেলমেটের ওপর দিয়েই তার মাথায় রড দিয়ে মারতে থাকে তারা, তারপর ছুরি দিয়ে তাঁকে কোপাতে থাকে সৈয়দ মোবিন আহমেদ। অন্যদিকে রাজুর মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য অপর অভিযুক্ত মাসুদ রাজুকে ক্রমাগত রড দিয়ে আঘাত করতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা সেই স্থান থেকে পালিয়ে যায়। এই পুরো ঘটনাটা যখন ঘটে, তখন রাস্তায় অনেক মানুষই ছিল, কিন্তু তারা ব্যতিক্রমী কোনও কাজ করেনি। তারা ঘটনাটা তাদের ফোনের ক্যামেরাতে যত্ন করে তুলে ধরেছে। অভিযুক্তরা অস্ত্র দিয়ে যে নৃশংসতা দেখিয়েছে, তাতে আমজনতা দর্শকের ভূমিকার বাইরে কিছু করার কথা ভাবেনি। যদিও অস্ত্র না থাকলেও কিছু না করার উদাহরণ দেশে আছে প্রচুর। 

পুলিশ জানাচ্ছে, সুলথানার আত্মীয়রা জানুয়ারিতে দু'জনের বিয়ের পর থেকেই এদের খুঁজছিল। সুলথানা এবং রাজু সেই কারণেই শহর ছেড়ে বিশাখাপত্তনমে চলে যান, এবং ঘটনার এক সপ্তাহ আগে ফিরে আসেন। কোনওভাবে সেই খবর সুলথানার পরিবারের লোকজনের কাছে চলে যায় এবং বুধবার তারা দম্পতিকে একটি মারুতির শোরুমের সামনে দেখতে পেয়ে যায়।

পুলিশের দাবি, তাঁরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুই অভিযুক্তকে পাকড়াও করেন এবং রড, ছুরি সব বাজেয়াপ্ত করে নেন।

"আমরা ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে এই মামলা দাখিল করব যাতে এর দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এবং অভিযুক্তেরা কঠিনতম সাজা পায়," জানাচ্ছেন ডিসিপি এলবি নগর জোন সুনপৃত সিং। সেই সঙ্গে জানাচ্ছেন যে, সরকার মৃতের পরিবারকে আর্থিক সাহায্যও করবে।

পুলিশ দু'জন অভিযুক্তকে পাকড়াও করলেও সুলথানার দাবি, এই ঘটনায় আরও তিনজন জড়িত আছেন।

২৬ বছর বয়সি রাজু মালা সম্প্রদায়ভুক্ত। যাদের তফসিলি জাতির অন্তর্ভুক্ত করা হয় তেলেঙ্গানায়। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনায় রাজনীতির রং লেগেছে এবং বিরোধী দল বিজেপি সরকারকে আক্রমণ করা শুরু করেছে। জয় শ্রীরাম স্লোগানে মুখরিত হয়েছে হায়দ্রাবাদ। তারা এই ঘটনায় সরকারকে ব্যর্থ বলে অভিযোগ করে দ্রুত অভিযুক্তের শাস্তি চেয়েছে।

এবার একটু তথ্য ঘাঁটা যাক। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, শুধু ২০১৭ থেকে ২০১৯-এর মধ্যেই ১৪৫টি এরকম ঘটনা ঘটেছে। আবার একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি পত্রিকার রিপোর্ট বলছে, শুধু ২০১৫-তেই দেশে ২৫১ জন খুন হয়েছেন অনার কিলিং-এ। ২০০৬-এ সুপ্রিম কোর্ট এই ধরনের ঘটনাকে 'বর্বর' আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, সংবিধানের উনিশ এবং একুশতম ধারা অনুযায়ী দেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকার এবং জীবনের অধিকার থাকলেও তা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট কড়া আইনের এখনও অভাব রয়েছে। নতুন আইন প্রণয়ন অবিলম্বে প্রয়োজন, কিন্তু তেলেঙ্গানার বিরোধী দল, যারা কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন, তারা লাভ জিহাদ আইনের প্রণয়ন এবং প্রয়োগে বেশি উৎসাহী। দু'টি মানুষের মিলন রুখতে তাদের যতটা তৎপরতা, ততটা দু'টি মানুষের জীবন রক্ষা করতে নয়।

ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর নথি বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা ২৪টি। কিন্তু ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫১-তে। পাঞ্জাব, রাজস্থান, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশ এই তালিকায় শীর্ষে।

খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, দেশের সরকার জাতপাতের এই ঘৃণ্য রাজনীতিকে রুখতে কতটা ব্যর্থ। যে-দেশে এখনও জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট হয়, যে দেশে অস্পৃশ‍্যতা এখনও প্রবলভাবে বিরাজমান, সেই দেশে অনার কিলিংও যে বন্ধ করতে সরকারের সদিচ্ছা থাকবে না, তা বলাই বাহুল্য।

পশ্চিমবঙ্গও এরম ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। রিজওয়ানুরের হত্যার বিরুদ্ধে, সেই হিংসাত্মক ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা বিরোধী নেত্রী আজ দশ বছর হল এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তিনিও কি রাজ্যের হিংসা কমাতে সক্ষম হয়েছেন? একজন নারী হয়েও তিনি পিতৃতান্ত্রিক সমাজের পচে যাওয়া আগ্রাসন থেকে নারীদের রক্ষা করতে পারঙ্গম হয়েছেন কি? প্রশ্ন থেকেই যায়।


দেশে নাগারাজুদের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের মানুষের অভিভাবকরা দেখছেন কি? 


More Articles