আজ পাশে সবাই, কেন তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন মহম্মদ শামি?

ICC ODI World Cup 2023, Mohammed Shami: ২০১৫ সালের বিশ্বকাপের অনেকদিন মাঠছাড়া ছিলেন শামি। সেই সময়টা তাঁকে চেপে ধরে হতাশা। বারবার মাথায় ঘুরত আত্মহত্যার চিন্তা।

১৯৮৩ ও ২০০৭। ক্রিকেটের ইতিহাসে দুটি উল্লেখযোগ্য বছর। বিশ্বকাপ জয়ের সেই গৌরবময় দিন কি ফিরবে আর ভারতের? দেশের মাটি থেকে ২০২৩-র আইসিসি বিশ্বকাপ কি ঘরে তুলতে পারবে টিম ইন্ডিয়া। সেই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মিলবে আগামী ১৯ নভেম্বর, আমেদাবাদের মোতেরা তথা নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে। অস্ট্রেলিয়া না সাউথ আফ্রিকা, সেদিন চূড়ান্ত ম্যাচে কার সঙ্গে মুখোমুখি হবে ভারত, তা ঠিক হবে বৃহস্পতিবার। তবে সেই প্রশ্নটার জায়গাই থাকত না, যদি না টিম ইন্ডিয়ার কাছে এমন একজন বোলার থাকত! সেই মহম্মদ শামি, যে বুধবারের সন্ধ্যায় ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে নক্ষত্রের মতোই জ্বলজ্বল করেছেন। দিনের শুরুতেই বড় রানের লক্ষ্যমাত্রা নিউজিল্যান্ডের সামনে হাজির করেছিল টিম ইন্ডিয়া। তবে শামি যদি একা হাতে সাত-সাতটি উইকেট না নিতেন, তা হলে সত্যিই এতটা সহজ ফাইনালে ভারতের জায়গা করে নেওয়া?

এ প্রশ্নের উত্তর সহজ। যে উত্তর বুধবার সন্ধ্যায় দিয়ে দিয়েছিল হাততালির কোলাহল, ক্রিকেটপ্রেমীদের মুগ্ধতা। সেই শামি, যার ক্রিকেট কেরিয়ার তো বটেই, ব্যক্তিগত জীবনেও যথেষ্ট উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে বারংবার। খেলায় ময়দানে কোণঠাসা হয়েছেন, দাম্পত্য জীবন খাদে। তার পরেও ঘুরে দাঁড়ান শামি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যে ঘুরে দাঁড়াতে হয়, তা প্রমাণ করে দিয়েছেন বারবার। ২০২৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপে শীর্ষ উইকেট-শিকারিদের দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন শামি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনও ম্যাচে সর্বাধিক উইকেটের মালিক হওয়ার খেতাবও উঠে গিয়েছে শামির মাথায়। ভারতের তৎকালীন ফাস্ট বোলার জাহির খান ও জাভাগল শ্রীনাথের ৪৪টি উইকেটের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছেন নির্দ্বিধায়। তাঁর ঝুলিতে উইকেট সংখ্যা এখন ৪৫। আর তা মাত্র ১৪ ইনিংস বল করে।

আরও পড়ুন: দলের জয়-পরাজয়ে ক্রিকেট বোর্ডের কী এসে যায়? বারবার বিপর্যয়ের দায় কার

এই সেই মহম্মদ শামি। যাকে হতাশা চেপে ধরেছে বারবার। বার তিনেক আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন। ভয়ে ২৪ তলার ফ্ল্যাটে শামিকে একা ছাড়তেন না পরিবারের লোকেরা। পাছে খারাপ কিছু একটা করে বসে ছেলে, পাছে ঝাঁপ দেয়। সেখান থেকেও যে ফিরে আসা যায়, শুধু ফিরে আসাই নয় নক্ষত্রের মতো সমস্ত আলো শুষে নেওয়া যায়, শিখিয়েছেন শামি।

জন্ম উত্তরপ্রদেশের এক কৃষক পরিবারে। বাবা তৌসিফ আলির চার সন্তান। ছোট থেকেই এই ছেলেটির খেলাধুলার প্রতি টান ছিল চোখে পড়ার মতো। হাতেখড়িটা হয়েছিল বন্ধুদের সঙ্গে গলি ক্রিকেট দিয়েই। তবে জীবনের প্রথম ক্রিকেট ম্যাচে কিন্তু বোলার হিসেবে নয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেই নজর কেড়েছিলেন শামি। জীবনের প্রথম ম্যাচেই ১৪ বার বল বাউন্ডারি লাইনের বাইরে উড়িয়ে দেওয়ার রেকর্ড ক'জন ক্রিকেটারের আছে, বলা শক্ত। সেই থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ঝোঁক। প্রথমে ক্লাব স্তরে খেলেছেন, পরে বাংলার হয়ে রাজ্যদলে এবং সেখান থেকে সোজা জাতীয় দলে খেলার সুযোগ। খুব সহজেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন শামি।

আসলে বাড়িতে একটা ক্রিকেট খেলার আবহ ছিল। একবার নাকি দাদাদের দলে এক ব্যাটসম্যান কমতি পড়ে। শেষমুহূর্তে শামিকে দলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন দাদা। বলেছিলেন, টেনিস বলে যেমন নির্ভয়ে ব্যাট চালাতেন শামি, ঠিক তেমনটাই করতে। শুধু শরীর থেকে জড়তা কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। তেমনটাই তো করে গিয়েছেন শামি। জীবনের ওই প্রথম ম্যাচে কিংবা বুধবারের সেমিফাইনাল ম্যাচে। কার্যত জীবনের প্রতিটি ম্যাচেই জড়তা ভেঙে খোলস ভেঙে উঠে দাঁড়িয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের এই পেসার। ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন সমস্ত নিন্দুকদের।

কিছুদিন আগেই দাম্পত্য পৌঁছয় আদালতের চৌকাঠে। শামি এবং তাঁর স্ত্রী হাসিন জাহান নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। তাঁদের ডিভোর্স ও মামলা ছিল জোর আলোচনার বিষয়। ২০১৪ সালে হাসিন জাহানকে বিয়ে করেন শামিম। সেই সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে অচিরেই। ২০১৮ সালে সন্তান-সহ নিজের খোরপোষ চেয়েমামলাও করেন হাসিন। ব্যক্তিগত জীবনের সেই টানাপড়েনের মধ্যেই আবার তার হিরুদ্ধে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ ওঠে। বিসিসিআই-এর সঙ্গে শামির চুক্তিও নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগে পর্যন্ত স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। ঘরে-বাইরে প্রায় সর্বোত্র কোণঠাসা হয়েছেন শামি প্রায় একই সময়। শেষমেশ সেই ফাঁড়াও কাটে। সেই বছরই নির্দোষ সার্চিফিকেট নিয়ে আইপিএল খেলেন তিনি দিল্লি ডেয়ারডেভিলসের হয়ে।

২০১৫ সালের বিশ্বকাপের অনেকদিন মাঠছাড়া ছিলেন শামি। সেই সময়টা তাঁকে চেপে ধরে হতাশা। বারবার মাথায় ঘুরত আত্মহত্যার চিন্তা। সেসময় যে বাড়িটিতে শামি থাকতেন, সেই আবাসনে তাঁর ফ্ল্যাটটি ছিল ২৪ তলার উপরে। পরিবারের মানুষ ভয় পেতেন, যদি কিছু করে ফেলেন শামি। সেই চেষ্টাও করেছেন বার তিনেক। তার পরেও তিনি ফিরেছেন জীবনের ময়দানে। একাধিক বার এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচের আগে ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যার্থ হয়ে বাদ পড়েন। বারবার ব্রাত্য হয়ে পড়ার পরিস্থিতি থেকেই ঘুরে দাঁড়িয়ে ময়দানে ফেরেন তিনি। তিনিই যে ভারতের নতুন 'কামব্যক ম্যান'। কোনও অবস্থাতেই নিজের উপর বিশ্বাস হারাননি তিনি। নিজেকে ফিট প্রমাণ করতে পরিশ্রম করেছেন অনর্গল। ফিরেওছেন শেষপর্যন্ত। নিজেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে তিনিই যোগ্যতম।

আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ইতিহাসে প্রথম ‘টাইমড আউট’! ২২ গজের এই বিশেষ নিয়ম সম্পর্কে জানেন?

আত্মহত্যার চিন্তা থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে বিশ্বকাপের ম্যাচে সাত-সাতটি উইকেট শিকারের যে সফর, তা সহজ ছিল না কোনওকালেই। আজও সহজ নয়। কারণ বাইশগজের যুদ্ধ হোক বা জীবন, তোমার কদর ততক্ষণই, যতক্ষণ তুমি তোমার সেরাটা দিয়ে ছিনিয়ে আনতে পারছো জয়। সে জন্য শামিকে নিয়ে আজও কথা হচ্ছে। না, তাঁর তলানিতে ঠেকা দাম্পত্য নিয়ে নয়। ক্রিকেটের ময়দানে তাঁর ফিটনেস নিয়েও কথা বলছেন না কেউ। ভারতীয় ক্রিকেট যেন খুঁজে পেয়ে গিয়েছে তাঁদের নতুন নায়ককে। যাকে কখনও ধর্ম নিয়ে, কখনও দাম্পত্য নিয়ে, কখনও বা ম্যাচ গড়াপেটার মিথ্যা অভিযোগের কাঁটায় বিদ্ধ করা হয়েছে বারবার। তবে শামি জানেন, রাস্তায় প্রতিপদে বিছিয়ে থাকা কাঁটাকে কীভাবে গুলবাগিচায় পরিণত করতে হয়। তাই বারবার তিনি হেরে গিয়েও বাজি জিতে যান। বুঝিয়ে দেন, এই বাইশ গজের যুদ্ধে তিনিও সিকন্দর।

More Articles