বিসর্জনের সেকাল ও একাল
পুজো আসছে, পুজো আসছে, পুজো আসছে - এর থেকে ভালো অনুভূতি মনে হয় কিছুই হয় না। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে মন। ভোরবেলায় শিউলিফুলের গন্ধ, সারাদিনের মেঘের ভেলা ভাসানো শরতের নীল আকাশ, রাস্তার ধারে ফুটে থাকা সারি সারি কাশ ফুল মায়ের আগমনী বার্তা পৌঁছে দেয় আমাদের অবধি। আমরা পরম আনন্দে অপেক্ষা করি, দিন গুনি পুজো আসার। সারা শহর জুড়ে পড়ে হোর্ডিংয়ের হিড়িক, বাঁশ বাঁধা শুরু হয় মণ্ডপে মণ্ডপে, মানুষের ঢল নেমে আসে শপিং মল, গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেটের অলিতে গলিতে। তারপর একদিন পুজো এসে যায়। এক পলকে কেটে যায় ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী। মনে হয় এর মধ্যেই পুজো শেষ হয়ে গেল? এই তো খানিকক্ষণ আগেই...
তারপর আসে দশমী, মায়ের বিসর্জনের দিন। ঢাকির ঢাকে বেজে ওঠে বিসর্জনের সুর। বিষাদ ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে। জননী কাতর এ বসুন্ধরার চোখ ভিজে যায় নিঃশব্দে। 'বলো দুগ্গা মাই কি, জয়',
'আসছে বছর আবার হবে, বছর বছর হবেই হবে', 'ঠাকুর থাকবে কতক্ষন, ঠাকুর যাবেই বিসর্জন' জয়ধ্বনির মাধ্যমে ঠাকুর এগোতে থাকে গঙ্গার দিকে। একটা শহরকে বিষণ্ণতায় ডুবিয়ে দিয়ে উমা এগোয় কৈলাশের দিকে। ওপারে তার স্বামী মহাদেব অপেক্ষা করে আছেন যে নিজের পরিবারের। মায়ের ঠোঁটে লেগে থাকে সন্দেশ, সে সন্দেশ সিঁদুর খেলার সিঁদুরে লাল। মাকে গঙ্গার বুকে ভাসিয়ে দেওয়ার মুহূর্তে বাঙালি চোখ ভেসে যায় জলে। 'আবার এসো মা, সাবধানে যেও', মনে মনে এটুকু আওড়াতে আওড়াতে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকে মায়ের কাঠামোর দিকে। গঙ্গাবক্ষে আস্তে আস্তে ডুবে যায় মায়ের কাঠামো।
'পুজো আসছে, পুজো আসছে', করতে করতেই পুজো শেষ। ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে গঙ্গার পারে দাঁড়িয়ে থাকে বাঙালিরা। তেত্রিশ কোটি দেব-দেবী, তবু মায়ের বিসর্জনের মতো কই অন্য কেউ তো ছুঁতে পারে না! বাগবাজার, নিমতলা, কদমতলা, রানি রাসমনি, বাবুঘাটে মানুষের ঢল নামে বিসর্জনের বেলায়। একে একে ঠাকুর আসে কলকাতার বড় বড় পুজো মণ্ডপ থেকে, বনেদি বাড়ি, রাজ বাড়ি, সাধারণ বাড়ির পুজো মণ্ডপ থেকে। শেষ বেলায় মাকে আরেকটু দেখে নেওয়ার লোভে গঙ্গার পার ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বাঙালি হৃদয়। যুগযুগ ধরে, এই চিত্রের বদল হয় না কোনও।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা, ১৯১৫ সালের ছবি ‘প্রতিমা বিসর্জন’ মনে হয় সবারই দেখা। আলো আঁধারীতে মেশানো দশমীর রাত। মশালের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত উত্তর কলকাতার চওড়া রাস্তা। বিসর্জনের ঢল নেমেছে বিশাল উঁচু মাতৃ প্রতিমাকে ঘিরে। শোভাযাত্রা বেরিয়েছে, তার আগে দেবীর বরণ সম্পন্ন হচ্ছে। মশালের আলো এসে পড়েছে সংলগ্ন দোতলা বাড়ির ঝুল-বারান্দায়। সেখান থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বিসর্জন দেখছে বাড়ির অন্তঃপুরের মহিলারা। তারা বাহিরমহলে এসেছে। সমসাময়িক নবজাগরণে আচ্ছন্ন কলকাতার পরিবর্তিত চিত্র-ও তুলে ধরে এ ছবি। এ বিখ্যাত ছবির বয়স পেরিয়েছে ১০০ বছরের বেশি। সেকালে মায়ের বিসর্জনের ছিল বিভিন্ন নিয়ম কানুন। কোথাও নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল, কোথাও ছিল কামান দাগার নিয়ম, কোথাও বন্দুক তরবারী এবং অজস্র প্রহরী নিয়ে সারা হতো বিসর্জনের পালা। সময়ের সাথে সাথে বদলেছে সেসব নিয়ম কানুনের রীতি-রেওয়াজ, তবু এখনও বিভিন্ন বনেদি বাড়ির বিসর্জনের নিয়ম আলাদা আলাদা।
শোভাবাজার রাজবাড়ির একসময় ব্রিটিশদের সঙ্গে সখ্য ছিল বেশ ভালো। প্রায় ৪০ জন বাহক মিলে, কামান দেগে, নীল কণ্ঠ পাখি উড়িয়ে বিসর্জনের পালা সাঙ্গ হতো। এখন আর সেসবের কিছুই হয়না। শোলার নীলকন্ঠ পাখি বানিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে গ্যাস বেলুনের সাহায্যে আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
বসুমল্লিক বাড়ির পুজোয় পুজোর প্রত্যেকদিনই সিঁদুরখেলার আয়োজন হয়। তবে ব্যবহৃত হত দেবী চণ্ডীর মেটে সিঁদুর এবং দুর্গার লাল সিঁদুরের সংমিশ্রণ। এই বাড়িতে মায়ের বেনারসি সযত্নে খুলে নেওয়া হয় বিসর্জনের আগে। বাড়িতে নতুন বউ এলে তাকে পরতে দেওয়া হয় সেই বেনারসি। এই বাড়িতেও পূর্বে নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর চল ছিল যা বর্তমানে আর হয় না। এ ছাড়াও বিসর্জনের পর এই বনেদি বাড়িতে পাঁঠার মাংস রান্না করে খাওয়ার চল আছে।
ঠনঠনিয়ার লাহা বাড়িতে দশমীর দিনও অঞ্জলির আয়োজন করা হয়। বেলপাতায় দুর্গানাম লেখেন বাড়ির পুরুষরা। বিসর্জনের প্রহরে প্রতিমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই বন্ধ হয় বাড়ির সদর দরজা। ভাসান শেষে ফিরে এসে বাড়ির পুরুষরা বাইরে থেকেই ডাক দেন, ‘মা ভেতরে আছেন?’ অন্দরমহল থেকে 'হ্যাঁ' উত্তর দেন বাড়ির মহিলারা। তিনবার এই প্রশ্ন উত্তরের পালা চলার পর খোলা হয় মূল দরজা। বাড়ির মধ্যেই প্রতিষ্ঠা করা সিংহবাহিনীর মূর্তি থাকার কারণেই এই রীতি বছরের পর বছর ধরে মেনে আসা হচ্ছে লাহা বাড়িতে। এই বাড়িতে সারা বছরই মায়ের বাস।
জোড়াসাঁকোর নরসিংহ চন্দ্র দাঁ বাড়ির পরিবার ভাগ হয়ে যাওয়ায় শিবকৃষ্ণ দাঁ এর থেকে পৃথক পুজোর আয়োজন করে নরসিংহ দাঁ পরিবার। বন্দুকের ব্যবসা থাকায় দেবীর বিদায়বেলায় গান স্যালুট দেওয়ার চল ছিল শুরু থেকেই। সেই সঙ্গে পরে যোগ হয়েছিল কামান দাগার রীতিও। কাঁধে করে প্রতিমা নিরঞ্জনে নিয়ে যাওয়ার সময় হত শোভাযাত্রা। সামনে মশাল হাতে পথ দেখাতেন লাঠিয়ালরা। পিছনে বন্দুক, তরবারি নিয়ে অজস্র প্রহরী। বাড়ির সামনেই ৭ বার ঘোরানোর পর শুরু হত সেই যাত্রা। গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বিশমণি নৌকোয় মাঝগঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হত প্রতিমা। তারপর নিরঞ্জন। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় এবং ভাসানের ঠিক পরেই দুটি নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত। এখন আর আয়োজন সম্ভব হয় না এসবের। তবে শোভাযাত্রাটি হয়, গর্জায় কামানও। কিন্তু বন্ধ হয়েছে মশালের ব্যবহার।
জঙ্গলঘেরা কোন্নগরের ঘোষাল বাড়ির বিসর্জন এখন দিনে দুপুরে সারা হয়। এককালের ব্যাঘ্রভীতির ফল। সেইসময় হ্যাজাক জ্বেলে দশমীর রাতে হইহই করতে করতে বিসর্জনে যেত গ্রামবাসীরা। শোনা যায় তখন একবার বাঘে টেনে নিয়েছিল একজনকে। তারপর থেকেই সময়-ক্ষণ বদলেছে।
দক্ষিণ গড়িয়ার বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পুজোতে দেবীর বরণ পদ্ধতি একটু অদ্ভুত এবং সবার থেকে আলাদা। এই বাড়িতে তাঁর তিন সন্তান, অসুর এবং বাহনদেরও বরণ করা হয়। শুধু ব্রাত্য থাকেন লক্ষ্মী। মানা হয় তিনি বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মেয়ে। দেবী বিদায় নিলেও লক্ষ্মী প্রতিমা নারায়ণদেবকে নিয়ে থেকে যান বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে। রয়েছে সিঁদুরখেলারও রীতি। তবে এ বাড়িতে দু’দিন হয় সিঁদুরখেলা। দশমীর পাশাপাশি অষ্টমী তিথিতেও খেলায় মাতেন বাড়ির মহিলারা। দেবীর নিরঞ্জনের পরই মাকড়চণ্ডীর পুজো দেন পরিবারের সদস্যরা।
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে বিসর্জনের নিয়মকানুন বদলেছে অনেক। তবে যা এখনও একচুলও বদলায়নি তা হল দুর্গাপুজোর জন্য বাঙালির আবেগ। যা সেকালেও যা ছিল আজও তাই। এখনও বিসর্জনের দিনটা এলে বাঙালির মন কেঁদে ওঠে, পেঁজা তুলোর মেঘের মতো বিষাদ ভেসে আসে মনের আকাশে। আবার দিন গোনা শুরু হয়, গঙ্গার পার ছেড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমরা মনে মনে বলে উঠি, 'সাবধানে যেও মা। পরের বছর আবার এসো...'