অ্যাংলোদের স্বপ্নে চিরতরে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল দেশভাগ

Partition and Anglo Indians: ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পঞ্জাবে ৬০০০-৮০০০ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষ ছিল বলে জানা গেছে। গোল বাঁধে এই সময়েই।

লর্ড মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা অনুযায়ী তখন চলছে হিন্দু-মুসলিমের দেশভাগ। দেশভাগ। রক্তাক্ত স্মৃতির ইতিহাস। দেশ, ভিটেমাটি, কাছের মানুষ, খুব যত্ন করে জমিয়ে রাখা সাধের জিনিস- সব ছেড়ে দিয়ে একদল মানুষ আসবে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে। আরেকদল যাবে ওপারে। দেশভাগ, পরিচয় হারিয়ে যাওয়ার গল্প। আবার নতুন পরিচয় তৈরির আখ্যান।

তবে যে সম্প্রদায়ের ছিল না কোনও নিজস্ব জাতি-পরিচয়, এতদিন ধরে ভারত ভূখণ্ডে থেকেও যাদের তৈরি হয়নি কোনও নিজস্ব মুলুক, তাদের কী অবস্থান স্থির হয়েছিল এই দেশভাগের নকশায়? সমবেত ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে যখন এক প্রান্তিক জাতি মরিয়া, তখন কি তাদের মাথাতেও এসে পড়েছিল আরেক বিপর্যয়? যাতে কোনওদিনই আর তৈরি হয়নি তাদের সমবেত ইতিহাস বা মুছে গেছিল যেটুকু ছিল, তার খানিকটাও?

সে জাতি দেশভাগের মধ্যেও স্বার্থপরের মতো খুঁজে চলেছিল তাদের নিজের দেশ। লিখেছিল,

“... যেহেতু পাক ভূখণ্ডে অন্য (সংখ্যালঘু) জাতিগোষ্ঠীরও আশ্রয় মিলবে তাই এই হিন্দু কর্তৃত্ববাদের হাত থেকে খানিক মুক্তি মিলবে আমাদের।”

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দেশভাগের গল্প বেশিরভাগটাই আবর্তিত হয়েছে লাহোর এবং পঞ্জাব- এই দু'টি শহরকে ঘিরে। গান্ধিজির অসহযোগ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে দেশ তখন উত্তাল। এক জাতি এককাট্টা হয়ে মেতে উঠেছে দেশমাতৃকার মুক্তির নামে। 'করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে'। নিজের দেশের নামে ঝরবে রক্ত! কিন্তু এই জোরালো রাজনৈতিক চেতনার কতটা প্রভাব পড়েছিল অ্যাংলো জনগোষ্ঠীর মধ্যে?

অন্যদের মতে, দেশজুড়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে ‘খানিকটা পিঠ বাঁচিয়ে চলেছিল অ্যাংলো সম্প্রদায়’। এর জন্য ভূমিপুত্রদের থেকে জুটেছিল ধিক্কার, অবজ্ঞা। কিন্তু কেন তাদের মধ্যে তৈরি হতে পারেনি রাজনৈতিক চেতনা? প্রথমত, ধর্মে খ্রিস্টান হলেও তারা ববাররই নিজেদের তফাতে রেখেছিল ভারতীয় খ্রিস্টানদের থেকে। তাই দেশিয় খ্রিস্টান সংগঠনগুলির রাজনৈতিক চিন্তাধারার সঙ্গেও যুক্ত হতে পারেনি তারা। আবার ঔপনিবেশিক ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে যেতেও দিশেহারা হয়েছিল।

প্রথমে আসি পঞ্জাবের চিত্রে।

আরও পড়ুন- ব্রিটিশদের ‘বর্জ্য’! খড়গপুর রেল কলোনিতে মুছে গেছে অ্যাংলো জীবনের ঘ্রাণ

লাহোর-পঞ্জাব ছিল উত্তর-পশ্চিম রেলওয়ের প্রাণকেন্দ্র। আর রেলশহর মানেই ক’ঘর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের বাস। লাহোরেও একসময় বসবাস করেছে অনেক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তারা রেল কলোনি, পোস্ট অফিস, স্কুল ও হাসপাতালে কাজ করত। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পঞ্জাবে ৬০০০-৮০০০ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মানুষ ছিল বলে জানা গেছে। গোল বাঁধে এই সময়েই। পঞ্জাব আর লাহোর প্রদেশ আলাদা হয় হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের ভাগ ধরে। পঞ্জাব প্রদেশে থেকে গেল কিছু মুসলিম এবং অন্যদিকে হিন্দু ও শিখ মানুষরা। জাতিগত অপ্রদর্শন শুরু হয় এইখান থেকেই। ন্যুব্জ সম্প্রদায়ের নথিভুক্তকরণ হয় না কোনও ইতিহাসেই। নাগরিকত্বের প্রাথমিক প্রমাণ এই সরকারি নথিভুক্তকরণ। তাই এদের ইতিহাস মুছে ফেলা ছিল বরাবরই খুব সোজা।

অবশেষে ১৯৭০ সাল থেকে প্রান্তিক সম্প্রদায় হিসেবে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নথিভুক্তকরণ হতে থাকে। অনেকে আবার এদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হিসাবে না দেখে ‘ঔপনিবেশিক বা বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী’ হিসাবেও দেখতে চেয়েছেন। কারণ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অভাবের জন্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে বরাবরই ছিল গোষ্ঠীচেতনার অভাব। কিন্তু পঞ্জাবের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা আবার খানিকটা একত্রিত হতে চেয়েছিল দেশভাগের রাজনীতির মধ্য দিয়েই। ঠিক একই কারণে রাজনৈতিক সমচেতনা জেগে উঠেছিল বর্মার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে, যখন বর্মদেশ আলাদা হয় ভারতবর্ষের থেকে।

অথচ পঞ্জাবের দেশভাগের ইতিহাসে খুব কষ্ট করেই খুঁজে পাওয়া যায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের। ইয়াসমিন খান তাঁর কাজে দেখিয়েছেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ‘স্যুইপিং প্ল্যান’ (জুন, ১৯৪৭) যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বা সংখ্যাগরিষ্ঠ শিখ সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষা করেছিল- তাতে একেবারেই ধুয়ে মুছে গেছিল ‘অস্পৃশ্য, খ্রিস্টান ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান’-দের মতো ছোট সম্প্রদায়গুলি। কিন্তু কোনওমতেই দেশভাগের নীরব দর্শক ছিল না তারা। দেশভাগের পরবর্তী প্রভাব আলোচনা করতে বসলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নাম উঠে আসবেই। জাতীয় স্তরের রাজনীতিতে আবার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নাম উঠে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। তাদের অনেকেই সদিচ্ছায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে রাজি হয়েছিল। তারা ছিল সুশৃঙ্খল, মাথায় ছিল ‘আদর্শ ইংল্যন্ড’-এর স্বপ্ন। সেই আশাতেই নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ হয়েছিল তারা। ঠিক যেমনটা নিজের দেশ গড়ে নিতে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল অখণ্ড ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলিম মানুষ।

এ যেন দেশভাগের পরিচিত গল্পকে ছাপিয়ে এক অন্য সংখ্যালঘু স্বাধীনতাকামী মানুষের গল্প। স্বল্প রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠী এসময় বানিয়ে ফেলে দু'টি লীগ। জন অ্যাবোটের নেতৃত্বে ‘অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এম্পায়ার লীগ’(১৯১৯ সালে যার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় সর্বভারতীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংগঠন) ও ‘কলকাতা লীগ’। এই দু'টি লীগের মধ্যে দ্বন্দ্ব চললেও বেশিদিন টেকে না। জন অ্যাবোটকে অপসারণ করেন তৎকালীন ডেপুটি হেনরি গিডনি। যিনি দুই দশক ধরে ছিলেন ‘সর্বভারতীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংগঠন’-এর সভাপতি। গিডনি ছিলেন সেইসময়ের নামকরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রাজনীতিবিদ, যাঁর নেতৃত্বে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রাজনৈতিক চেতনার অনেকখানি উন্মেষ হয়। তিনি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের জন্য বিশেষ কিছু সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেছিলেন। বুঝেছিলেন, বাণিজ্যিক ভারতে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা বিশেষ উন্নতি করতে পারেনি। তাই তারা ভীষণভাবে সরকারি চাকরির উপর নির্ভরশীল। তাই একান্ত প্রয়োজন সংরক্ষণ। ব্যাবসা বাণিজ্যে বিশেষ নিযুক্ত না হতে পারায় এবং সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ কমে আসায় ত্রিশের দশকে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক দারিদ্র দেখা যায়। নতুন ধরনের পেশার বাজারে খুব একটা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারেনি তারা। লর্ড ল্যয়ড একে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ‘অর্থনৈতিক ম্যাগনা কার্টা’ বলে উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুন- ডার্ক লিপস্টিক, ছোট স্কার্ট! অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে মানেই যৌন উন্মাদনা?

১৯৪২ সালে স্যর হেনরি গিডনি মারা গেলে ‘সর্বভারতীয় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সংগঠন’-এর সভাপতি হন ফ্রাঙ্ক অ্যান্থনি। অধিবেশনে তিনি বলেন,

“আমরা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান জনজাতি কিন্তু আমাদের মনে রাখা উচিত আমরা ইন্ডিয়ান। আমাদের কাগুজে নাগরিকত্বের পরিচিতি- আমরা ভারতীয় এবং আমরা এর পরেও ভারতীয়ই থাকব তাই অ্যাংলো নামের অর্থ টিকিয়ে রাখার থেকে এখন আমাদের ভারতীয় পরিচিতির গুরুত্ব বেশি অনুধাবন করা উচিত”।

এই একই উত্তর পাওয়া গেছে কলকাতার তরুণ প্রজন্মের অ্যাংলো মানুষদের থেকেও। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে গেলে তাদের বেছে নিতেই হবে কাগজের ইন্ডিয়ান পরিচিতি।

ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্থনি বরাবরই দেশভাগের বিপক্ষে কথা বলেছিলেন। তাঁর সমর্থন ছিল জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা খুব বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিল। অঞ্চলভেদে তাদের জাতি বা সংস্কৃতিগত মিল খুঁজে পাওয়া ছিল এমনিতেই কঠিন। তাই দেশভাগ তাদের আরও বিচ্ছিন্ন করবে এবং সর্বভারতীয় রাজনীতিতে তাদের কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। ১৯৪৫-এ ‘স্যপ্রু কমিশন’-এর নথিতে দেশভাগের বিপক্ষে তিনি চারটি কারণ দেখিয়েছিলেন-

এক, হিন্দুদের জন্য ভারত এবং মুসলিমদের জন্য পাকিস্তান নির্মিত হলে কোনওদিনই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মতো সংখ্যালঘুদের সমস্যা মিটবে না।

দুই, মুসলিম লীগের স্পষ্টত বিরোধিতা করে তিনি লিখেছিলেন, এই পরিকল্পনা ভারতকে টুকরো টুকরো, ছোট ছোট ভাগে ভেঙে ফেলবে।... এতে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান খুব দুর্বল হয়ে পড়বে।

তিন, ভারতভূমি ইওরোপের থেকে আলাদা। এদেশে বরাবরই বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতি একত্রিত হয়ে মিশেছে। তাই ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে এই ভূখণ্ডকে ভাগ করলে সকলকেই খুব খারাপ ফল ভোগ করতে হবে।

চার, সংকীর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হলে আজীবন এই দু'টি দেশের মধ্যে লড়াই চলতে থাকবে। এই কথাগুলি থেকে অ্যান্থনির স্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। কাজেই যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বরাবরই দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল ব্রিটিশ প্রশাসনের স্তাবক হিসেবে, তারা যেন এবারে ভারতভূমিতেই তৈরি করতে চাইল নিজের দেশ।

মুসলিম লীগের সঙ্গে তাঁর বিরোধিতা চরমে যায় ১৯৪৫-এর সিমলা অধিবেশনের সময়। তিনি এদের বিচ্ছিন্নতাকামী রাজনৈতিক দল হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি জানান, অন্য সমস্ত দল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের অবস্থানকে স্বীকৃতি দিলেও শুধুমাত্র বিরোধিতা করছে মুসলিম লীগ।

আবার অন্যদিকে, ডরোথি মেকম্যানামিন দেখিয়েছেন, লাহোরের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা খানিক স্বস্তিতে ছিল পাক ভূখণ্ড নির্মাণের খবর শুনে। তাদের মতে, ইসলাম ধর্মে জাতবৈষম্য কম হিন্দুদের চেয়ে। আবার লাহোর মুসলিমরা খানিক সহিষ্ণু ছিল হিন্দু বাদ দিয়ে অন্য মিশ্র জাতির মানুষদের প্রতি। পাকিস্তানে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের শুধুমাত্র ‘অ্যাংলো’ বলে নথিবদ্ধ করা হচ্ছিল। এ সময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ও শিখদের রাখা হয়েছিল ‘বাপশি সিদ্ধ’। পঞ্জাবের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের এক নেতা সি.ই গিব্বন লিখেছেন (১৯৪৭) পাকিস্তানের কিছু অ্যাংলো হঠাৎ করে ‘অ্যাংলো-মুসলিম’ হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন- ম্যাকল্যাস্কিগঞ্জ, অ্যাংলো স্মৃতিবেদনার এক হারিয়ে যাওয়া শহর

আবার মেকম্যানামিন দেখিয়েছেন, যে ধর্মীয় বিভেদের সূত্র ধরে ভারত-পাকিস্তান ভাগের কথা ভাবা হয়েছিল, সেই হিংসার কবলে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের পড়তে হয়নি। শ্রেণিহিংসার আগুনে তখন জ্বলছে দেশ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক হিংসার যে বীজ বপন করা হয়েছিল তাতে দুই দেশই মেতেছিল গৃহযুদ্ধে। শান্তিপ্রিয় অ্যাংলো- ইন্ডিয়ানরা কিন্তু এই হিংসায় বিশেষ সাড়া দেয়নি বরং তারা তখনও ছিল ব্রিটিশ শাসনের অনুগত। আদর্শ ইংল্যান্ডের ধারণা মেনে তারা সেনাবাহিনী, রেল, পরিবহন ও মিশনারি স্কুল, হাসপাতালে নিরন্তর সেবা দিয়ে চলেছিল। এরকমই একজন নার্সের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়,

“...ভারতের উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই একে অন্যকে আক্রমণ করছিল। আমি একদিন গাড়িতে উঠেছিলাম হাসপাতাল যাওয়ার জন্য। সেই পঞ্জাবি গাড়িওয়ালা ভালো মানুষই ছিলেন। দাঙ্গা বাঁধতে দেখে গাড়িওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাড়ি চলে যান বলে নিজে এক জায়গায় লুকিয়ে পড়েন। আমাদের ভয় না থাকার কারণ হিসাবে তিনি আমাদের গলার ক্রস-নেকলেসের দিকে আঙুল দেখান। ‘আপনাদের ধর্মের প্রতি ওদের কোনও রাগ নেই’। তবে সেই দাঙ্গা আমাদের সম্প্রদায়কে নিয়ে না হলেও আমাদের ওপরে এর প্রভাব একেবারেই পড়েনি তা নয়। আঁচ এসে পড়েছিল আমাদের বসতিতে, সংস্কৃতিতে। গোটা দেশজুড়ে একটা থমথমে ভয়ের আবহ। দোকান-বাজার যাওয়ার সময়, বা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মাঝে মাঝেই দাঙ্গাবাজরা তুলে নিয়ে যেত। তবে আমাদের সম্প্রদায়ের কাউকে কখনও তুলে নিয়ে গেছে বলে শুনিনি। বোধহয় সত্যিই, আমাদের সেই ক্রস-নেকলেসই আমাদের বাঁচিয়ে নিয়েছিল। তবে দাঙ্গার আঘাত এসে লেগেছে আমাদের গায়েও। সেসময় সব মিশনারি হাসপাতালে আমাদের ফ্রি-তে চিকিৎসার ব্যবস্থাও ছিল।”

আবার এমনও তথ্য পাওয়া যায়, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে পড়শি মুসলিমরা এসময় আশ্রয় পেয়েছিলেন অ্যাংলো বাড়িতে। তাদের বাড়িতে তল্লাশি নিত না দাঙ্গাকারীরা। মেকম্যানাইনের এক উল্লেখে পাওয়া যায়, “..রাওয়ালপিণ্ডি ক্যান্টনমেন্টের বাসিন্দা বেটি ডয়াল অস্থির হয়ে পড়তেন নিকটবর্তী বাজার থেকে চিৎকার শুনে। কারণ সেসময় মারা যাচ্ছিল তারা পরিচিত মানুষরা”। দেশভাগের দাঙ্গায় আহত মানুষকে আশ্রয় দিতে সক্রিয় হয়েছিল বহু অ্যাংলো চার্চ।

দেশভাগের গ্লানির ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়েই কোথাও বেরিয়ে আসে এক নতুন আত্মীয়তা তৈরির গল্প। এক নতুন পরিচিতি ও সমবেদনার গল্প। যে অসহায় জাতি দিক-বিভ্রান্ত খুঁজে বেড়াচ্ছিল নিজেদেরই পরিচয়, তারা যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কঠিন সময়ে। ফ্র্যাঙ্ক অ্যান্থনির উদ্বেগ যেন অ্যাংলো স্বার্থকে ছাপিয়ে এক সমবেত ভারতের উদ্বেগ। ‘স্যুইট হোম’ তৈরি হয় না তাদের এখনও। দেশভাগ তাদের চিরকালীন গৃহসুখের স্বপ্নে আরেক বড় ক্ষতচিহ্ন এঁকে দেয়। চিরতরের জন্য। হারিয়ে যাওয়া জনজীবন পঞ্জাবি গাড়িওয়ালার উপদেশমতো এক মলিন ক্রস-নেকলেসকে আঁকড়ে ধরে স্বস্তি খোঁজে নিয়মিত প্রার্থনায়।

More Articles