মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্নের অপমৃত্যু! 'হর ঘর তিরঙ্গা'-র আলোয় অন্ধকারে রয়ে গেলেন খাদি শিল্পীরা
পলিয়েস্টারে তৈরি পতাকায় মুখ ঢেকেছে দেশ। মার খেয়েছেন খাদি শিল্পীরা। কাজেই প্রশ্ন হলো, এই উৎসবের অংশ কি তাঁরা নন?
হর ঘর তিরঙ্গা। কেন্দ্রের এই কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে মেতে উঠেছিল দেশ। নিজেকে দেশপ্রেমিক প্রমাণ করার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে কে চায়? তাই মূল্যবৃদ্ধির ছ্যাঁকা দূরে সরিয়ে রেখে দোকানে দোকানে কয়েক দিন ধরে ছিল পতাকা কেনার লাইন। বলাই বাহুল্য 'এই পতাকা রাষ্ট্র নয়’। কেন্দ্রের সংশোধনীতে আজ ব্রাত্য খাদি শিল্প। অথচ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে এই শিল্পের যোগ নিবিড়। পলিয়েস্টারে তৈরি পতাকায় মুখ ঢেকেছে দেশ। মার খেয়েছেন খাদি শিল্পীরা। কাজেই প্রশ্ন হলো, এই উৎসবের অংশ কি তাঁরা নন?
পলিয়েস্টার এবং মেশিনে তৈরি জাতীয় পতাকা তৈরির অনুমতি দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভারতের পতাকা কোড সংশোধন করে। স্বাধীনতার পর থেকে জাতীয় পতাকা খাদির কাপড়ে তৈরি হতো। অর্থাৎ, হ্যান্ডপন তুলা, সিল্ক বা উলের সুতো থেকে হাতে বোনা হতো। সাম্প্রতিক এই সংশোধনীটি আনা হয়েছে, যাতে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে হর ঘর তিরঙ্গা কর্মসূচির আওতায় পতাকা সহজলভ্য হয়।
১৯৪৭ সালের সাড়ে সাত দশক পর খাদির পরিবর্তে পলিয়েস্টার এবং মেশিনে তৈরি পতাকার ব্যাপক উৎপাদন এবং ব্যবহার ভারতীয় টেক্সটাইলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বস্ত্রশিল্প আমাদের অর্থনীতির একটা বড় অংশ দখল করে আছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারত যে নীতি গ্রহণ করেছে, তা লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ উৎপাদনকারীকে বিপদে ফেলেছে। পরিবেশকে ধ্বংস করেছে। ফ্ল্যাগ কোডের সংশোধনটি টেক্সটাইল সেক্টরের উন্নয়নকে কতটা এগিয়ে নিয়ে গেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর প্রথম কারণটি হলো, পাওয়ারলুম। ফ্র্যাব্রিক তৈরির মেশিনগুলির ব্যবহার বিপুল সংখ্যক তাঁত ও খাদি শিল্পীদের জীবিকায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।
আরও পড়ুন: তিরঙ্গা নয়, তার নাম ছিল ‘কলকাতা পতাকা’, জাতীয় পতাকার যে ইতিহাস রয়ে গেছে আড়ালে
টেক্সটাইল সেক্টরের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় অর্থাৎ, সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তুলোর পরিবর্তে পলিয়েস্টারের দ্রুত অগ্রগতির সুবিধে। এটা তুলো চাষীদের প্রভাবিত করেছিল এবং হস্তচালিত তাঁতি, যাঁরা বেশিরভাগই তুলো নিয়ে কাজ করতেন তাঁরাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। এককথায় এই যুগল উন্নয়ন লক্ষ লক্ষ গ্রামীণ শ্রমিককে আরও দরিদ্র করেছে। কারণ পলিয়েস্টারের অগ্রগতি।
খাদির তাঁতিরা কী বলছেন?
খাদি তাঁতি অ্যাসোসিয়েশন-সহ অনেকেই এই সংশোধনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন অনেকদিন ধরেই। কর্নাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ দেশজোড়া আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। তাদের বক্তব্য, স্বাধীনতা দিবসের প্রেক্ষিতে ২ থেকে ৪ কোটি পতাকার অর্ডার তারা পেয়ে থাকে, কিন্তু সংশোধনের সৌজন্যে এ-বছর তা ভয়ংকরভাবে তলানিতে। এই কর্নাটক খাদি গ্রামোদ্যোগ সংযুক্ত সংঘ বা কেকেজিএসএস ২০০৬ সালে জাতীয় পতাকা তৈরি ও বিক্রিতে আইএসআই-এর সংশাপত্র পায়। এরপর তারা সারা দেশে পতাকা বিক্রিতে একটি অগ্রণী সংস্থা হয়ে ওঠে। খাদি এবং গ্রামীণ শিল্পের ছাড়পত্র থাকা এই সংস্থাটি সারা দেশের একমাত্র জাতীয় পতাকা নির্মাণ এবং সরবরাহকারীও। ফলে কেন্দ্রের পলিয়েস্টার সিদ্ধান্তে তাদের অর্থনীতি বিপন্ন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক খাদি
মহাত্মা গান্ধীর হাত ধরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন গতি পেয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে খাদির উৎপত্তি হয়েছিল সরবমতী আশ্রমে। খাদিকে শুধু বিদেশি পোশাকের বিকল্প হিসেবে নয়, দেশাত্মবোধের পরিচায়ক পোশাক হিসেবে তুলে ধরলেন মহাত্মা গান্ধী। একই সঙ্গে খাদি হয়ে উঠল আত্মনির্ভরতা ও শ্রমের মর্যাদার প্রতীক। গান্ধীজি বলেছিলেন, “স্বদেশি ছাড়া স্বরাজ একটি প্রাণহীন শব। স্বদেশি যদি স্বরাজের আত্মা হয়, তা হলে খাদি হলো স্বদেশির সত্তা।”
১৯৩৪-'৩৫ সালে স্বাবলম্বী গ্রাম গঠন এবং দরিদ্র মানুষদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে খাদি উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নেন গান্ধীজি। ১৯৪২-'৪৩ সালে দেশব্যাপী খাদির পোশাক ব্যবহার সম্পর্কে চিন্তাভাবনার প্রসারে শ্রমিক এবং গ্রাম সংগঠনগুলির সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এইভাবে খাদি কেবল শুধুমাত্র একটি কাপড়ের টুকরো নয়, ভারতবাসীর জীবনযাত্রায় পরিণত হয়।
ভিন্ন পথে হাঁটেন জওহরলাল নেহরু। যন্ত্রনির্ভর উৎপাদনে ততক্ষণে দেশের মন তৈরি হয়ে গেছে। এটাও ঔপনিবেশিকতার ফল। ব্রিটিশ মিলগুলো কম দামে অনেক উৎকৃষ্ট দ্রব্য সরবরাহ করায়, তার চাহিদা বাড়তে থাকে। অনেক কম সময়ে বেশি পোশাক উৎপাদন করা সম্ভব হতে লাগল মিলে। অন্যদিকে খাদি শিল্পীদের হাতে কাপড় বুনতে অনেক সময় লেগে যেত। এই কারণে ব্রিটিশ কারখানাগুলি বাজার দখল করে নিল। তবে পরে অবশ্য ছবিটা বদলায়। হ্যান্ডলুম অর্থাৎ হস্তশিল্পর আলাদা ক্রেতা ও বাজার তৈরি হয় স্বাধীন ভারতে।
যেমনটা মনে করা হয়েছিল, তেমনটা হয়নি স্বাধীনতার পর। মিল কিন্তু সুতি বস্ত্রের উৎপাদন ব্যাহত করেনি। মার খায়নি হস্তশিল্প। নতুন একটা সেক্টরের জন্ম হলো, যার নাম পাওয়ারলুম সেক্টর। বিভিন্ন শহরে এই সেক্টর ছড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে তা বাজার দখল করে নিতে থাকল। ফলে মিলের কাপড়ের দাপটে দেশজ বস্ত্র যে মার খাবে, এমনটা হলো না। যন্ত্রের হাত ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল দেশজ পোশাক।
স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর ভারত সরকার টেক্সটাইল এনকোয়ারি কমিটি তৈরি করে। যার নেতৃত্বে ওড়িশার সাংসদ এবং পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিত্যানন্দ কানুনগো। ১৯৫৪ সালে কানুনগোর দেওয়া রিপোর্টে হ্যান্ডলুম থেকে পাওয়ারলুমে সিস্টেমকে পরিবর্তন করার সুপারিশ করা হয়। এতে বলা হয়, দেশীয় ঘারানা বজায় রেখে যন্ত্রের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়বে। 'ওয়েলফেয়ার অফ হ্যান্ডলুম ওয়েভার’ এই নামে এই উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয় এই রিপোর্টে।
বর্তমানে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সংকটে ফেলেছে। গ্রামীণ ভারত জেরবার হতে থাকে নোটবন্দি নিয়ে। এর ওপর জিএসটি-র অতিরিক্ত বোঝা। যদিও মোদি স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে খাদি শিল্পকে চাঙ্গা করতে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন।
কিন্তু ফ্ল্যাগ কোড অফ ইন্ডিয়া-র সংশোধনী অন্য সমস্যা তৈরি করে। যেহেতু পলিয়েস্টারে পতাকা বানানোর ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে, ফলে অনেক বেশি পতাকা তৈরি করা যাবে, এবং অনেক মানুষের কাছেও তা পৌঁছে যেতে পারবে। এই অভিযানের সাফল্যে শিল্পে আসবে প্রাণস্পন্দন। ইন্টারনেটের মাধ্যমেও জাতীয় পতাকা কিনে নিতে পারেন কেউ কেউ। কয়েকটা ক্লিকেই কার্য সমাধা হয়ে যায়। এর মাধ্যমে পলিয়েস্টারের পতাকায় দেশ মুখ ঢাকল ঠিকই, তবে কত খাদি শিল্পীর ঘরে আলো পৌঁছল না, তার হদিশ রাখল কেউ?