রাতারাতি নেতাবদল, ভারতীয় ক্রিকেট দলকে কতটা ভোগাবে এই নতুন উপসর্গ
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ওয়ানডে এবং টি টোয়েন্টি সিরিজে জয়লাভ করলেও পরবর্তীতে একাধিক অধিনায়ক বদল ভারতীয় টিমকে ভোগাতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গোটা বিশ্বেই জনপ্রিয়তার শিখরে বিরাট-রোহিতদের টিম ইন্ডিয়া। দেশে তো বটেই, বিদেশেও লক্ষ লক্ষ ফ্যান। অথচ কয়েক দশক আগেও এহেন দৃশ্য কল্পনাই করা ছিলো ভারী মুশকিল। সারা বিশ্বে ভারতীয় টিমকে 'আন্ডারডগ' হিসেবেই গণ্য করা হতো। সেই তকমা মুছেই বিশ্বমঞ্চে দাপট দেখিয়ে চলেছে বিরাট বাহিনী। একদিকে যেমন প্রতিটি প্রতিযোগিতায় ফেভারিট হয়ে খেলতে নামে ভারত, আবার অন্য দিকে অর্থের দিক থেকেও সবচেয়ে ধনী বোর্ড বর্তমানে ভারতেরই। কিন্তু এই এত ভালোর মাঝেই চোরকাঁটার মতো বিঁধছে 'অধিনায়ক-বিভ্রাট'। দলে একের পর এক অধিনায়ক হয়েছে সাম্প্রতিক কালে। ফলে ক্রমশই যেন চাপ আরো বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অধিনায়ক পদে প্রথমে বিরাট, পরে রোহিত আর মাঝের সময়ে পন্থ থেকে শুরু করে হার্দিক পান্ডিয়া, রাহুলের অন্তর্ভুক্তি দলের পরিস্থিতি খানিকটা হলেও তলানিতে নিয়ে গেছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এক্ষেত্রে একাধিক সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে। তবে তা আলোচনার আগে ভারতীয় ক্রিকেটের শেষ কয়েক দশকের যাত্রাপথটা এক লহমায় দেখে নেওয়া জরুরি।
১৯৮৩ সালের পূর্বে গোটা বিশ্বে ভারতকে 'ফেভারিট' হিসেবে ধরতো না কেউই। সেই সময়ে ভারতীয় দলকে 'আন্ডারডগ' তকমা দিয়েছিল ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মত দেশগুলি। তবে এর পরেই বদলে যায় সম্পূর্ণ চিত্র। ১৯৮৩-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ফাইনালে হারিয়ে কপিল দেব নেতৃত্বাধীন ভারতের বিশ্বজয় ভোলেননি কেউই! এক্ষেত্রে ভারতের বিশ্বজয়ের কাহিনী ভুলে গিয়েছে, এমন কোন ভারতীয় খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। লর্ডসের মাঠে কপিল দেবের হাতে ট্রফি গোটা দেশবাসীর আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আজও। এক কথায় বলতে গেলে, এরপরেই শুরু হয় ভারতীয় দলের আধিপত্য। পরবর্তীতে সৌরভ গাঙ্গুলী অধিনায়ক হতেই আমূল পরিবর্তন ঘটে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের। লর্ডসের মাঠ ইংল্যান্ডকে হারানো থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অজি-বধ গোটা বিশ্বে ভারতীয় দলের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করে এক মুহূর্তেই। ২০০০-এর পরবর্তী সময়ে লর্ডসের মাঠে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জয় কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি এবং বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার কাহিনি যে ক্রিকেটের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তা বলা বাহুল্য।
আরও পড়ুন-রুশ প্রেসিডেন্টের সহকারীকে হত্যার চেষ্টা, এবার লক্ষ্য স্বয়ং পুতিন?
সৌরভের হাতে তৈরি ট্রেন্ড অব্যাহত রেখে তাকে আরো শীর্ষস্থানে পৌঁছে দেয় ভারতীয় দল। নেপথ্যে অবশ্যই একটি নাম ,মহেন্দ্র সিং ধোনি, রাচির এক ছেলের হাত ধরেই ক্রমশ সত্যি হতে থাকে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন এবং পরবর্তীতে তা পূরণ করে ২০০৭ এবং ২০১১ ওয়ার্ল্ড কাপের ট্রফি উঠে ভারতের হাতে। তবে ভারতের এ মসৃন যাত্রার নেপথ্যে যদি কোন জিনিসের অবদান থেকে থাকে, তা হল 'অধিনায়কত্বের সাফল্য'।কপিল দেব থেকে শুরু করে সৌরভ গাঙ্গুলী কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনি, প্রতিটি অধিনায়কের নেতৃত্বে বড়সড় পরিবর্তন ঘটে ভারতীয় দলের।
অধিনায়কত্বের বিশেষত্ব
প্রথমেই যদি আসা যায় কপিল দেবের কথায়। তাঁর ক্যাপ্টেন্সির ক্ষমতা, দলকে একা-হাতে সামলানোর মনোভাব ভারতকে প্রথম ওয়ার্ল্ড কাপ ট্রফির কাছে পৌঁছে দেয়। এই প্রসঙ্গে এখনও পর্যন্ত কপিল দেবের উদ্দেশ্যে ভূয়সী প্রশংসা করতে শোনা যায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের বহু খেলোয়াড়কেই। পরবর্তীতে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ যখন কিছুটা নিম্নগামী তখনই আবির্ভাব প্রিন্স অফ কলকাতা সৌরভ গাঙ্গুলীর। তাঁর আগ্রাসী মনোভাব দলকে বদলে দেয় আপদমস্তক। সেহবাগ, যুবরাজ, মোহাম্মদ কাইফ থেকে শুরু করে জাহির খানের মতো একাধিক তরুণ প্রতিভা তুলে ধরার পেছনে ভূমিকা ছিল সৌরভেরই! কিভাবে তাঁর মানসিকতার ওপর ভর করে অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতকে আগ্রাসী রূপে তুলে ধরে, সেই কাহিনি বর্তমানে শোনা যায় বহু প্রাক্তন খেলোয়াড়ের মুখে।
পরবর্তীতে ভারত পায় বিশ্বসেরা উইকেট কিপার তথা অধিনায়কের খোঁজ। মহেন্দ্র সিং ধোনি, 'ক্যাপ্টেন কুল'-এর মস্তিষ্কের ছোঁয়ায় মানসিকতাই বদলে যায় সম্পূর্ণ দলের। এরপর থেকেই এক কথায় 'ফেভারিট' তকমা নিয়ে ২২ গজে নামতে শুরু করে টিম ইন্ডিয়া। এক্ষেত্রে, মহেন্দ্র সিং ধোনির পরবর্তী সময়ে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে বিরাট কোহলি দ্বারা টিম ইন্ডিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়া হলেও বর্তমানে দেখা দিয়েছে গভীর সংকট। নেপথ্য কারণ কী?
অধিনায়কত্বের সমস্যা এবং তরুণের ওপর ভরসা
বর্তমানে অধিনায়কত্বের প্রধান যে সমস্যা, তা শুরু হয় গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পূর্বের মুহূর্ত থেকেই। মহেন্দ্র সিং ধোনির পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েক বছর ধরে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব সামলান বিরাট কোহলি। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে হারতে হয় ভারতকে। এর মাঝে গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সময় বিরাট কোহলি দ্বারা অধিনায়কত্ব পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করলেই শুরু হয় সংকট। স্বাভাবিক ভাবেই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের পরবর্তী অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেওয়া হয় রোহিত শর্মার নাম। তবে এর পাশাপাশি ওয়ানডে এবং টেস্ট ফরম্যাটের অধিনায়ক পদ থেকেও সরানো করা হয় বিরাটকে। এ নিয়েই পরবর্তীতে শুরু হয়ে যায় ভারতীয় বোর্ড বনাম বিরাট তরজা।
পরবর্তীতে তা থামলেও অধিনায়কত্ব সমস্যায় জেরবার ভারত। এক্ষেত্রে ভারতীয় বোর্ডের প্রথম পছন্দ রোহিত শর্মা হলেও একাধিক সিরিজে অধিনায়কের নাম পরিবর্তন দুশ্চিন্তায় রেখেছে সকল ক্রিকেটপ্রেমীদের। এক্ষেত্রে বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের ওপরেও ভরসা রেখেছে ভারতীয় বোর্ড।
অধিনায়ক পদে একাধিক পরিবর্তন
বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে ভারতীয় দলে একাধিকবার পরিবর্তন ঘটেছে অধিনায়ক পদে। এক্ষেত্রে বিরাট কোহলিকে ক্যাপ্টেন্সি থেকে বাদ দেওয়ার পরে স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় বোর্ডের প্রথম পছন্দ ছিলেন রোহিত শর্মা। তবে এর মাঝেই রোহিতের চোট থাকায় দল থেকে বাদ পড়লে অধিনায়ক পদে বসানো হয় লোকেশ রাহুলকে। এরপরে রাহুল চোট লাগার কারণে বাদ যান দল থেকে এবং সেই সময় আবার ভারতের দায়িত্ব পান নতুন অধিনায়ক ঋষভ পন্থ। ফের কয়েকদিনের মধ্যে বদল।
এরপরই অধিনায়কের পদে নিয়ে আসা হয় বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়াকে। অবশ্য সম্প্রতি ভারতীয় দলের খেলা শেষ সিরিজে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেন রোহিত শর্মা। যদিও এর মাঝেই ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি মাত্র টেস্টে আবার ক্যাপ্টেন্সিরর ব্যাটল তুলে দেওয়া হয় বুমরার হাতে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে অধিনায়ক পদে এতগুলি নাম আখেরে যে দলের ক্ষতি করছে, সে বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
দলের ফলাফলে অধিক অধিনায়কের প্রভাব
ভারতীয় দলের বর্তমান রেকর্ড খুব একটা ভালো নয়। এক্ষেত্রে কয়েক মাসের ব্যবধানে অধিনায়ক পদে একাধিক পরিবর্তন যে দলের ক্ষতি করে চলেছে, সেই পরিসংখ্যানই উঠে এসেছে বর্তমানে। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নেয় ভারত। পরবর্তীতে রোহিত শর্মার নেতৃত্বে কয়েকটি সিরিজ জিতলেও পুনরায় একবার পরাজয়ের সরণীতে ঢুকে পড়ে টিম ইন্ডিয়া। এক্ষেত্রে লোকেশ রাহুলের নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ হার থেকে শুরু করে পন্থের নেতৃত্বে পরাজয়ের মুখোমুখি হয় ভারত। পরবর্তীতে বুমরার ওপর অনেক আশা থাকলেও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একটি মাত্র টেস্টে পুনরায় একবার হেরে বসে ভারতীয় দল। ফলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ওয়ানডে এবং টি টোয়েন্টি সিরিজে জয়লাভ করলেও পরবর্তীতে একাধিক অধিনায়ক বদল ভারতীয় টিমকে ভোগাতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।