বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা, নেপথ্যে যে কারণ
Bangladesh Flood: অগস্টের শুরুতেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙন দেখা গিয়েছিল। প্রথমে এখান থেকেই লোকালয়ে জল ঢুকতে শুরু করে।
ভয়াবহ বন্যার কবলে বাংলাদেশের আট জেলা। বন্যায় নাজেহাল বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালি ও কুমিল্লার মতো একাধিক এলাকা। সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। বন্যায় তলিয়ে গিয়েছে প্রায় দেড় শতাধিক গ্রাম। বন্যা থেকে বাঁচতে সোনাগাজী বড় ফেনী নদীর উপরে তৈরি মুহুরী রেগুলেটরের (জলকপাট) ৪০টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এম আলী রেজা সাংবাদিক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (২০ অগস্ট), রাত ১২টা থেকে বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যাকে রেকর্ড ভারী বৃষ্টিপাত বলা যেতে পারে। বন্যার জলে তলিয়ে গিয়েছে বাড়ি, রাস্তা, চাষের জমি,মাছের খামার। হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার নেওয়ায় এখনও হাজার হাজার মানুষ আটকা রয়েছেন এই অঞ্চলগুলিতে। অন্যদিকে, বন্যায় তীব্র ক্ষতির মুখে এপার বাংলার ত্রিপুরা। বন্যায় সেখানে অন্তত ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে সে রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর। ভারী বৃষ্টিপাতের জন্যে হাওড়া, খোয়াই, মুহুরী ও ঢালাই-সহ রাজ্যের প্রায় বেশিরভাগ নদীই বইছে বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে।
বন্যায় ভেসে গিয়েছে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়ি জেলা। আরও বেশ কয়েকটি জেলা ও অঞ্চল বানভাসি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানাচ্ছে দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। লাগাতার বৃষ্টিতে চাঁদপুরে পদ্মা-মেঘনা নদীর জল সামান্য বেড়েছে। বুধবার মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনীয়া নদীর জল বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে বয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান 'বিবিসি বাংলা'-কে জানান, 'ওইসব এলাকা ছাড়া আগামী ২৪ ঘন্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীর জল সমতল বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে এবং নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।'
আরও পড়ুন: ‘বাংলাদেশি’ তকমা! ওড়িশায় কেন নির্যাতনের শিকার বাংলার শ্রমিকেরা?
অগস্টের শুরুতেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৭টি অংশে ভাঙন দেখা গিয়েছিল। প্রথমে এখান থেকেই লোকালয়ে জল ঢুকতে শুরু করে। ৩টি উপজেলারই প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা জলের নিচে। ডুবে গিয়েছে অধিকাংশ বাড়ি-ঘর। বিপদসীমার অনেকটাই উপর দিয়ে বইছে ফেনীর, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদী। মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত চৌকি উঁচু করে কাটিয়েছেন স্থানীয়রা। কিন্তু রাতের মধ্যেই জল আরও বেড়ে যাওয়ায় বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয় বাসিন্দাদের। কুমিল্লা, নোয়াখালি ও চট্টগ্রামেও বাড়ছে বন্যার জল। কুমিল্লা এবং নোয়াখালির বহু এলাকাই তলিয়ে গিয়েছে জলে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর, ফসলজমি। চট্টগ্রামে অজস্র পরিবার বন্যাবিপর্যস্ত। জলের স্রোত এতটাই বেশি ভেঙে যাচ্ছে রাস্তাও ।
'বিবিসি'-র তরফে লেখা হয়েছে,ভারতের ত্রিপুরার ডম্বুর হাইড্রোইলেকট্রিক পাওয়ার প্রজেক্ট বা ডম্বুর বাঁধের জলস্রোত বিপদসীমা ছুঁয়ে ফেলেছিল। ওই সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছে, ত্রিপুরার গোমতীর জেলা প্রশাসক তড়িৎকান্তি চাকমা এক্স হ্যান্ডেলে জানিয়েছিলেন, বাঁধ বাঁচাতে গেট খুলে জল ছাড়া হয়েছে। যদিও ইনস্ক্রিপ্ট এমন কোনও তথ্য খুঁজে পায়নি। 'বিবিসি'-র অভিযোগ, ওই বাঁধের জলই ঢুকেছে বাংলাদেশে। যদিও এই তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে ভারত সরকার। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে,'বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতির জন্য ত্রিপুরার গোমতী নদীতে ডম্বুর বাঁধ থেকে জল ছাড়ার কারণকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্য সঠিক নয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদীর লাগোয়া এলাকাগুলিতে বিগত কয়েকদিন ধরেই টানা ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। মূলত বাঁধের নীচের দিকে জলের প্রবাহের কারণেই বাংলাদেশে বন্যা হয়েছে।' কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারী বৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই বাঁধের জল ছাড়া হয়। জলস্তর বাড়তেই ২১ অগস্ট দুপুর ৩টে নাগাদ বাংলাদেশ সরকারকে গেট খোলার কথা জানানো হয়েছিল। বন্যায় বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিল না। তবে নানাভাবে বাংলাদেশকে সেই তথ্য ভারতের তরফে জানানো হয়েছিল বলেই জানিয়েছে কেন্দ্র। 'বিবিসি'-র তথ্য বলছে, ১৯৯৩ সালে শেষবার এই বাঁধ খোলা হয়েছিল।
এদিকে, পশ্চিম ত্রিপুরার খোয়াই জেলায় আগামী দু'দিন অতি ভারী বৃষ্টিপাতের লাল সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এছাড়াও ৬টি জেলায় জারি হয়েছে কমলা সতর্কতা। রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের তরফে জানানো হয়েছে, এই রাজ্যে মোট ১৮৩টি ত্রাণ শিবিরের আয়োজন করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫,০০০ মানুষ সেই ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
আরও পড়ুন:নতুন বাংলাদেশ চলুক ছাত্রদের চেতনাতেই, দেশে ফিরে বার্তা নোবেলজয়ী ইউনূসের
বাংলাদেশের অধিকাংশ বন্যাকবলিত অঞ্চলই বিদুৎবিচ্ছিন্ন। বন্ধ মোবাইল নেটওয়ার্কও। ফেনী-পরশুরাম অঞ্চলের রাস্তা ও উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়কগুলিতে যানচলাচল আপাতত বন্ধ। ফেনী অঞ্চলে ১৯৮৮ সালের পর থেকে এমন বীভৎস বন্যা দেখেনি মানুষ। বন্যা কবলিত এলাকাগুলিতে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে জেলা প্রশাসন এবং দমকলকর্মীরা। বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও আটকে পড়া মানুষদের নৌকায় করে আশ্রয় কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। বন্যা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করায় জেলা প্রশাসন জরুরি ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর সাহায্য চেয়েছে। ফেনীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত তিন উপজেলার সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আশ্রয় কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। মানুষের পাশাপশি গৃহপালিত পশু পাখিদেরও উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে ৫৪টি নদী। ফলত এই নদীগুলিতে বন্যা দুই দেশেরই সমস্যার কারণ। দুই দেশ একে অপরকে সাহায্য করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব বলেই জানিয়েছে বিদেশ মন্ত্রক। বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা দুই জায়গাতেই আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে,এর ফলে দু'জায়গাতেই আগামী দিনে জল আরও বাড়তে চলেছে, খারাপ হতে চলেছে পরিস্থিতি। অন্যদিকে, বন্যায় যেমন দিশেহারা বাংলাদেশের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। ত্রিপুরাও বন্যায় ভয়ঙ্কর ক্ষতির সম্মুখীন। এর মধ্যে আবার সদ্য পালাবদল হয়েছে বাংলাদেশে। হাসিনা সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় এসেছে অভ্যন্তরীণ সরকার। এই পরিস্থিতিতে জল ছাড়া নিয়ে দোষারোপের জেরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়েও।