ইংরেজি বলায় আমেরিকার পরেই ভারত, কেন এত বিদেশি ভাষা প্রীতি দেশবাসীর?

ইংরেজি ভাষা নিয়ে ভারতীয়দের আদিখ্যেতার সূত্রপাত সেই ব্রিটিশ আমলেই। এরপর ক্রমাগত ইংরেজির দাপটে বাংলা ভাষা  শিক্ষিত সমাজে গুরুত্ব হারিয়েছে। সর্বভারতীয় স্তরে বাংলা ভাষার তেমন কোনও গুরুত্ব আজও তৈরি হয়নি। যে শিক্ষিত বাঙালি ছেলেমেয়েরা বাংলার বাইরে চাকরি-বাকরি করতে পাড়ি দিচ্ছেন, ইংরেজি ভাষাটাই তাঁদের ভরসা জীবিকার্জন ও যোগাযোগ তৈরির জন্য। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, 'মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ'। ইংরেজ ভারত ছাড়লেও মাতৃভাষার মতো পবিত্র মাতৃদু্গ্ধ থেকে শত সাবধানবাণী সত্ত্বেও বাঙালির নিজেকে ক্রমান্বয়ে বঞ্চিত করাটা কালিদাসের বোকামির বহুল প্রচলিত কাহিনির মতো। যে ডালে বসবাস, সেই ডালই কেটে দেওয়ার ফলে আজ বাঙালি অসহায়।

ব্রিটিশদের অফিস-কাছারিতে চাকরি-বাকরি পেতে হলে শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায়ের ইংরেজি শেখাটা প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া বাংলার নবজাগরণও সম্ভবপর হয়েছিল ইংরেজি বইপত্র বাঙালির মনোজগতে নতুন চিন্তার বীজ বপণ করায়। এটা একদিকে ইংরেজি পাঠের সদর্থক দিক হলেও সমান্তরালভাবে ফুলে-ফলে-পল্লবে বিকশিত হয়েছে ইংরেজি পড়তে পারা কিংবা বলতে পারা নিয়ে বাঙালির দেখনদারি। পরে যা গোটা ভারতে বিস্তারলাভ করেছে।

ইংরেজি ভাষাটা পরাধীন ভারতে যাঁরা গড়গড় করে বলতে পারতেন, দু'চার পাতা ইংরেজি পড়ে তাঁদের বিরুদ্ধে ধরাকে সরাজ্ঞানের অভিযোগও উঠেছে বরাবর। আর গোঁড়া হিন্দু-মুসলমান- দু'পক্ষের কাছেই ভাষাটা আবার ছিল ম্লেচ্ছদের।

আরও পড়ুন: বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরাও এখন খিচুড়ি বাংলা বলে

ভারতের আকাশ থেকে ব্রিটিশ সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরে ইংরেজ প্রভুদের ছেড়ে যাওয়া ভাষা ভারতে দিনে দিনে আরও সমাদৃত হয়েছে।

১৯১৯ সালে মহাত্মা গান্ধি 'ইয়ং ইন্ডিয়া' নামে একটি নিবন্ধ লেখেন। মহাত্মা গান্ধি ওই নিবন্ধে তৎকালীন ইংরেজিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে লিখেছিলেন, ইংরেজির বাড়বাড়ন্তে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য ক্ষতিগ্রস্ত। ইংরেজির মতো একটি বিদেশি ভাষার মাধ্যমে প্রকৃত শিক্ষালাভ করাটা অসম্ভবই।

মাতৃভাষাকে ভালবাসার সত্যিকারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধির মতো মণীষীদের কথা কানেও তোলেনি ভারতবাসী। বরং ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীনের পর থেকে গত কয়েক দশকে ভারতবাসীর ইংরেজি ভাষার দ্বারা অবদমিত হওয়া আরও বেড়েছে।

গোটা ভারতেই এখন ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনে বদ্ধমূল এক ধারণা ঢুকে গিয়েছে, ছেলেমেয়েরা ইংরেজি না শিখলে ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা হালে পানি পাবে না। জুটবে না ভাল চাকরি-বাকরিও।

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, গোটা বিশ্বে ইংরেজি ভাষা বলা-কওয়ার নিরিখে ভারত বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানাধিকারী। আর প্রথম স্থানাধিকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ভারত স্বাধীন হওয়ার ৭৫ বছর পরেও ইংরেজি ভাষাটা এদেশে জাঁকিয়ে রাজত্ব করে চলেছে। মহাত্মা গান্ধির স্বপ্ন সফল হয়নি। ষ

বর্তমানে ১০ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক ইংরেজি ভাষা বলতে পারেন বলে সমীক্ষায় জানা গিয়েছে। এর মধ্যে ৮ শতাংশ মানুষ ইংরেজি বলতে পারেন ভাঙা ভাঙা। আর ২ শতাংশ মানুষ সঠিক ইংরেজি জানেন।

স্বাধীনতার পরে দশকের পর দশক ধরে ভারতীয়দের মনে মুদ্রাদোষের মতো এই ধারণাও ঢুকে গিয়েছে, ইংরেজি হল জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের ভাষা। ইংরেজি বলতে পারলে চাকরি-বাকরি অন্তত একটা জুটে যাবে।

শুধু তাই নয়, যে ভারতীয় নাগরিকরা ইংরেজি জানেন তাঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠর নাকটা আবার বেজায় উঁচু ইংরেজি বলতে পারার দৌলতে। যাঁরা ইংরেজি বলতে-লিখতে পারেন তাঁদের একাংশ নিজেকে অন্যদের চেয়ে আলাদা হিসেবেও জাহির করেন, এও আমাদের অভিজ্ঞতায় অজানা নয়।

ভারতে দিনে দিনে ইংরেজি শিক্ষিতের চাহিদা বাড়ছে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে। দেশের সমস্ত স্কুলের পড়ুয়াদের ইংরেজি পড়াটাও বাধ্যতামূলক। দেশটা স্বাধীন হলেও এককালের ইংরেজ প্রভুর ভাষা আমরা বিসর্জন দিতে পারিনি। 

বরং ইংরেজি ভাষাটা হিন্দির সঙ্গে মিলেমিশে গিয়ে ভারতে নতুন এক ভাষার উৎপত্তি হয়েছে। তা হল হিংলিশ। হিংলিশ কিছুটা হিন্দি আর খানিকটা ইংরেজির মিশেলে জগাখিচুড়ি এক ভাষা। যে ভাষার কোনও ঐতিহ্যই নেই।

ভারতে ইংরেজি নিয়ে এত বাড়াবাড়ি কেন, তা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণার বিষয় হতে পারে। ইংরেজি ভাষা বলা-কওয়া সম্পর্কিত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সারা পৃথিবীতে ৯০ কোটি ৮৫ লক্ষ মানুষ ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেন। সেই হিসেবে সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ মানুষ ইংরেজি বলে থাকেন।

ভারতে যত সংখ্যক মানুষ ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেন ইংরেজদের মাতৃভূমিতেও তত সংখ্যক মানুষ ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেন না। ভারতের পরই ইংরেজি বলায় পাকিস্তান তৃতীয় স্থানাধিকারী দেশ।

লোক ফাউন্ডেশন নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা ভারতের শহরাঞ্চলের বাসিন্দা গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের তুলনায় তাঁরা বেশি করে ইংরেজিতে কথাবার্তা বলেন।

শহরাঞ্চলের বাসিন্দা ১২ শতাংশ ভারতীয় ইংরেজি বলতে পারেন। আর গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা ৩ শতাংশ ভারতীয় নাগরিক ইংরেজিতে কিছু কিছু কথাবার্তা বলতে পারেন।

লোক ফাউন্ডেশন এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে বড়লোকরা গরিব মানুষের তুলনায় বেশি করে ইংরেজি বলেন। যেমন, ৪১ শতাংশ উচ্চবিত্ত ভারতীয় ইংরেজি ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আর ২ শতাংশের কম দরিদ্র ভারতীয় নাগরিক সামান্য ইংরেজি বলতে পারেন।

এছাড়া সারা পৃথিবীতে ইংরেজি ছাড়া যে ভাষাগুলিতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কথা বলেন সেই ভাষাগুলির মধ্যে রয়েছে ইংরেজি, মান্ডারিন চাইনিজ, হিন্দি, স্প্যানিশ, পর্তুগীজ, রাশিয়ান ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাও।

সেই ইংরেজ আমল থেকে বাঙালির ইংরেজি ভাষা বলে জাতে ওঠার যে প্রবণতা ছিল, তা আজও বিদ্যমান হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাটা কিন্তু হারিয়ে যায়নি। বরং বহালতবিয়তেই আছে।

কেননা আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পৃথিবীর যে সাতটি ভাষায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ কথা বলেন 'মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা' তার মধ্যে একটিই।

More Articles