ভারত এখন ‘জুমলা’বাজির দেশ : সুমন চট্টোপাধ্যায়

Freedom of Speech : আমেরিকায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সার্বভৌম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, আমাদের দেশে তাকে অবোধ্য ‘রিজনেবল রেসট্রিকশন’-এর শৃঙ্খল পরিয়ে রাখা হয়েছে গোড়া থেকেই। কী এই রেস্ট্রিকশন? ল...

রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে মার্কিন মুলুকে একটি রসিকতা চালু আছে- দে ওনলি স্পিক হাফট্রুথস অ্যান্ড দ্য ইউজুয়াল লাইজ। সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরদের রাজনীতিতে কোনও স্থান হয় না, রাজনীতি এমনই ছলাকলা। উদাহরণ খুঁজলে একবার প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে তাকাতে পারেন। গড়ে দিনে অন্তত তিন-চারটি অর্ধসত্য অথবা ডাহা মিথ্যে কথা বলে তিনি দিব্যি হোয়াইট হাউসে তাঁর কার্যকালের মেয়াদ বহাল তবিয়তে পূর্ণ করে গেলেন। ওয়াশিংটন পোস্টের দৈনিক ফ্যাক্ট-চেকারে সেই সব মিথ্যা প্রত্যহ ধরা পড়ত, মহামতি ট্রাম্প ভ্রূক্ষেপও করতেন না।

একই কথা আরও বেশি করে সত্য ভ্লাদিমির পুতিনের ক্ষেত্রে। মিথ্যা বলে বলে তাঁর রাষ্ট্রযন্ত্র রুশি আমজনতার এমনই মগজ ধোলাই করেছে যে তাঁদের অধিকাংশ এমন মর্মান্তিক পরিণতি প্রত্যক্ষ করা সত্ত্বেও এমন সর্বক্ষয়ী যুদ্ধের যৌক্তিকতা নিয়ে কোনও প্রশ্নই তুলছেন না। সরলমতি রুশিরা সত্যিই বিশ্বাস করেন নিও-নাৎসিরাই কিয়েভে ক্ষমতাসীন। অতএব তাদের সবক শেখানোতে কোনও অন্যায় নেই। মার্কিন আর রুশি মুলুকের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা হলো আমেরিকায় প্রেসিডেন্টকে ছাপা অক্ষরে মিথ্যাচারী, ব্যাভিচারী ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা যায় অনায়াসে, পুতিন-তালুকে বিপক্ষে টুঁ শব্দটি করলে তাকে সোজা কয়েদখানায় চালান করে দেওয়া হয়। আগে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হতো, এখন সে সব আছে কিনা জানা নেই।

আরও পড়ুন- আদানি অস্ত্রে কাবু হবেন মোদি? : সুমন চট্টোপাধ্যায়

আমাদের দেশের দিকে চোখ ফিরিয়ে কেবল মরুতীর্থ হিংলাজের ওই মরমী গানের প্রথম দু'টি কলি স্মরণ করুন, "তোমার ভুবনে মাগো এত পাপ, এ কী অভিশাপ, নাই প্রতিকার/ মিথ্যারই জয় আজ সত্যের নাই তাই অধিকার।" ভারতবর্ষ কালে কালে একদিন আমেরিকার মতো অবাধ, মুক্ত গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পারে, হওয়া সম্ভব, এমনতরো সুখস্বপ্ন দেখার অবকাশ অভাগা দেশবাসী কখনও পায়নি। তার প্রধান কারণ আমাদের স্বনামধন্য, প্রণম্য, দেশবরেণ্য সংবিধান প্রণেতারা তাঁদের দেশবাসী নিরঙ্কুশ বাক স্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা পাওয়ার যোগ্য বলেই বিবেচনা করেননি। আমেরিকায় যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে সার্বভৌম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত, আমাদের দেশে তখন তাকে অবোধ্য ‘রিজনেবল রেসট্রিকশন’-এর শৃঙ্খল পরিয়ে রাখা হয়েছে গোড়া থেকেই। অনেকটা দু’পায়ের গোড়ালিতে দড়ি পরিয়ে দিয়ে কাউকে বলা, "এবার জোরে দৌড়াও।" মানে অধিকার কাগজে কলমে আছে, বাস্তবে নেই। দুনিয়াকে বলা হয় এই দ্যাখো, সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে আমরা কেমন নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছি। আর দেশবাসী অন্তরালে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাবে, "এ ব্যথা কী যে ব্যথা" তা কি ‘আনজনের’ পক্ষে বোঝা সম্ভব?

‘রিজনেবল রেস্ট্রিকশন’। কোনটা রিজনেবল আর কোনটা নয় এটা কীভাবে স্থির হবে? কেন, রাষ্ট্র যেভাবে মনে করবে! রাষ্ট্র ঠিক মনে করছে না ভুল সেটার বিচার করবে কে? কেন, আদালত। ব্যস এখানে এসেই অনিশ্চয়তা আর অসহায়তার চোরাবালিতে ডুবতে থাকবেন আপনি। পকেটের জোর থাকলে, ভাগ্যদেবী সহায় হলে হয়তো একদিন আদালত বলে দিতেও পারে আপনি নিরপরাধ। তবে সেটাও নির্ভর করবে হাকিমের মেরুদণ্ডের উপর যা এখন লোপ পেতে পেতে বিপন্ন প্রজাতিতে পর্যবসিত হয়েছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় আপনার কপালে তেমন একজন হাকিমই জুটল, গুমঘরের মস্ত কালো ফাটকের ইয়া বড় তালা খোলার দিন আসতে আসতে আপনি জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ পুঁজিটির অনেকখানি খরচ করে ফেলবেন। সময়। হয়তো কালো দাড়ি নিয়ে ঢুকেছিলেন, সান্টা ক্লজ হয়ে ফিরবেন, হয়তো প্রবেশের সময় আপনার দেহ ছিল নধরকান্তি, বের হলে দেখা গেল আপনাকে দেখে টিবি রোগী ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। জিন্দা হয়ে ঢুকে লাশ হয়ে বেরোনোটাও অসম্ভব নয়। অধুনা এমন ঘটনা আকছার হচ্ছে, আমি নিজেও সেই ভুক্তভোগীর দলে।

আরও পড়ুন- লেখক কম, প্রকাশকে গিজগিজ করছে বাংলার বইবাজার : সুমন চট্টোপাধ্যায়

শস্যের ভালো ফলনের জন্য যেমন উর্বর জমি লাগে তেমনই মিথ্যার বেসাতিকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজন জীবন্ত গণতন্ত্র, সংবিধানকে গীতা অথবা কোরানের মতো আরাধ্য ভাবার মানসিকতা, নিরপেক্ষ, নির্ভীক বিবিধ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে পারার হিম্মতওয়ালা গণমাধ্যম এবং গণতন্ত্রকে মৃত্যুঞ্জয়ী মহামন্ত্র জ্ঞান করতে পারার মতো জাগ্রত সমাজ। ভারতবর্ষের সংবিধানে এসবের বন্দোবস্ত করা আছে কেবল দু’টি বিষয় ছাড়া। স্বাধীন গণমাধ্যম আর জাগ্রত সমাজ। দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে ভারতের দিকে তাকিয়ে মনে হতো এদেশে গণতন্ত্র শিকড় গাড়ার সম্ভাবনা অতীব উজ্জ্বল, কেননা যাঁদের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব ছিল, দুর্বিনীত ঔপনিবেশিক শাসনের রাহুমুক্তির পরে তাঁরা স্বাধীনতার মূল্য বুঝেছিলেন, তাঁদের আচরণে প্রত্যহ গণতান্ত্রিক অনুশীলনের প্রত্যয় প্রতিফলিত হতো। তাঁরা ভাবতে পারেননি কালে কালে দেশটা পিগমিদের হাতে চলে যাবে, সারিসারি বাঁদরের গলায় পরানো হবে মুক্তোর মালা, দেশটা পড়ে থাকবে অশিক্ষা, অপুষ্টি আর অবর্ণনীয় দারিদ্রের অন্ধকারে। ফলে মিথ্যাচারই হয়ে উঠেছে নিয়ম, আসমুদ্র হিমাচলে একটি ভূখণ্ডও অবশিষ্ট নেই যেখানে গণতন্ত্র তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ভারত এখন ‘জুমলা’বাজির দেশ।

বাচ্চা লোগ জোরসে হাততালি বাজাও।

 

More Articles