কোন ম্যাজিকে পাকিস্তানের জেতা ম্যাচ ছিনিয়ে নিলেন বুম বুম বুমরাহ?

Jasprit Bumrah: সাম্প্রতিক ২০২৪ আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের পারফরমেন্স হতদরিদ্র হলেও, বুমরাহের পারফরমেন্স ছিল পাঁকে পদ্মফুল ফোটার মতোই।

জাসপ্রিত বুমরাহ, বিশ্বের সেরা বোলারদের তালিকায় তিনি যে এখন একেবারে ১ নম্বরে সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ফরম্যাট কন্ডিশন এবং প্রতিপক্ষ নির্বিশেষে তাঁর দুরন্ত পারফরমেন্স নজর কেড়েছে সারা বিশ্বের। যেখানে একটা সময়ে ভারতকে সারা বিশ্ব চিনত স্পিনের গড় হিসেবে, সেখানেই নিজের পেস বোলিংয়ের জাদুতে এক রূপকথা রচনা করেছেন বুমরাহ। ভারত পাকিস্তানের হাইভোল্টেজ ম্যাচে যেখানে পাকিস্তান ইনিংসের ১৬ তম ওভার পর্যন্ত ছিল চালকের আসনে, সেই অবস্থায় পাকিস্তানের হাত থেকে ম্যাচ ভারতের দিকে টেনে আনলেন বুমরাহ। এমন জীবন মরণ ম্যাচের গতিপথে আঘাত হানার পর বুমরাহ প্রমাণ করেছেন, তিনি ক্রিকেট জগতের নতুন সম্রাট।

বুমরাহর খেলার ধরন

বুমরাহ তাঁর অসাধারণ গতির জন্য বিখ্যাত, যা নিয়মিতভাবেই ১৫০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টার কাছাকাছি ছুঁয়ে যায়। এই গতির জন্যই ব্যাটারদের বিভ্রান্ত করতে এবং উইকেট শিকারের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেন তিনি। বুমরাহ নির্ভুল বোলার। ক্রমাগত লাইন ও লেন্থ মেনে চলেন এবং ব্যাটারদের জন্য ভুল করে বেঁচে যাওয়ার সুযোগ কমিয়ে দেন। যদি একবার কোনও ব্যাটসম্যান বল মিস করেন, তাহলেই বল গিয়ে সোজা লাগবে উইকেটে, এতটাই তীক্ষ্ণ তাঁর লাইন ও লেন্থ। এছাড়াও, বুমরাহ বিভিন্ন ধরনের ডেলিভারি করতে পারেন, যার মধ্যে রয়েছে ইনসুইংকার, আউটসুইংকার, স্লোয়ার, কাটার এবং ইয়র্কার। এই বৈচিত্র্যই তাঁকে বিশ্বের সেরা বোলারদের মধ্যে একজন করে তোলে, কারণ তিনি যেকোনও পরিস্থিতিতে উইকেট শিকার করতে পারেন।

আরও পড়ুন- ‘খলনায়ক’ থেকে মহানায়ক! কেন মহম্মদ শামিই ভারতের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র?

আইপিএলে জাদুকরী বোলিং

শুধু ভারত পাকিস্তান ম্যাচ নয়, এর আগেও বুমরাহ্ নিজের জাদু দেখিয়ে এসেছেন আইপিএলে। সাম্প্রতিক ২০২৪ আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের পারফরমেন্স হতদরিদ্র হলেও, বুমরাহের পারফরমেন্স ছিল পাঁকে পদ্মফুল ফোটার মতোই। যখন ব্যাটাররা রীতিমতো তুলোধোনা করছিলেন মুম্বইয়ের পুরো বোলিং লাইন-আপকে, সেই সময় নিজের জাদু দেখান বুমরাহ্। ধ্বংসাত্মক ব্যাটারদের পরাস্ত করে, রানের চাকা থামিয়ে দিয়েছেন তিনি। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও তাঁর সুনিপুণ পারফরমেন্স দেখেছে সারা বিশ্ব।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অসাধারণ পারফরমেন্স

২০২২ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের সবথেকে বড় ভরসা ছিলেন বিরাট কোহলি। ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে এক দুরন্ত জয় এনে দিয়েছিলেন বিরাট। তাঁর অধিনায়কত্বের সময়ে একবার পাকিস্তান ১৫২ রান তাড়া করতে গিয়ে ভারতকে ১০ উইকেটে পরাজিত করেছিল। সেই খারাপ লাগা এখনও বিরাটকে কুরে কুরে খায়। সেই কারণে, ২০২২ সালের সেই ম্যাচে নিজের সবটা দিয়ে ভারতকে বাঁচিয়েছিলেন তিনি। রোহিতকে বাঁচিয়েছিলেন আরও এক বিরাট গ্লানির হাত থেকে।

২০২৪ সালে বিরাট ব্যর্থ হলেও, পাকিস্তানের বিপক্ষে উদয় হয় এক নতুন তারকার। নিজের বোলিং দিয়ে বুমরাহ্ প্রমাণ করে দিলেন, তাঁর মতো বোলার সত্যিই এই বিশ্বে বিরল। পাকিস্তানের বিপক্ষে বুমরাহ তাঁর বোলিং দিয়ে বছরের পর বছর মনে রাখার মতো পারফরমেন্স উপহার দিয়েছেন। তবে, রবিবারের ম্যাচের পারফরমেন্স ছিল সবথেকে আকর্ষণীয়। একটা সময় যখন ভারতের জেতার সম্ভাবনা মাত্র ৮ শতাংশ, তখন বুমরাহের হাতে বল তুলে দেন রোহিত শর্মা। আর বল হাতে পেয়েই নিজের জাদু দেখান এই জাদুকর। পাকিস্তানের সবথেকে ভরসাযোগ্য ব্যাটার মহম্মদ রিজওয়ানকে ক্লিন বোল্ড করে ম্যাচের চাকা ঘুরিয়ে দেন বুম বুম বুমরাহ। চার ওভারে ১৪ রান খরচ করে তিন উইকেট শিকার করেছেন তিনি। অধিনায়কের নির্দেশ মতো নিজের সেরাটা দিয়েছেন এই ডানহাতি বোলার। দুই বছর আগে বিরাট কোহলি যেভাবে অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিলেন মেলবোর্নে, ঠিক সেটাই বল হাতে করলেন বুমরাহ।

ম্যাচের গতি পরিবর্তন

ম্যাচের শুরুতেই পাকিস্তানের মূল ভরসা বাবর আজমকে আউট করে বুমরাহ ম্যাচের গতি পরিবর্তন করে দেন। তাঁর ব্যাটের উপরে নির্ভর করেই এদিন খেলতে নেমেছিল পাকিস্তান। আগের ম্যাচে আমেরিকার বিপক্ষে চাপের মুখে এক দারুণ ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। যদিও বেশ কিছু বল তিনি প্রথমে নষ্ট করেছিলেন, তবে পরে সেটা তিনি ব্যাটিং দিয়ে পূরণ করে দেন। ২২ বলে ৭ রান করে যখন তিনি ক্রিজে, তখন একের পর এক উইকেট পড়ছে পাকিস্তানের। সেখান থেকে নিজের ইনিংসকে ৪৪ রানে নিয়ে গিয়েছিলেন পাক অধিনায়ক বাবর আজম। সুপার ওভারে এসে আমেরিকার বিরুদ্ধে এই ম্যাচ হারলেও, বাবর যে ফর্মে আছেন সেটা প্রমাণ হয়ে গিয়েছিল। আর উল্টোদিকে রিজওয়ান তো ফর্মে ছিলেনই। ফলে, ১২০ রানের টার্গেট তাঁদের কাছে ছিল খুবই সহজ। তবে, সেটাকে কঠিন করে তুললেন বুমরাহ। নিউ ইয়র্কের উইকেটে বাবরই হতে পারতেন নায়ক কিন্তু তাঁকে দ্বিতীয় ওভারেই ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বোলার। এরপর মহম্মদ রিজওয়ান যখন দলকে জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বোল্ড করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন বুমরাহ। ফলে, দুটো বড় উইকেটের চাপে পড়ে অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে যায় পাকিস্তান।

আরও পড়ুন- থাপ্পড়: দ্য পাওয়ার অব কমনম্যান

শেষ ওভারে ভয়ানক সুন্দর বোলিং

শেষ ওভারে বুমরাহ যা করেছেন তা সত্যিই 'ভয়ানক' সুন্দর। ইফতেখার আহমেদকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিয়ে তিনি ম্যাচের ফলাফল নিশ্চিত করে দেন। সেই সময় যেখানে ১৯ নম্বর ওভারে পাকিস্তানকে মেরে খেলতে হতো সেখানেই, ম্যাচের রান গতি একেবারেই কমে যায়। এর আগের সিরাজের ওভার থেকে কিছুটা রান করেছিল পাকিস্তান। তাই আশা ছিল পাকিস্তানের শেষ ভরসা ইফতেখার কিছু একটা করে দেখাবেন কিন্তু হলো না কিছুই। বদলে ওই এক ওভারে ম্যাচের ফলাফল নিজেদের পক্ষে করে নেয় ভারত।

বুমরাহর অসাধারণ দক্ষতা

দুরন্ত গতি, দারুণ অ্যাকুরেসি, সঠিক লাইন ও লেন্থে সিম, সুইং এবং বাউন্স করানোর ক্ষমতা, একেবারে পারফেক্ট ইয়র্কার দেওয়ার ক্ষমতা এবং তার থেকেও বড় একজন ব্যটারকে রিড করার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে বুমরাহর। ভারতীয় উপমহাদেশে এখন বহু ফাস্ট বোলার থাকলেও, এতটা দক্ষ হয়তো কেউই নন। সেই কারণে, নিজের দুরন্ত দক্ষতায় ক্রিকেট বিশ্বে রাজ করবেন বুমরাহ, সেটাই স্বাভাবিক। ভারতের টিমে বুমরাহ যে থাকবেন, সেটা একেবারে চোখ বন্ধ করে বলে দেওয়া যায়। রোহিত শর্মার কাছে বুমরাহের ২৪ টা বল যেন এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটা ফিক্সড ডিপোজিটের মতো। রোহিত জানেন, যখনই দরকার পড়বে উইকেটের, তখনই পাশে পাবেন বুমরাহকে। তাই, হয়তো প্রতিটি ম্যাচের আগেই বলে দেওয়া যায়, বিপক্ষের বিরুদ্ধে তিনিই হবেন ভারতের প্রধান অস্ত্র। তবুও, কীভাবে যে তাঁর বোলিং আটকানো যায়, সেটা বিশ্বের কোনও ব্যাটারই হয়তো জানেন না। অন্যরকম অ্যাকশনের কারণে একটা এক্স ফ্যাক্টর তো আছেই, তার সঙ্গে আছে এত দক্ষতা। ফলে, বর্তমানের ক্রিকেট দুনিয়া যে তাঁর সাম্রাজ্য, তা বলতে দ্বিধা নেই।

More Articles