টাইব্রেকার-সাডেন ডেথ: সাফ কাপে যে ভাবে ভারতের স্বপ্নপূরণ

SAFF Championship 2023: সাফ ফুটবলে ভারতের মুকুটে জুটে গেল চ্যাম্পিয়নের পালক। ফাইনালে কুয়েতকে পিছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হল ভারত।

ভারতের বহু পুরনো খেলা ফুটবল। সেই নিয়ে বাঙালি তো বটেই, আপামর ভারতেরই নস্টালজিয়ার কোনও শেষ নেই। অথচ বিশ্ব ফুটবলে ভারতের অংশগ্রহণ প্রায় শূন্য। বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে তুই না মুই লড়াই, পাড়ায় পাড়ায় পতাকা-যুদ্ধ, ওই পর্যন্তই। কিন্তু বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে ভারতের উঠে আসা শুধু স্বপ্নই নয়, প্রায় ইউটোপিয়া।

তার পরেও তো স্বপ্নপূরণ হয়। দুধের সাধ ঘোলে মেটে। যেমন ঘটেছে সোমবার। সাফ ফুটবলে ভারতের মুকুটে জুটে গেল চ্যাম্পিয়নের পালক। ফাইনালে কুয়েতকে পিছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হল ভারত। বিশ্বকাপের মর্যাদার না হলে ফুটবলের মঞ্চে সাফ কাপের দাম কিন্তু কিছু কম নয়। সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন চ্যাম্পিয়নশিপ। ১৯৯৩ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সাফ কাপ চ্যাম্পিয়নশিপে। প্রথম বছরেই সেরার শিরোপা ছিনিয়ে আনে ভারত। বরাবরই এই চ্যাম্পিয়নশিপে ভারত ভালো ফল করে আসছে। কালকের জয় ধরলে এখনও পর্যন্ত ৯ বার এই কাপ জিতেছে ভারত। যা কার্যত রেকর্ড জয়।

 আরও পড়ুন: এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…

মঙ্গলবার সাফ ম্যাচের ফাইনালে কুয়েতের মুখোমুখি হয় সুনীল ছেত্রীর ভারত। যদিও মঙ্গলবারের ম্যাচের নায়ক ছিলেন ভারতের গোলরক্ষক গুরপ্রীত সিং সান্ধু। অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে সাডেন ডেথে ভারতের জন্য ম্যাচ জিতিয়ে এনেছেন গুরপ্রীত। কাল ম্যাচের শেষ লগ্নে ছিল টানটান উত্তেজনা। যেমনটা হয় টাই ব্রেকারের ক্ষেত্রে। নির্ধারিত সময়ের পর অতিরিক্ত সময়, তার পর আবার টাই ব্রেকার। তবে তাতেও সমাধান সূত্র বের হয়নি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সাডেন ডেথ পর্যন্ত গড়ায় ম্যাচ।

টাই ব্রেকারে ভারতের হয়ে গোল করেছেন সুনীল, সন্দেশ ঝিঙ্ঘন, লালিয়ানজুয়ালা ছাঙতে এবং শুভাশিস বোস। সাাডেন ডেথে ভারতের তরফে ছিল গোলদাতা মহেশ সিংহ। কুয়েতের প্রথম শট-ই আটকে দেন গুরপ্রীত। দর্শকদের উত্তেজনা তখন তুঙ্গে। তবে টাই ব্রেকারের চতুর্থ শটটি নিতে গিয়ে দলের চাপ বাড়ান উদন্ত সিং। বারের উপর দিয়ে চলে যায় তাঁর শট। স্বাভাবিক ভাবেই সেই সুযোগ নিয়ে সমতায় ফেরে কুয়েত। শেষপর্যন্ত টাই ব্রেকার শেষ হয় ৪-৪ গোলে।

যে কোনও ম্যাচেই টাইব্রেকার এক ধরনের আলাদা উত্তেজনা তৈরি করে। তার পরে আবার সাডেন ডেথ। ফলে আন্দাজ করাই যায় দর্শকদের সে সময়ের উন্মাদনার পরিমাণ। সাডেন ডেথের প্রথম শটে ভারতকে এগিয়ে দেন মহেশ। এরপর কুয়েতের প্রথম শট রুখে দিয়ে দলকে জয়ের দিকে পৌঁছে দেন গুরপ্রীত।

ম্যাচের একেবারে প্রথমার্ধে ততটা আগ্রাসী রূপে দেখা যায়নি ভারতকে। বরং মন্থর ভাবেই শুরু হয়েছিল খেলা। ফাইনালে সুনীলদের আগ্রাসী খেলারই নির্দেশ দিয়েছিলেন কোচ ইগর স্তিমাচ। ভারত অবশ্য সে ধার মাড়ায়নি গোড়ায়। প্রথম ১৫ মিনিটের মাথায় গোল করে কুয়েত। আর তার পরেই নড়েচড়ে বসেন ভারতীয় খেলোয়াড়রা। ৩৮ মিনিটের মাথায় গোল করে ভারতকে সমতায় ফেরান ছাঙতে।

প্রথম গোলের সুযোগ পেয়েছিল ভারত। ম্যাচের ৪ মিনিটে সুনীলের হেড সরাসরি কুয়েতের গোলরক্ষকের হাতে যায়। এর মিনিট ২ পরেই কর্নার পায় ভারত। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। শুরুতে কুয়েতের দাপটই ছিল বেশি। ১৫ মিনিটে সুপরিকল্পিত আক্রমণ থেকে গোল করেন আলখালদি। পিছিয়ে পড়ে খেলার দখল নেওয়ার চেষ্টা করেন ভারতীয় ফুটবলারেরা। ১৯ মিনিটে সুনীলের শট আটকে দেন কুয়েতের গোলরক্ষক। তবে গুটিয়ে যায়নি ভারতীয় দল। সমানে সমানে লড়াই করে মাঝমাঠের দখল নিয়ে নেয় ভারত। তবে ৩৪ মিনিটে পেশিতে টান লাগায় মাঠ ছাড়তে বাধ্য হন আনোয়ার আলি। নির্ভরযোগ্য মিডফিল্ডার মাঠ ছাড়ায় কিছুটা ক্ষতি হয় ভারতের। যদিও অন্য ফুটবলারেরা হাল ছাড়েননি। ৩৮ মিনিটে সাহাল সামাদ একা বল নিয়ে অনেকটা উঠে পাশ দেন সুনীলকে। তিনি আবার বল ফিরিয়ে দেন সাহালকে। মঙ্গলবারই বর্ষসেরা ফুটবলার হওয়া ২৫ বছরের মণিপুরের ফুটবলার গোল করতে ভুল করেননি। ভারত সমতায় ফেরার পর কিছুটা গা-জোয়ারি ফুটবল শুরু করে কুয়েত। প্রথম থেকেই কড়া হাতে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণ করেছেন রেফারি। প্রয়োজনে কার্ড দেখাতে দ্বিধা করেননি। প্রথমার্ধের শেষ দিকে কুয়েতের কোচকেও হলুদ কার্ড দেখান তিনি। ১-১ ফলেই শেষ হয় প্রথমার্ধের খেলা।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকে দু’দলই কিছুটা সতর্ক ভাবে শুরু করে। ৪৮ মিনিটে ভারতের একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন কুয়েতের গোলরক্ষক। ৫২ মিনিটে সুনীলকে লক্ষ্য করে কুয়েতের বক্সে একটি ভাল বল বাড়ান সাহাল। কিন্তু ভারতীয় দলের অধিনায়ক বলের নাগাল পাননি। আক্রমণের ঝাঁঝ ছিল ভারতীয় দলেরই বেশি। ভারতের নাগাড়ে আক্রমণে কিছুটা চাপে পড়ে যায় কুয়েতের রক্ষণ। ৭১ মিনিটে মহেশ এবং রোহিত কুমারকে এক সঙ্গে মাঠে নামিয়ে রক্ষণ সংগঠন মজবুত করার চেষ্টা করেন ভারতের সহকারী কোচ মহেশ গাউলি। যদিও মাঠে নেমেই মাথা গরম করে হলুদ কার্ড দেখেন রোহিত। এক বার নয়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ কয়েক বার কার্ড দেখাতে হল রেফারিকে। আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ নির্ভর খেলা হলেও দ্বিতীয়ার্ধে গোল করতে পারেনি কোনও দলই। যদিও গোল করার মতো একাধিক পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন দু’দলের ফুটবলারেরাই। ফলে খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। গোল হয়নি অতিরিক্ত সময়ের প্রথম অর্ধেও। ৯৯ মিনিটে অবশ্য সুনীলের ফ্রি-কিক থেকে বল পেয়েও সহজ সুযোগ নষ্ট করেন উদান্ত।

 আরও পড়ুন: এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…

তবে দর্শকেরা আসল খেলা দেখেছে টাই ব্রেকার ও সাডেন ডেথে। সেখানেই মন ভালো করে ঘরে ফিরেছেন ফুটবলপ্রেমীরা। এমন টানটান উত্তেজনার ম্যাচের দেখা মিলল বহুদিন পর। আর ভারতের জন্য তো সেই আনন্দ ডবল। নবম বার সাফ কাপ জিতে সাউথ এশিয়ার মধ্যে দেশের নাম উজ্জ্বল করলেন ভারতীয় ফুটবলাররা। আর এভাবেই হয়তো ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে একদিন বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চ পর্যন্তও পৌঁছে যাবে ভারত। তখন আর ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা নয়, ভারতের অলিগলি শহরতলিতে টাঙানো থাকবে ভারতের পতাকা। এমন স্বপ্ন দেখতে কার না সাধ হয় বলুন।

More Articles