শান্তি ফিরছে মণিপুরে, বলছেন প্রধানমন্ত্রী, আসল সত্যটা কী?
Independence Day 2023, Manipur: কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। হিংসাও হয়তো মিলিয়ে যাবে একদিন রাষ্ট্রনেতার বিশ্বাসে।
দেশের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন। বহু মান্যগন্যরা আলো করে বসেছেন রাজপথে। স্বাধীন বাতাসে ফতফতিয়ে উড়ছে ভারতের তেরঙা। চলছে আজাদির অমৃত মহোৎসব। মঞ্চে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী। চারদিকে সাজো সাজো রব। জাতির উদ্দেশে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেবেন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন দেশের জনগণ দ্বারা নির্বাচিত দেশের মাথা তিনি। দেশের সমস্ত জাতি, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত বর্ণের মানুষের নেতা, প্রধানমন্ত্রী, মাইবাপ। সেই প্রধানমন্ত্রী অবশেষে কথা বললেন মণিপুর নিয়ে। বললেন তো বললেন সোজা স্বাধীনতার উদযাপনমঞ্চে। আজাদির অমৃত মহোৎসবে জায়গা করে নিল হিংসায়, রক্তে, মৃত্যুতে নিভে আসা ছোট্ট মণিপুর। সে কি কম বড় কথা।
আরও পড়ুন: একে একে একশো দিন, ইন্টারনেট নেই, মণিপুর যেমন আছে…
একদিন, দু'দিন নয়, টানা তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে জ্বলছে মণিপুর। জাতিহিংসার নামে ছারখার গোটা রাজ্য। কুকি না মেইতেই এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে পড়ে জ্বলছে বাড়ি, মেয়েদর উপরে চলছে অকথ্য অত্যাচার। কার্যত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে মেয়েরা। যখনতখন বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে এনে চলছে গণধর্ষণ। কখনও হিংসার বশে অন্তঃসত্তাকে মারধর করা হচ্ছে তো কখনও চোখের সামনে বাড়ির পুরুষদের গায়ে লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে আগুন। এসব চলছে নির্বিচারে। প্রশাসন তা নিয়ে বিশেষ কিছু বলেনি, কয়ওনি এতদিন। মুশকিলটা বাঁধল, নগ্ন মণিপুর কন্যাদের প্যারেডের ভিডিও ভাইরাল হওয়ায়। কথা পৌঁছলো সুপ্রিম কোর্টে। বাধ্য হয়ে মুখ খুলতে হল প্রধানমন্ত্রীকে। মণিপুরে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। আকারে ইঙ্গিতে এইটুকু বলেই দাড়ি টানলেন তিনি। তিন মাস ধরে চলা হিংসাদীর্ণ মণিপুরের জন্য আধা মিনিট বরাদ্দ করলেন মোদি। তা তা-ও কি কম কথা নাকি! ভুবনের ভার যার কাঁধে তাঁদের এসব ছোট ছোট ঘটনা ধরে বসে থাকার সময় আছে নাকি!
দলের শীর্ষনেতৃত্বের সায় পেতেই সামান্য মাথা নাড়লেন বিজেপি শাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। মোদী বললেন দোষীদের শাস্তি হবে। মোদীর কথার রেশ টেনে তিনিও বললেন, হ্যাঁ, দোষীদের শাস্তি তো হবে। ব্যাস, কথাবার্তার জল গড়াল ওই পর্যন্তই। সমস্ত হিংসা থামানোর সহজ দাওয়াই কার্ফু, ১৪৪ ধারা, ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত এইসব টোটকা-টোটেম তো ছিলই মণিপুরের জন্য।
কিন্তু বিরোধীরাই বা ছাড়বেন কেন! একটা কিছু তো মিলল অ্যাদ্দিনে, যা দিয়ে কোণঠাসা করা যাবে কেন্দ্রে আসীন বিজেপি সরকারকে। অমনি নানা দলের প্রতিনিধি দল ছুটল মণিপুরে। তাঁরা গ্রাউন্ড জিরো লেভেলে নেমে খুঁজে আনল বিজেপির নানা খুঁত ও ফাঁক। মণিপুরবাসী কী চায়, শান্তি ফেরাতে কী কী পদক্ষেপ করা যেতে পারত বা এখনও পারে, সেসব প্রশ্ন ঝুলতে লাগল পোস্টের তারে, রাস্তায়। এসবের জন্য তো পরেও সময় মিলবে ঢের। তবে আগের কাজ আগে করা চাই। বিরোধীরা কোমর বেঁধে নামল সংসদে। এইবার চেপে ধরা যাবে বিজেপিকে ভালোই।
এবার বিজেপির পাল্টা দান দেওয়ার পালা। সেই খেলায় আস্তিনের লুকানো গুটি আদতে ঔদাসিন্য। মণিপুর প্রসঙ্গে গোড়া থেকেই যা দেখিয়ে এসেছে বিজেপি সরকার। লাশেদের ভিড়ে উপচে গিয়েছে মণিপুরের একাধিক মর্গ। মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য কোনও মানুষ বাকি নেই গ্রামে। সবাই যে যার মতো প্রাণ হাতে করে পালিয়েছেন রাজ্য ছেড়ে। ভিড় করেছে পড়শি রাজ্যে। এই পরিস্থিতিতে মেয়ে-বৌয়ের সম্মানের ঝুঁকি নিয়ে কে পড়ে থাকবে বাসভিটেয়, কে চিনিয়ে দেবে মৃত ভাইয়ের দেহ! সেই দেহগুলিকে সসম্মানে সৎকার করার ব্যবস্থা করে সরকার, এই মর্মে কতবার দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপির প্রধান সেনাপতিকে চিঠি লিখেছে বিভিন্ন মানবাধিকার দল। না, সে চিঠি সম্ভবত খুলেও দেখেননি অমিত শাহ। এ ক্ষেত্রেও ব্রহ্মাস্ত্র ছিল উদাসীন নীরবতা। পরে অবশ্য কুকি মৃতদেহগুলির জন্য গণকবরের ব্যবস্থা করেছিল মণিপুর প্রশাসন, সে নিয়ে ফের অশান্তি দানা বাঁধে মণিপুরে।
যাই হোক, বিরোধীদের চাপের মুখে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বাধ্য হলেন মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতে। দশ মিনিট বরাদ্দ করলেন তিনি মণিপুরের জন্য। বললেন, রাজ্যে হিংসার ঘটনাক্রম স্পষ্ট। অনেক পরিবার স্বজন হারিয়েছে, মহিলাদের উপর অত্যাচার হয়েছে, নিন্দনীয় পরিস্থিতি। শান্তি ফেরার বার্তা দিতে না দিতেই মণিপুরের জন্য বলার সময় শেষ। ঘণ্টা বেজে গেল। মোদি পড়লেন অন্যান্য রাজনৈতিক জটিল সব অঙ্ক, জোট, বিরোধী জোট, ভোট, ভোটব্যাঙ্ক, ইউপিএ সরকার, ইন্ডিয়া জোট- এমনই সব দারুণ জরুরি সব ব্যপার নিয়ে। মণিপুর থাকল মণিপুরেই। তিমির তিমিরেই।
আরও পড়ুন: ভারতের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস! কিছুই কি বদলাবে মণিপুরে?
কিন্তু নিন্দুকেরা যাই বলুক, দেশের মাইবাপের কৃপাদৃষ্টি রয়েছে প্রায় সব দিকে। তাঁর চোখে সবাই সমান। তাই তো স্বাধীনতা উদযাপনের মতো সম্মানজনক মঞ্চে মোদি বললেন মণিপুরের কথা। দেশের প্রতি লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে তিনি জানালেন, শান্তি ফিরছে মণিপুরে। স্বীকার করে নিলেন বেশ কিছু সপ্তাহ ধরেই মণিপুরে হিংসার ঘটনা ঘটেছে, অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন, মা-বেটিদের সম্মানের সঙ্গে খেলা হয়েছে। কিন্তু এরপরেও কিন্তু আছে। মোদি জানালেন, গত কয়েকদিন ধরেই শান্তির পরিবেশ বজায় রয়েছে মণিপুরে। সেই শান্তির ধারা বজায় রাখারই আবেদন করেন তিনি মণিপুরের মানুষের কাছে। তার আশ্বাস, দেশ মণিপুরের সঙ্গে আছে। তিনি বিশ্বাস করেন, শান্তির পথেই মিলবে সমাধান। আর সেই সমাধান আসবে রাজ্য-কেন্দ্র সরকারের লাগাতার প্রয়াসেই।
হ্যাঁ, কথায় তো বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। হিংসাও হয়তো মিলিয়ে যাবে একদিন রাষ্ট্রনেতার বিশ্বাসে। দেশের ৭৬তম স্বাধীনতা দিবসে মণিপুরবাসীর জন্য সেই এক ব্যাগ বিশ্বাস রেখে গেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।