বিস্ফোরক! সুনীল ছেত্রী নন, ভারতীয় ফুটবল দল বাছাই করেন জ্যোতিষী?

Indian Football Astrologer: কোচ স্টিমাক তাঁর দল চূড়ান্ত করার আগে জ্যোতিষীর পরামর্শ চেয়েছেন এবং আঘাতের খবর জানানোর পাশাপাশি কার জায়গায় কাকে খেলানো যায় তাও জানিয়েছিলেন।

২০২১, ৯ জুন। ভারতের জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ইগর স্টিমাক একটি মেসেজ পাঠান দিল্লির এক নম্বরে। মেসেজটি বস্তুত এক তালিকা। খেলোয়াড়দের নাম-সহ বিশদে বেশ কিছু তথ্য লেখা। সঙ্গে একটি অনুরোধ, “Hi dear friend, you can check charts for each player from the list for 11 June. Kick off time is at 20.30.” এর ঠিক ২ দিন পরে, মানে ১১ জুন কলকাতায় আয়োজিত হয় এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ। ভারতের মুখোমুখি হয় আফগানিস্তান। এই গুরুত্বপুর্ণ ম্যাচের ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে এমন মেসেজ কাকে পাঠান স্টিমাক?

দিল্লি এনসিআরের জ্যোতিষী ভূপেশ শর্মাকে মেসেজটি পাঠিয়েছিলেন ইগর স্টিমাক। অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনের জনৈক শীর্ষ কর্মকর্তাই জ্যোতিষীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন ভারতের ফুটবল কোচের। স্টিমাক ওই তালিকাটি জ্যোতিষীকে পাঠান কারণ, এই ম্যাচটি তাঁদের জিততেই হতো। অত্যন্ত খারাপ ফর্মে ছিল দল, আঘাতে জর্জরিত খেলোয়াড়রা। এমন অবস্থায় ভারতকে অবশ্যই জিততে হবে। তাই শেষমেশ ভারতীয় ফুটবল দল আস্থা রেখেছিল জ্যোতিষে, ভাগ্যে, গ্রহতারায়!

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই দিল্লিবাসী জ্যোতিষী প্রতি খেলোয়াড়ের নাম ধরে ধরে উত্তর দেন। কে 'ভালো’; কে 'খুব ভালো', কাকে 'অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস এড়াতে হবে’; কে 'জঘন্য খেলবে'; কে 'খেলার যোগ্য নয়' সবটাই লিখে জানিয়ে দেন তিনি। সেই মতো, ১১ জুন কিক-অফের এক ঘণ্টা আগে, যখন ম্যাচের ফাইনাল টিম ঘোষণা করা হয়, দেখা যায় জ্যোতিষীর পরামর্শ মতোই, দু'টি বিখ্যাত নাম বাদ পড়েছে।

২০২২ সালের মে-জুন মাসে ইগর স্টিমাক এবং ভূপেশ শর্মার মধ্যে এমন শ'খানেকেরও বেশি মেসেজ বিনিময় হয়েছিল। ভারত এই সময় মোট চারটি ম্যাচ খেলে। জর্ডনের সঙ্গে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচ, হংকং, আফগানিস্তান আর কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের তিনটি ম্যাচ। প্রতিটি ম্যাচের আগে ইগর স্টিমাক ভূপেশ শর্মার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খেলার ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিচ্ছেন জ্যোতিষী? ফুটবলের মতো দলগত খেলায়, কঠোর পরিশ্রমের খেলার যোগ্যতা নয়, অনুশীলন নয়, দামী হয়ে উঠছে গ্রহের অবস্থান, ঠিকুজি কুষ্টি!

আরও পড়ুন- এক ম্যাচে ৪৪ টা পেনাল্টি! ফুটবলের ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে যে ম্যাচ…

'দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' এই বিষয়ে বিস্তারিত এক রিপোর্ট সামনে এনেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে মেসেজগুলির একটি নির্দিষ্ট ধরন রয়েছে। প্রতিটি ম্যাচের আগেই কোচ স্টিমাক তাঁর দল চূড়ান্ত করার আগে জ্যোতিষীর পরামর্শ চেয়েছেন। চোট-আঘাতের খবর দিয়েছেন। পাশাপাশি কার জায়গায় কাকে খেলানো যায় তাও জানিয়েছিলেন।

একটি মেসেজে স্টিমাক লিখেছেন, “Hi dear Bhupesh, it was a pleasure meeting you and discussing future work! I would kindly ask you to provide opinion on the following players.” এই লিখে স্টিমাক চারজন খেলোয়াড়ের জন্ম তারিখ, সময় এবং স্থান উল্লেখ করেন। এই চারজনের মধ্যে তিনজন ফুটবলার ২০১৭ সালের ফিফা অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

২০২২ সালেই ২৮ মে, জর্ডনের বিরুদ্ধে বন্ধুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে স্টিমাক ২৪ জন খেলোয়াড়ের তালিকা পাঠান বিস্তারিত তথ্য লিখে। ভূপেশ শর্মা নিজের সুপারিশ পাঠানোর পরে স্টিমাক আবার এই খেলোয়াড়দের আঘাতের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে দুই ফুটবলারের ফিটনেসের বিবরণ মেসেজে লিখে পাঠান।

মেসেজে হওয়া কথোপকথন থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ওই জ্যোতিষীই ঠিক করে দিতেন কোনদিন কার ডিফেন্সে খেলা উচিত, কোনদিন মিডফিল্ডারের জন্য মোটেও সুদিন নয়। স্টিমাক ভারতীয় খেলোয়াড়দের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখতে বলতেন ওই জ্যোতিষীকে। ভূপেশ শর্মা কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের পছন্দের খেলোয়াড়দের কথা জানাতেন। দেখা যায়, এমনই এক ফুটবলার, যার গ্রহ নক্ষত্র নড়বড়ে বলে জানিয়েছিলেন ভূপেশ, তিনি জর্ডনের বিপক্ষে খেলা শুরুই করেননি। দ্বিতীয়ার্ধে তাঁকে বিকল্প হিসেবে আনা হয়।

এত জ্যোতিষচর্চা করে ভারতের খেলার অবস্থা কী হলো? ২৮মে-র সেই খেলায় ভারত হেরে যায়। ৮ থেকে ১৪ জুন কলকাতায় এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের আগে স্টিমাক ও ভূপেশ প্রতি খেলার দু'দিন আগে দেখা করার এবং আলোচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

৮ জুন কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে বাছাইপর্বের প্রথম ম্যাচের আগে, স্টিমাক রিজার্ভ খেলোয়াড়দের তালিকা-সহ তাঁর পছন্দের ১১ জনের নাম পাঠান। ১২ জুন, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় খেলায় ভারত জেতে। হংকংয়ের বিরুদ্ধেও ম্যাচের আগেও ভারতের ১১ জনকে নিয়ে আলোচনা করতে বসেছিলেন স্টিমাক ও জ্যোতিষী। ভারত সেই খেলায় জিতে এশিয়ান কাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।

আরও পড়ুন- ৬ গোল হজমের শাস্তি! ভক্তদের পাথরবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে গিয়েছিল ফুটবলাররা…

সেই সময় AIFF-এর সভাপতি ছিলেন প্রফুল্ল প্যাটেল। তিনি অবশ্য এই জ্যোতিষী কোচের ভাব-আবেগ আদান প্রদান সম্পর্কে নাকি কিছু জানতেন না। AIFF-এর সাধারণ সচিব কুশল দাস স্বীকার করেন তিনিই ২০২২ সালের মে মাসে ভূপেশ শর্মার সঙ্গে কোচ স্টিমাকের পরিচয় করিয়েছিলেন। এই ভূপেশ শর্মা যে কেবল ভারতীয় ফুটবলের ভবিষ্যৎ ঠিক করেন তাই নয়। অনেক টেলিকম সংস্থা এবং বলিউড তারকাদেরও গ্রহতারা বিচার করে পরামর্শ দেন। সিনেমায় সই করবেন কিনা, টাকার মুখ দেখবেন কিনা, ইত্যাদি তিনিই ঠিক করেন। তাই ভারতীয় ফুটবলের হর্তাকর্তারা ভাবতে শুরু করেন, বিশ্বাস করতে শুরু করেন জ্যোতিষশাস্ত্র মেনে সময় এবং খেলোয়াড়দের বর্তমান পর্যায় বুঝেই ভারত ময়দানের লড়াই জিতবে। এমনকী কোচ, যিনি নাকি খেলোয়াড়দের তৈরি করবেন, সেই ইগর স্টিমাকও দলের হাল ছেড়ে দেন ভূপেশের হাতে!

এই আধিকারিকরা বলছেন, সেই মুহূর্তে AIFF আর কোচ দু' তরফেরই ধ্যানজ্ঞান ছিল ভারতের জয়, যেনতেন প্রকারেণ। তাই ভূপেশ শর্মার সঙ্গে কোচের আলাপ করানো, জ্যোতিষীর পরামর্শ মেনে দলের ভাগ্য নির্ধারণ! আর ইগর নিজেও "এসবে খুব বিশ্বাসী"।

স্টিমাক অবশ্য বলছেন, একজন বিদেশি সহকারী কোচ আনার অনুরোধ করেছিলেন তিনি। সেসবে AIFF কান দেয়নি। ভূপেশের সঙ্গে এই ফেডারেশনের চুক্তি দেখে তিনিও অবাক হয়ে যান! দুই মাস ধরে এই গ্রহতারা মাপজোক করার জন্য প্রায় ১২-১৫ লক্ষ টাকা পেয়েছেন ভূপেশ। তবে AIFF বলছে, এই অঙ্ক কিস্যু না তাঁদের কাছে। ভারতের এশিয়ান কাপের জন্য যোগ্যতা অর্জনের সামনে এসব টাকাপয়সা নস্যি।

More Articles