ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
ছেলেটি দামাল | বনবাদাড়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় | শুধু তাই নয়, তার এসবের সঙ্গী যারা, তারা সমাজের চোক তথাকথিত ভদ্রলোক নয় কখনই | এমনকি অনেকে একই ধর্মেরও নয় | অথচ ছেলেটির সেদিকে কোনও খেয়াল নেই | আসলে সেই বয়স থেকেই ছেলেটি মিশতে চায় তাদের সঙ্গে যাদের এড়িয়ে চলে তথাকথিত ভদ্রলোকেরা | জানতে চায় তাদের কথা ---- যাদের কথা ভাবতে চায় না এই ভদ্রসমাজ |
ছেলেটির নাম প্রবোধ কুমার | বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলির চাকরি | কোনও জায়গাতেই বেশিদিন থাকা হয় না | অবিভক্ত বাংলার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে হয় কিছু দিন পরপরই | তাই তাঁর পরিবারকেও পড়াশোনার যথেষ্ট অসুবিধে হয় | একমাত্র প্রবোধকুমাকেই এতে খুশি হতে দেখা যায় |
খুশি হওয়ার কারণ, নতুন নতুন জায়গায় যাওয়া মানেই নতুন নতুন বন্ধু আর সেইসব জায়গার জলজঙ্গল ইত্যাদিতে অবাধে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ |
প্রবোধ প্রথম থেকেই সাহসী | তাই অন্যরা যেখানে যেতে ভয় পায়, সেখানেই সে ছুটে যায় সকলের আগে |
চাকরির সূত্রে হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় বদলি হয়ে আসেন সাঁওতাল পরগনার দুমকায় | সেখানেই ১৯০৮ সালের ১৯ শে মে প্রবোধকুমারের জন্ম | ১৪জন ভাই-বোনের মধ্যে প্রবোধ ছিল পঞ্চম | তার মা নিরোদা দেবী তাকে আদর করে মানিক বলে ডাকতেন | মানিকও তার মাকে খুবই ভালবাসত | কিন্তু অতজন ভাইবোন থাকার কারণে, যারা আবার বেশিরভাগই তার চেয়ে ছোট, মন চাইলেও মাকে বিশেষ একটা কাছে পেত না তার মানিক | এই জন্য বরাবর তার মনে একটা খেদ থাকত |
মানিকের যখন ষোল বছর বয়স, তখন তার মা মারা গেলেন | মায়ের এই আকস্মিক মৃত্যু কোনও মতেই মেনে নিতে পারলনা মানিক | মানিক এমনিতেই ছিল দুরন্ত ও দুঃসাহসী | মাকে হারানোর বেদনায় সে আরো বাউন্ডুলে হয়ে গেল | তার মনে ধারণা জন্মালো যে এত বড় সংসারের ধকল সৈতে পারেননি বলে তার মা এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন | এই ধারণার বশবর্তী হয়ে বাড়ির সকলের উপর মানিকের একটা রাগ এবং বিতৃষ্না জন্মালো | আর তাই সকলের সঙ্গে বাড়ল দূরত্ব | একটা সময় বাড়ির সকলের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে পথেই বেড়িয়ে পড়ল মানিক |
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর মানিকের বেপরোয়া ভাব একটু শান্ত হলো | সে আবার বাড়ি ফিরে এলো এবং পড়াশুনা শুরু করল | বাবার বদলির চাকরির কারণে মানিকের পড়াশুনা কোনও একটি জায়গায় কোনও একটি নির্ধিষ্ট স্কুলে হয়নি | স্কুল জীবনের শুরু দুমকায় হলেও তার পরে সাতবার স্কুল পাল্টাতে হয়েছে মানিককে | একেকটি স্কুল মানে একেকটি পরিবেশ | একাক জায়গায় একাক ভাষার প্রাধান্য | কোনও কোনও জায়গার স্কুলে হিন্দি ভাষার প্রাধান্য, কোথাও বাঙাল ভাষা আবার কোথাও এদেশী পশ্চিমবঙ্গীয় ভাষা | এই রকম নানা ভাষার প্রাধান্যের স্কুলে পড়ার কারণে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাতেই মানিকের যথেষ্ট ধক্ষতা জন্মায় | অবশ্য মানিকের আদি বাড়ি ছিল ঢাকায় | তারফলে স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে বাঙাল ভাষার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল তার |
এইভাবে বাবার সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে মানিক একটু থিতু হয়ে এসে বসল মেদিনীপুর জেলায় | মেদিনীপুর জেলা স্কুল থেকেই মানিক প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় এবং ১৯২৬ সালে ১৮ বছর বয়সে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয় | মানিক অঙ্কে বরাবরই ভাল ছিল | এই পরীক্ষায় সে অঙ্কের অবশ্যিক এবং ঐচ্ছিক --- দুটি পত্রেই লেটার মার্ক্স্ পায় | বাবার বদলির চাকরি, মায়ের অকাল মৃত্যু এইসব বিগ্ন থাকা সত্ত্বেও মানিক পড়াশুনায় যথেষ্ট দক্ষ ছাত্র বলে পরিচিত ছিল |
প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আই-এস-সি পড়ার জন্য বাঁকুড়া জেলায় ওয়েলেসলিয়ার মিশন কলেজে ভর্তি হয় | এই কলেজের এক অধ্যাপক ছিলেন জ্যাকসন সাহেব | তিনি মানিকের মধ্যে এক প্রতিভার সন্ধান পেয়েছিলেন | তাই তিনি মানিককে কলেজের নির্ধিষ্ট পাঠ্য বিষয়ের বাইরেও অনেক বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন | তিনি মানিককে খুব স্নেহও করতেন | মাতৃহারা মানিক সেই স্নেহ পেয়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিল | জ্যাকসন সাহেব সেই সময় মানিকের মনোযোগ বাইবেলের প্রতি আকৃষ্ট করেন | মানিকও অতন্ত্য মনোযোগ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে বাইবেল গ্রন্থটি পাঠ করেছিল | তারফলে মানিকের দৃষ্টি ভঙ্গি অনেক স্বচ্ছ ও প্রসারিত হয়েছিল | এইভাবেই নিত্য নতুন বিষয় নিয়ে চর্চা করবার একটা আগ্রহ মানিকের মধ্যে জেগে উঠেছিল | এরই ফলশ্রুতি হিসেবে মানিক পরবর্তীকালে মার্ক্সবাদ নিয়ে রীতিমতো চর্চা করেছিল |
ওয়েলেসলিয়ার মিশন কলেজ থেকে ১৯২৮ সালে আই-এস-সি পরীক্ষায় প্রথম ভাগে উত্তীর্ণ হয় | প্রত্যেকটি বিষয়ই সে খুব ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করে | এরফলে সে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অঙ্কে অনার্স নিয়ে সহজেই ভর্তি হতে পারে |
দুর্ভাগ্যের বিষয় আর্থিক অনটনের কারণে এত ভাল কলেজে পড়াশুনার ব্যবস্থাতেও ছেদ পরে গেল | শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি-এস-সি পরীক্ষা আর দেওয়া হলো না | সংসারের অভাব মেটাতে সে বাধ্য হলো ময়মংসিংহ জেলার একটি স্কুলে চাকরি নিতে |
মানিকের বরাবরই বিজ্ঞান বিষয় পড়াশুনার ঝোক ছিল | কিন্তু ছোটবেলা থেকেই মানুষের অভাব অনটন দেখে দেখে তার মধ্যে একটি দরদী মন গড়ে উঠেছিল | সে অতন্ত্য অনুভূতি প্রবন ছিল | কিন্তু তার সেই অনুভূতি বা মানসিক কষ্ট অথবা কোনও বিষয়ে ভাল লাগার কথা কখনও কারো কাছে প্রকাশ করতে পারত না | অনেক সময় এইকারণে লোকে তাকে ভুল বুঝতো | এই ভুল বোঝাবুঝি তার মনের ভেতর আরও বেদনার সৃষ্টি করত |
এই মানসিক বেদনাই তার লেখার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করল | সভাবে সে যত নিরুচার ছিল, তার কলম তত সরব হতে শুরু করল | চারপাশের দেখা অন্যায় অবিচার তাকে মানসিক ভাবে অতন্ত্য আলোড়িত করত | এদিকে প্রকৃতি জগৎ এবং মানুষ ---- দুইয়ের প্রতি তার ছিল গভীর টান | ফলে সে যখন সাহিত্যের আঙ্গিনায় পা রাখলো তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার লেখার মধ্যে দিয়ে তার দেখা পরিবেশ, তার দেখা চরিত্রগুলো আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করল | এই সব চরিত্র এই সব পরিবেশগুলো প্রকাশিত হওয়ার জন্য মানিকের মনে অবিরত ঢেউ তুলতো | আর সেই ঢেউয়ের ধাক্কায় সে যেসব গল্প এবং উপন্যাস লিখতে শুরু করল তার মধ্যে সব চরিত্রগুলোই জীবন্ত হয়ে উঠতো |
তখন মানিকের বয়স ২০ বছর তখনও সে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র | কলেজ ক্যান্টিনে এতদিন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব হচ্ছিল | কোথায় কোথায় 'বিচিত্রা' পত্রিকার প্রসঙ্গ উঠল | বিচিত্র তখন বাংলার অন্যতম সেরা পত্রিকা | বাংলার খ্যাতনামা লেখক ছাড়া অন্য কোনও লেখকের লেখা ছাড়া প্রকাশিত হতো না | সেকথা মনে রেখেই সেদিন এক বন্ধু মানিককে বললো ------ পারবে তোমার অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প লিখতে? পারবে সেই গল্প বিচিত্রা পত্রিকায় ছাপাতে | মানিক কিন্তু খুব শান্ত ভাবে সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করল এবং বলল যে সে পারবে |
এদিকে মানিকের মনে তোলপাড় শুরু হলো ----- কি বিষয় নিয়ে লিখবেন | অবশেষে লিখে ফেললেন একটি গল্প | কাউকে কিছু না জানিয়ে নতুন গল্পের পাণ্ডুলিপি নিয়ে চলে গেলেন বিচিত্রার অফিসে | কিন্তু মাত্র ২০ বছর বয়সে, পত্রিকা অফিসের পরিবেশ দেখে সম্পাদক মশাইয়ের সঙ্গে আর দেখা করার সাহস পেলেন না | তবে পাণ্ডুলিপিটি অফিসের লেটার বক্সে ফেলে দিয়ে চলে এলেন |
তিনি ধরেই নিয়েছিলেন গল্পটা পত্রিকায় চাপা হবে না | কিন্তু মাস চারেক বাদে সবাইকে অবাক করে দিয়ে গল্পটা প্রকাশিত হলো বিচিত্রা পত্রিকায় | গল্পটির নাম 'অতসী মাসি' | গল্পটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি হলো | পাঠকদের মনে হলো বাংলা সাহিত্যের জগতে এক সম্ভাবনাময় লেখকের আবির্ভাব হয়েছে |
তিনি কিন্তু নিজেকে কিছুটা গোপন করার জন্যই লেখকের নামের জায়গায় তার মায়ের দেওয়া আদরের নাম মানিকই ব্যবহার করেছিলেন | এমনি করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় --- এই নামের আড়ালে হারিয়ে গেল প্রবোধ বন্দ্যোপাধ্যায় |
পরের বছর প্রকাশিত হলো তার লেখা 'দিবারাত্রির কাব্য' | এই লেখা প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠল | এরপরে তাঁর কলম থেকে একের পর এক বেরোল অবিস্বরণীও সব সাহিত্য কীর্ত্তি ----- পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্দা নদীর মাঝি, প্রাগৈতিহাসিক, অমৃতস্যপুত্র, সরীসৃপ, শহরতলি, চতুষ্কোন, হরফ, ইত্যাদি উপন্যাস ও গল্প | তাঁর লেখা শেষ উপন্যাসের নাম 'মাশুল' | তিনি যে বাংলা সাহিত্যকে কিভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন তা বাংলা সাহিত্যের পাঠক মাত্রই জানেন | সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন চরিত্র ও পরিবেশ নির্মাণ এবং তার মধ্যে দিয়ে সেই চরিত্রগুলির মানসিক টানা পড়েন এবং পরিবেশের অস্থিররতা তিনি অনবদ্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলতেন | পুতুল নাচের 'ইতিকথা' এই উপনাস্যের চরিত্র হোসেনমিয়ার কথা পাঠকেরা আজও ভুলতে পারেনা |
কিন্তু সেযুগে লেখকেরা ভাল পারিশ্রমিক পেতেন না | তাঁরও নাম হলো, কিন্তু দারিদ্র্য ঘুচলো না | সাহিত্যই ছিল তাঁর একমাত্র জীবিকা | আর সেই জীবিকা থেকে তিনি কোনদিনই আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পাননি | অনেক রোগে ভুগতে ভুগতে এবং অভাব অভিযোগের তাড়নায় ১৯৫৬ সালে ৩ ডিসেম্বর, মাত্র ৪৮ বছর বয়সে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভে যায় |