কূটকচালির পাঁক নয়, মধ্যবিত্ত জীবনে ম্যাজিক ঘটিয়েছিল ভারতের প্রথম সিরিয়াল 'হামলোগ'!

First Indian Serial Humlog: আপামর মধ্যবিত্ত সমাজের স্বপ্ন, সংকট, মধ্যবিত্ত দর্শক শ্রোতার লড়াই বুনেছিল এই সিরিয়ালটি।

এক জমানায় রবিবার সন্ধা মানেই ঘাড়ে বগলে পাউডার আর সুগন্ধি মেখে সিনেমাহলের লাইনে টিকিট কাটা, ছুটির বিকেল মানেই থিয়েটার দেখা। সপরিবারে সিনেমা-নাটক দেখা ছিল অবসর বিনোদনের সেরা উপায়। তখন বড় পর্দায় রাজত্ব করছেন ভারত কাঁপানো নায়কেরা, হৃদয় কাঁপানো নায়িকারা। খলনায়কের পতন আর নায়কের চিরউত্থানের আখ্যানের পাশাপাশি প্রেম আসছে পর্দায়। পরিবারের কচকচানিও হয়ে উঠছে বিষয়। মূল্যবোধের পাঠ প্রচারে বড় পর্দাই ভরসা। ভরসার এই আলো হঠাৎ করে কিঞ্চিৎ নড়ে গেল ১৯৮৪ সালে। ভারতবর্ষ এক বিনোদন বিপ্লব দেখল। প্রথম ভারতীয় সোপ অপেরা এল বাজারে। যাকে এখন আমরা সিরিয়াল বলি, উদয়াস্ত একতা কাপুর আর জি বাংলার মুণ্ডপাত করি- সেই খেলার শুরু আজ থেকে প্রায় ৪০ বছর আগে। পরিবারকে একঘরে একসঙ্গে বসিয়ে গল্প বলতে শুরু করল ভারতীয় সিরিয়াল। ১৯৮৪ সালের ৭ জুলাই শুরু হওয়া ' হামলোগ' ছিল সেই সময়ের একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল দূরদর্শনে সম্প্রচারিত হওয়া সিরিয়াল।

ভারতীয়দের বিনোদনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল হামলোগ। সিনেমার পর্দা থেকে সোজা ঘরের একচিলতে সাদা কালো পর্দায় হাজির হয়েছিল ভারতীয় কাহিনি। বসার ঘরে টেলিভিশনের সামনে সপরিবারে বসে সিরিয়াল দেখার শুরুটা সেই থেকেই। তবে লার্জার দ্যান লাইফ না। তিনবার মাথা ঝাঁকিয়ে একই সংলাপ বলা না, উচ্চকিত মেকআপ না, কে কাকে কতটা বিপদে ফেলার ছক কষতে পারে সেই কূটকচালি না, বড়লোক ড্রয়িংরুমের গল্প নয়। হামলোগ ছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সংগ্রাম ও আকাঙ্খার গল্প। অল্প সময়ের মধ্যে এই সিরিয়ালের চরিত্র বাদকি, ননহে, চুটকি এবং লাজবন্তী ভারতীয় ঘর গেরস্থালির চেনা নাম হয়ে ওঠে। মানুষ নিজেদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলতে থাকেন এই চরিত্রদের।

আরও পড়ুন- মাত্র ৩৯-এই মৃত্যু, অথচ প্রথম ভারতীয় হিসেবে হলিউড কাঁপিয়েছিলেন এই মাহুত পুত্রই!

হামলোগ সিরিয়ালটি সেই সময়কার 'সমস্যা'গুলি নিয়েই মূলত মূল্যবোধ প্রচারের কাজটি করত। সিরিয়াল নির্মাতারা মদ্যপান, লিঙ্গ বৈষম্য, দারিদ্র্য, কুসংস্কার এবং জীবিকার নানা সম্ভাবনার মতো বিষয়গুলি দারুণ সূক্ষ্মভাবে পরিচালনা করতেন। মদ্যপ বাসেসার এবং ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখা নানহের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন ভারতীয়রা। প্রতিটি বাড়িতে পিতৃতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে পিষে যাওয়া মেয়েরা লাজবন্তীর চরিত্রে নিজেকে আবিষ্কার করতেন। প্রতিটি পর্বের শেষে, সেই সময়ের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেতা অশোক কুমার সেই দিনের বিষয় বিশ্লেষণ করতে পর্দায় হাজির হতেন। নিজের কৌতুকবোধ, অন্তর্দৃষ্টি এবং সবশেষ 'উপদেশ' দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছিলেন অশোক। নীতিকথার অডিও ভিজ্যুয়াল উপস্থাপন বললেও ভুল হবে না সেই সময়ের এই সিরিয়ালটিকে।

তৎকালীন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বসন্ত সাঠের ভেবেছিলেন গোটা বিষয়টি। হাম লোগের গল্প লেখেন লেখক মনোহর শ্যাম জোশী এবং পরিচাললা করেন পি. কুমার বাসুদেব। মূলত মিগুয়েল সাবিদো পরিচালিত মেক্সিকান শো ভেন কনমিগো থেকেই এই সিরিয়ালের গল্প অনুপ্রাণিত। সাবিদো ১৯৮৩ সালে একটি কর্মশালার জন্য নয়াদিল্লিতে আসেন। সেখানে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, টিভি শোগুলিকে জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন প্রচার করতেই হবে। তবে ততখানি ব্যবস্থাপনা না থাকায় হামলোগ দেখানো হতো প্রতি সপ্তাহে মাত্র একদিন। তাতেই ১৫০ পর্বের হামলোগ দেখেছিলেন ৫০ মিলিয়ন দর্শক!

ভারতীয় টেলিভিশনের স্বর্ণযুগের কথা বলতে গেলে হামলোগের নাম আসবেই যার এক এবং অন্যতম কারণ এর সামাজিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়বস্তু। ১৯৮০-র দশক থেকেই কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির ধারণা আসা শুরু করেছে। যৌথ পরিবারের অস্তিত্ব এবং জটিলতা দুই-ই তখন এলোমেলো। হামলোগ বলেছিল, হিন্দু মেয়ে মুসলিম পুরুষের প্রেমের কথা। দেখিয়েছিল নিচু জাতের মহিলাকে উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ের ইচ্ছার কাহিনি। বিতর্কিত, অথচ কী সহজ স্বাভাবিক বোধ!

মানুষ এই সিরিয়াল গ্রহণ করেছে কারণ এর ঘটনা জীবনের বাইরে নয়, আপামর মধ্যবিত্ত সমাজের স্বপ্ন, সংকট, মধ্যবিত্ত দর্শক শ্রোতার লড়াই বুনেছিল এই সিরিয়ালটি। ১৯৮৬ সালে এই হামলোগের পথেই হেঁটে শুরু হয়েছিল আরেক কিংবদন্তি সিরিয়াল বুনিয়াদ। দেশভাগ নিয়ে কাজ করেছিল এই সিরিয়াল। আসলে তখনও শিকড়বিমুখ হয়নি মানুষ। তখনও দেশভাগের যন্ত্রণা আর উদ্বাস্তু হয়ে আসার দগদগে ঘা দেহে নিয়েই বাঁচছে দেশের মানুষ। একে একে এল ফৌজি, শাহরুখ খানকে করে তুলল বাড়ির ছেলে। কমেডি শো ইয়ে জো হ্যায় জিন্দেগি, বিক্রম বেতাল এবং মালগুড়ি ডে'জ-এর মতো সিরিয়াল কয়েক প্রজন্মের মানুষের বিনোদনের সংজ্ঞা পালটে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন- বাংলা সিরিয়ালের তিন দশক || কী ছিল কী হইল…

১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়া, পরাধীন চেতনা থেকে স্বাধীন জাতি গঠনের প্রক্রিয়া তখনও তো শেষ হয়নি। ভাষা, অঞ্চল, বর্ণ, শ্রেণি এবং ধর্মে ধর্মে বিভাজিত দেশে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন মানুষকে জুড়তে পারত একমাত্র সমষ্টিগত মূল্যবোধ। টেলিভিশন সিরিয়াল এই মূল্যবোধকে পরিবেশন করেছিল সাংস্কৃতিক মোড়কে। ১৯৯০ এর দশকে দেশে বেসরকারি চ্যানেলের প্রবেশ ঘটল। স্যুইচ বদলাতেই বদলে দেতে থাকল বিনোদনের ধারা। আঞ্চলিক তো বটেই এবং আন্তর্জাতিক চ্যানেলও উঠে এল ভারতীয় ড্রয়িং রুমে। বদলাতে শুরু করল সিরিয়ালের বিষয়। ১৯৯৫ সালে সম্প্রচারিত ‘তারা’ সিরিয়ালটি সেই সময়ের শহুরে মহিলাদের সমস্যার গল্প বলল। 'হাসরতে' সিরিয়ালে উঠে এল বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের বিষয়টি। উদারনীতি এল, সঙ্গে নিয়ে এল মূল্যবোধ পালটে ফেলার সুডৌল হাতছানি। মধ্যবিত্তের সংগ্রাম নয়, বরং নাগালের বাইরে থাকা যাপনকে পাইয়ে দেওয়ার লোভে এমন কাহিনি বলা হতে থাকল যা আসলে বিভেদের, ঘৃণার কিসসা। সম্পর্কে চিড় ধরানো সন্দেহকে বাড়ির বসার ঘরে সযত্নে ঢুকিয়ে দিল সিরিয়াল। সময় গড়াল, সিরিয়াল আর পারিবারিকও রইল না।

তবে এই জনপ্রিয় সিরিয়ালের পর্বগুলি কোনও এক কারণে রেকর্ড করা হয়নি। তাই চাইলেও কোনওদিনই মানুষ আর সেই সিরিয়াল নতুন করে দেখতে পারবেন না। যারা দেখেছেন, তারা জানেন এখনকার বোধ আর সিরিয়াল দুইয়ের সঙ্গেই কী আলোকবর্ষ দূরত্ব সেই সবের। এখন 'হামলোগ' ধারণাটিই ‘আমি'র দাপটে বেচারা ম্রিয়মাণ। কোনও সিরিয়ালের ক্ষমতাই বা কোথায় তার দুর্দশা ঘোচায়!

More Articles