দেশের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' এখন এই ব্যক্তিই! খালিস্তানের দাবিকে ঠেকাতে পারবে ভারত?

Khalistan Movement: বহু শিখ বিশ্বাস করতেন খালসা রাজ কোনও না কোনও দিন ঠিক ফিরে আসবে।

এই মুহূর্তে ভারতের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' চরিত্র অমৃতপাল সিং। আর ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ, পঞ্জাবকে কি ধরে রাখা যাবে? সোমবার দুপুর পর্যন্ত মোবাইল ইন্টারনেট এবং এসএমএস পরিষেবা স্থগিতা করে দিয়েছে পঞ্জাব সরকার। সারা পঞ্জাব তো বটেই, দেশজুড়ে খোঁজা হচ্ছে অমৃতপাল সিংকে। উগ্র শিখ প্রচারক এবং খালিস্তানপন্থী অমৃতপাল সিংয়েরর নেতৃত্বে একটি সংগঠনের ৭৮ জন সদস্যকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে পঞ্জাব পুলিশ। অমৃতপাল পলাতক, তবে তাঁর দু'টি গাড়ি রয়েছে পুলিশের হেফাজতে। কিন্তু কে এই অমৃতপাল সিং? খালিস্তানই বা আসলে কী? হঠাৎ করে ফের বিচ্ছিন্নতার দাবি কেনই বা উঠছে ভারতে?

খালিস্তান আন্দোলন হচ্ছে এক শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। পঞ্জাব অঞ্চলে খালিস্তান (খালসার ভূমি) নামে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই দলের সমর্থকরা। প্রস্তাবিত যে অঞ্চল গঠিত হবে তাতে থাকবে বর্তমান পঞ্জাব, ভারতের পঞ্জাব, এবং রাজধানী লাহোরসহ পাকিস্তান। এটি পঞ্জাবের আগেকার ভৌগোলিক অঞ্চলেই অবস্থিত হবে, যেখানে আগে খালসা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

১৯৮০-র দশকে এই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পালে হাওয়া পায়। এই আন্দোলন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়া শুরু করতেই খালিস্তানপন্থীরা চণ্ডীগড়, ভারতীয় পঞ্জাবের অংশ, সমগ্র উত্তর ভারত এবং পশ্চিম ভারতের কিছু অংশকেও নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তবে ১৯৮০ নাগাদ জনপ্রিয়তা পেলেও এর ইতিহাস লুকিয়ে ১৬৯৯ সালে। গুর গোবিন্দ সিং খালসার ঘোষণা করেন। তাঁর মতবাদের যে ধর্মীয় তথা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তা শিখদের কল্পনাকে এক নয়া বিশ্বাসে উদ্দীপিত করে। শিখরা বিশ্বাস করতে শুরু করেন পঞ্জাব শাসন করা তাদের ঈশ্বর প্রদত্ত অধিকার। শিখ বাহিনী ১৭১০ সালে বান্দ সিং বাহাদুরের নেতৃত্বে দিল্লি ও লাহোরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মুঘল প্রশাসনিক কেন্দ্র সিরহিন্দ দখল করে। নিকটবর্তী মুখলিসপুরে তারা রাজধানী স্থাপন করে। এই শিখ বাহিনী নিজস্ব মুদ্রা তৈরি করে, একটি সরকারি সিল তৈরি করে, এবং ঈশ্বর ও গুরদের কর্তৃত্বের আহ্বান জানিয়ে নির্দেশিকা জারি করে। নানা ঐতিহাসিক প্রতিবেদন বলছে, সেই সময়ে, 'খালসারা শাসন করবে' এই বিশ্বাসটি আনুষ্ঠানিকভাবে শিখদের ধর্মীয় প্রার্থনাতেও জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।

আরও পড়ুন- তলোয়ার উঁচিয়ে থানা ঘেরাও! পঞ্জাব কি তবে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে?

তবে বান্দ সিংয়ের অধীনে এই খালসা রাজ ছিল স্বল্পস্থায়ী। ১৯ শতকের গোড়ার দিকে মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সাম্রাজ্য (১৭৮০-১৮৩৯) স্থাপিত হলে এই খালসা রাজ বাস্তবায়িত হয়। যদিও পরবর্তীকালে খালসা রাজের দ্রুত পতন ঘটে এবং ব্রিটিশদের কাছে হারতে হারতে ক্রমাগতই তলিয়ে যেতে থাকে খালসা সাম্রাজ্যের ধারণাটি। তলিয়ে যেতে যেতেও কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি এই আন্দোলনের বীজ। বহু শিখ বিশ্বাস করতেন খালসা রাজ কোনও না কোনও দিন ঠিক ফিরে আসবে।

১৯৪৭ সালে পঞ্জাব ভাগের আগে দীর্ঘ আলোচনায় স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। তবে সেই সময় পঞ্জাবের অন্যান্য বাসিন্দাদের তুলনায় শিখ জনসংখ্যার পরিমাণ কম হওয়াতে পৃথক শিখ রাষ্ট্রের ধারণা ধোপে টেকেনি। খালিস্তানের দাবিতে ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশক ধরে চলা হিংসাত্মক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন পঞ্জাবকে বিপর্যস্ত করে দেয়। ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এই আন্দোলন চরমে পৌঁছয়। পৃথক শিখরাষ্ট্রের দাবিতে বিদ্রোহ শুরু হয়, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর পুলিশি অভিযান, দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং মোহভঙ্গ সহ বিভিন্ন কারণে আন্দোলন ফের মুখ থুবড়ে পড়ে। অপারেশন ব্লু স্টারের সময় নিহতদের স্মরণে প্রতিবছরই প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের একাংশের মধ্যে এবং প্রবাসী শিখদের মধ্যে খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি কিছুটা সমর্থন রয়েছে।

২০১৮ সালের শুরুর দিকে পঞ্জাব পুলিশ খালিস্তানি কয়েকটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে গ্রেফতার করে৷ পঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং দাবি করেছিলেন, সাম্প্রতিক যে চরমপন্থা দেখা দিচ্ছে তাকে সমর্থন জোগাচ্ছে কানাডা, ইতালি এবং যুক্তরাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খালিস্তানপন্থীরা এবং পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (ISI)৷

অমৃতপাল সিং দীপ সিধুর শুরু করা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ওয়ারিস পঞ্জাব দে-এর প্রধান। গত বছরই দুবাই থেকে দেশে ফিরেছেন অমৃতপাল সিং। সম্প্রতি জার্নাইল সিং ভিন্দ্রাওয়ালের গ্রামে মোগা জেলার একটি অনুষ্ঠানে তাঁকে ওয়ারিস পঞ্জাব দে-এর প্রধান নির্বাচন করা হয়।

আরও পড়ুন- উদ্দেশ্য ছিল সন্ত্রাস দমনের, অপারেশন ব্লু স্টারই ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দেয়?

রেফারেন্ডাম ২০২০ কী?

অনানুষ্ঠানিক এই 'রেফারেন্ডাম' হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিখস ফর জাস্টিস (SFJ) সংস্থা দ্বারা বেশ কয়েকটি দেশে সংগঠিত একটি ভোট। বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং জঙ্গি কার্যকলাপকে সমর্থন করার অভিযোগে ২০১৯ সালে এটি ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়।

'রেফারেন্ডাম' ভারতের মধ্যে পৃথক খালিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি চুক্তি তৈরি করতে চায়। শিখস ফর জাস্টিস চায়, ভারতের একমাত্র শিখ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য পঞ্জাবকে পৃথক করতে হবে। পৃথক 'জাতিরাষ্ট্র' হিসাবে পঞ্জাবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি নিয়ে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছেও দরবার করে SFJ। SFJ ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতৃত্বে রয়েছেন গুরপতবন্ত সিং পান্নুন। ২০১৮ সালে SFJ প্রথম ঘোষণা করে যে, তারা ভারতের দখল থেকে পঞ্জাবকে মুক্ত করার লক্ষ্যে প্রচুর শিখ প্রবাসী সহ বেশ কয়েকটি দেশে 'রেফারেন্ডাম ২০২০' নামে একটি অনানুষ্ঠানিক ভোটদানের আয়োজন করবে।

এতে বলা হয়েছে, গণভোটটি পঞ্জাবের পাশাপাশি উত্তর আমেরিকা, ইওরোপ, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শহরগুলিতে অনুষ্ঠিত হবে।

More Articles