দেবদেবী নয়, পুজো করা হয় ব্যাঙকে! রহস্য-মিথে ভরা ভারতের ২০০ বছরের প্রাচীন এই মন্দির
Frog Temple of India : যেখানে দেবদেবী নন, প্রাধান্য পায় ব্যাঙ! বলা ভালো, ভারতের একমাত্র ব্যাঙের মন্দির!
হাজার হাজার বছর ধরে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গিয়েছে। অনেক ঝড়, ধ্বংসলীলা, ভাঙন, দুঃখ দেখেছে পৃথিবী। তারপরও সভ্যতা নিজের গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর ভারত? সে তো বহমান অজস্র সভ্যতার এক মেলবন্ধন। হাজার হাজার বছর ধরে এই দেশের মাটি দেখেছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি। গোটা ভারতজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপত্য, মন্দির, মসজিদ আরও কত পীঠস্থান। সেখানেই জড়িয়ে রয়েছে নানা মিথ, রহস্য। জড়িয়ে রয়েছে অদ্ভুত সব আচার। রয়েছে অদ্ভুত ইতিহাসও। সেরকমই এক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশের লখিমপুরে। যেখানে দেবদেবী নন, প্রাধান্য পায় ব্যাঙ! বলা ভালো, ভারতের একমাত্র ব্যাঙের মন্দির!
উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউ থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে লখিমপুর খেরি জেলা। সেখানেই ওয়েল শহরের মধ্যে রয়েছে মাণ্ডুক মন্দির। স্থানীয় মানুষেরা এই নামেই পীঠস্থানটিকে ডাকেন। এই মন্দিরটিই হল আমাদের গন্তব্য, ভারতের ইতিহাসের একমাত্র ব্যাঙ মন্দির। হিন্দিতে ব্যাঙকে বলা হয় ‘মেন্ডক’,সেখান থেকেই সম্ভবত এসেছে এই ‘মাণ্ডুক’ শব্দটি। ১০০ ফুট উঁচু এই মন্দিরটির প্রধান আরাধ্য দেবতা আসলে শিব। ভেতরে সেই নর্মদেশ্বর শিবের লিঙ্গও রয়েছে। তবে পুরো স্থাপত্যটি ঘিরেই রয়েছে অদ্ভুত কিছু রহস্য। রয়েছে অদ্ভুত কিছু মিথ।
প্রথম দর্শনে মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে খানিক ঘাবড়ে যেতে বাধ্য। গোটা স্থাপত্যটিরই অপূর্ব সব কারুকাজ, ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো দেওয়ালের রং বেশ খানিকটা ফিকে হয়েছে। কিন্তু মন্দিরে ঢোকার মুখেই অদ্ভুত দর্শন একটি মূর্তি আপনাকে স্বাগত জানাবে। দুটো হাত বাড়িয়ে রাখা, মুখ এগিয়ে কিছু একটা যেন বসে আছে। দৈত্য নাকি! না, দানব বা রাক্ষস নয়। এটি সেই বিশাল ব্যাঙের মূর্তি। আর এই ব্যাঙটিই গোটা মন্দিরের প্রাণভোমরা। এমনভাবে এই মূর্তিটি তৈরি করা হয়েছে, যেন দেখে মনে হয়, ব্যাঙটিই গোটা মন্দিরটির ভার নিজের পিঠে বহন করছে। আর ব্যাঙের পিঠের ওপরই মন্দিরের মূল গর্ভগৃহ।
আরও পড়ুন : ‘আত্মা’ এখনও আসে ফিরে? পর্যটকদের কেন টানে ভৌতিক রহস্যে মোড়া সিকিমের বাবা মন্দির!
ঐতিহাসিকদের মতে, লখিমপুরের এই অঞ্চলে একসময় চাহমান বংশের শাসকরা রাজত্ব করতেন। ১৯ শতক পর্যন্তও তাদের দহরম মহরম ছিল। সেই বংশেরই এক রাজা ভখত সিং এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। তার পেছনে রয়েছে একটি কাহিনিও। শোনা যায়, রাজার জীবনে সৌভাগ্যের জন্য ব্যাঙের অবদান ছিল। ব্যাঙের পুজোও নাকি করতেন তিনি। আর সেই পুজোর ফলেই নাকি প্রচুর ধনসম্পত্তি লাভ করেন, সন্তানের শরীরও ঠিক হয়ে যায়। তারপরই এই ব্যাঙের মন্দির তৈরি করেন ভখত সিং।
তবে মন্দিরের আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। সমসাময়িক অন্যান্য হিন্দু মন্দিরের গঠনরীতির তুলনায় এই মন্দিরের স্থাপত্য একটু আলাদা। তার ওপর মন্দিরের সামনে বিশাল ব্যাঙের মূর্তিটিও একটি আলাদা রূপ দিয়েছে। এমন কেন? গবেষকদের মতে, মূল কারণ লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাসের পাতাতেই। সেই সময়ের এক নামী তান্ত্রিক এই মাণ্ডুক মন্দিরের নকশা তৈরি করেছিলেন। তাই গোটা স্থাপত্যরীতির মূল ভিত্তি হল তন্ত্রশাস্ত্র। এমনকী মূল গর্ভগৃহের ভেতরের দেওয়ালে তন্ত্রের অনেক দেবদেবীর ছবিও পাওয়া যায়। অনেক মূর্তি খোদাইও করা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে নন্দীর মূর্তিও। শিব আর তন্ত্র এখানে মিলেমিশে গিয়েছে।
এত পুরনো আর ব্যতিক্রমী একটি মন্দির, নিশ্চয়ই কোনও মিথ জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে! স্থানীয় লোককথা বলে, এই মন্দির যতই তন্ত্র আর শিবের জন্য হোক না কেন, আসল আকর্ষণ হল ব্যাঙ। তার জন্যই এলাকার শ্রীবৃদ্ধি, মন্দিরও বহাল তবিয়তে রয়েছে। এছাড়াও শোনা যায়, ব্যাঙের ‘অলৌকিক’ ক্ষমতায় নাকি এখানকার শিবলিঙ্গ রংও বদলায়! একবার নয়, তিন তিনবার রং বদল হয়!
আরও পড়ুন : শ্মশান থেকে মৃতদেহ তুলে আনা হতো পুজোয়, চমকে দেয় উত্তর কলকাতার কালী মন্দিরের ইতিহাস
এরকমই মিথ আর ইতিহাসের মোড়কে মোড়া লখিমপুরের মাণ্ডুক মন্দির। শিবরাত্রি, দীপাবলিতে ভিড় উপচে পড়ে আজও। সেইসঙ্গে থাকে ব্যাঙের পুজোও। একমাত্র এই মন্দিরেই নিষ্ঠাভরে ব্যাঙকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করা হয়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, ব্যাঙ হল সৌভাগ্য, উর্বরতা, সমৃদ্ধির প্রতীক। যে এই মন্দিরে পুজো দেবে, তার ধনসম্পদ বাড়বে, সন্তানলাভ হবে, পরিবারে সৌভাগ্য নেমে আসবে। তাই আজও এই বিশ্বাসে ভর করে প্রচুর মানুষ এই ঐতিহ্যশালী মন্দিরে আসেন।