কয়লাখনি থেকে শেয়ারের কারবার, যৌনপল্লির মালিকানার আড়ালে রয়েছেন যে শিল্পোদ্যোগী দ্বারকানাথ
বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি থেকে সোনাগাছির মালিকানা নিয়ে একাধিকবার বিতর্কের তিরে বিদ্ধ হয়েছেন দ্বারকানাথ।
১৮৪৬ সালের ৩১ জুলাই। লন্ডন শহরে আকাশের মুখ সেদিন গম্ভীর। সারাদিন অঝোর ধারায় বর্ষণের পর দিনান্তেও বৃষ্টির বিরাম নেই। রাস্তার ধারের গাছগুলো প্রবল আক্রোশে মাথা ঝাঁকিয়ে জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। সেই প্রবল দুর্যোগের দিনেও ব্যস্ততার শেষ নেই সেন্ট জর্জ হোটেলের একটি ঘরে। বিছানায় অর্ধনিমীলিত চোখে বিশ্রাম নিচ্ছেন এক ব্যক্তি। বিছানার চারপাশে আরও বেশ কিছু চিন্তিত মুখ। ডাক্তার একপ্রকার জবাব দিয়েই দিয়েছেন। একপলক দেখলেই বোঝা যায়, বিছানায় বিশ্রামরত সেই ভদ্রলোক যথেষ্ট অভিজাত পরিবারের সন্তান। কিন্তু মৃত্যুর দূত যেন প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দিচ্ছে তাকে। এত কিছুর পরেও বিছানার চারপাশের সেই মুখগুলো যেন অভাবনীয় কিছু ঘটার আকাঙ্ক্ষায় অপেক্ষারত। সবার সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ প্রমাণ করে সেই দুর্যোগপূর্ণ রাতে মৃত্যুর হিমশীতল অমানিশায় ডুবে গেল একটি কর্মচঞ্চল প্রাণের প্রদীপ, পরিসমাপ্তি ঘটল একটি আলোকোজ্জ্বল এবং বিতর্কিত অধ্যায়ের।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের জন্ম কলকাতার বুকে ১৭৯৪ সালে। ঊনবিংশ শতকে কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল সাহিত্য-সংস্কৃতির এক মহান আলেখ্য। তবে শুধুমাত্র সংস্কৃতির গুরুদায়িত্ব ঠাকুরবাড়ির কাঁধে অর্পিত হয়েছিল ভাবলে ভুল ভাবা হবে, সেই সময় ঠাকুরবাড়ির হাত ধরেই বাংলা তথা ভারতের শিল্পব্যবস্থার মরা গাঙেও জোয়ার এসেছিল।
আরও পড়ুন: বাঙালির ব্যবসা করতে না পারার দুর্নাম ঘুচিয়ে দিয়েছে একশো ছুঁই ছুঁই বোরোলিন
১৮৪৫ সালের মার্চ মাস। কলকাতার বুকে তখন চলছে দাবদাহের তাণ্ডব। কেটে যাচ্ছে একের পর এক অলস দুপুর। ছ্যাকরা গাড়ি টানতে টানতে ক্লান্ত ঘোড়াগুলো শ্রান্তিতে চোখ বুজেছে, পালকিওয়ালারাও অবসন্ন দুপুরকে সঙ্গী করে ঝিমোচ্ছে গাছের ছায়ায়। এমনই এক গ্রীষ্মের দুপুরে কলকাতার চাঁদপাল ঘাট থেকে বিলেতের উদ্দেশ্যে রওনা হল 'বেন্টিঙ্ক' নামের একটি জাহাজ। সওয়ারি দ্বারকানাথ ঠাকুর, অবশ্য এই প্রথমবার নয়, এর আগেও ১৮৪২ সালের ৯ জানুয়ারি দ্বারকানাথ পাড়ি জমিয়েছিলেন বিলেতে। কিন্তু দ্বারকানাথের দ্বিতীয় বারের এই বিলেত সফর অন্য একটি কারণে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় বারের এই বিলেত সফরের মাঝেই মিশরের পাশা মহম্মদ আলির সঙ্গে যৌথভাবে ভূমধ্যসাগর থেকে আরব সাগরের উপকূল পর্যন্ত রেলপথ বিস্তারের পরিকল্পনা করেন তিনি। না, শুধুমাত্র রেলপথ বিস্তারের পরিকল্পনার মধ্যেই থেমে থাকেননি দ্বারকানাথ। নীল, রেশম অথবা আফিমের ব্যবসা- সবেতেই দ্বারকানাথ ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ইংরেজদের সঙ্গে শেয়ারে যৌথ ব্যবসাও শুরু করেছিলেন তিনি- বেঙ্গল কোল কোম্পানি, বেঙ্গল টি কোম্পানি প্রভৃতি তার অকাট্য প্রমাণ।
সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ির জানা-অজানা’ বইতে লিখছেন, “জয়েন্ট স্টক কোম্পানি চালু করে রানিগঞ্জে বেশ কয়েকটি কয়লাখনির কাজ চলতে থাকে ও তার দেখাশোনার ভার থাকে কয়েকজন ইংরেজ কর্মচারীর উপর। কার টেগোর অ্যান্ড কোম্পানির রমরমা কয়লার ব্যবসা চালু হয়ে যায়।’’ এর থেকেই বোঝা যায়, সেই সময় দ্বারকানাথের ব্যবসার প্রতিপত্তি কীভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এছাড়াও তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির 'বোর্ড অফ কাস্টমস, সল্ট অ্যান্ড ওপিয়াম'-এর দেওয়ান।
দ্বারকানাথের কীর্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠা। এটিই বাংলার প্রথম পাবলিক ব্যাঙ্ক। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তো নয়ই, কোনও সংস্থারই অধীন ছিল না এই ব্যাঙ্ক। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ আমাদের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে, তখন আমরা কতজনই বা মনে রাখি দ্বারকানাথের এই অনন্য কীর্তির কথা? ১৮২৯ সালে দ্বারকানাথের হাত ধরেই ষোলো লক্ষ টাকার আমানত নিয়ে পথচলা শুরু করল ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ার ছিলেন দ্বারকানাথের ভাই রমানাথ। যদিও ১৮৪৭ সালে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের পথ চলাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মাত্র আঠারো বছরের ইতিহাসে এই ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল, তা অবিস্মরণীয়। আর এই ইতিহাসের রচয়িতা দ্বারকানাথ।
এছাড়াও পত্রপত্রিকার জগতে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। কিছুদিন সম্পাদক ছিলেন রামমোহন রায়ের 'সম্বাদ কৌমুদী'-রও। এছাড়াও প্রবর্তন করেছেন 'বেঙ্গল হেরাল্ড' বা 'বঙ্গদূত'-এর মতো কাগজ। 'বেঙ্গল হরকরা', 'ইংলিশম্যান'-এর মতো কাগজের পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি।
বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি থেকে সোনাগাছির মালিকানা নিয়ে একাধিকবার বিতর্কের তিরে বিদ্ধ হয়েছেন দ্বারকানাথ। একথা ঠিক যে বেলগাছিয়া ভিলা ছিল রঙিন জীবনের আখড়া। সেই সময় রূপচাঁদ পক্ষী ছড়া কাটে, 'মদের কত গুণাগুণ আমরা কি জানি, জানেন ঠাকুর কোম্পানী'। কিন্তু সেই বিতর্কিত চরিত্রের আড়ালেই লুকিয়ে আছেন এমন এক শিল্পের পৃষ্ঠপোষক। সেই মুখকে খোঁজার চেষ্টা আমরা করেছি কি তেমন করে? না কি বিতর্ক আর অশ্লীলতার সস্তা চাদরে মুখ ঢেকেছি আমরাও? হোক না সে আফিম অথবা নীলের ব্যবসা, কিন্তু তারপরেও ঘরকুনো বাঙালি যে দ্বারকানাথের মতো কিছু মানুষের জন্য সাতসমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিতে পেরেছিল, সেকথা কি অস্বীকার করা চলে?