বিরাট নন, এখনও পর্যন্ত ভারতের সর্বকালের সেরা ব‍্যাটার সচিনই

Sachin-Virat: ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে ১৫ নভেম্বর ২০২২ অবধি ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান এখনও সচিন তেণ্ডুলকর।

সচিন না কি কোহলি? ভারতের সেরা ব্যাটসম্যান কে? এই প্রশ্নের পাশে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকে আবেগচূর্ণ, ব্যক্তিগত অনুভূতি, সময়খণ্ড এবং স্ট্যাটিস্টিক্সের কচকচি। তাই শতকরা নব্বই ভাগ মানুষই এই কঠিন প্রশ্নে ব্যক্তিগত পছন্দের আড়ালে উত্তরটিকে লুকিয়ে রাখতে চান। একজন অতি সামান্য ক্রিকেটলিখিয়ে ও ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে আবেগ-ব্যক্তিগত অনুভূতিকে বাইরে রেখে একটি দীর্ঘ আলোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণের চেষ্টা করলাম।

এই দীর্ঘ বিশ্লেষণটিকে আমরা তিনটি স্তরে ভেঙে নিতে পারি। স্তর কেন বললাম? কারণ আমরা দৃশ্যমান ও চর্চিত স্ট্যাটিসটিক্স থেকে ক্রমে ভেতরে প্রবেশ করব, অনালোচিত অধ্যায়গুলিতে। প্রথম স্তর- ব্যাটিং স্ট্যাটিসটিক্সের তুলনামূলক আলোচনা। দ্বিতীয় স্তর- সময়ভেদে ব্যাটারের ওপর ক্রিকেটীয় ও অক্রিকেটীয় ফ্যাক্টরের প্রভাব। তৃতীয় স্তর- ব্যক্তিগত ক্রিকেটীয় মেধা ও নিজের ব্যাটিং-এর প্রাথমিক নির্মাণকে সময়ের সঙ্গে বিনির্মাণ করতে পারার তুল্যমূল্য আলোচনা।

স্তর ১- ( ব্যাটিং স্ট্যাটিস্টিক্সের তুলনামূলক আলোচনা)
উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ দুই ব্যাটারের ব্যাটিং স্ট্যাটিস্টিক্সের দিকে তাকালে আমাদের প্রথমে টেস্ট ক্রিকেট এবং তারপর ওডিআই ক্রিকেটের ব্যাটিং স্ট্যাটকে পরপর দেখতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকে বলতে পারেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে আওতায় না আনার কারণ কী, যেখানে বিরাট প্রায় ১১৫টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন এবং বিরাটের ব্যাটিং বিনির্মাণের অন্যতম বড় ক্ষেত্র টি-টোয়েন্টি। এর কারণ একটিই, সচিন তেণ্ডুলকরের অবসরের আগে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের চল এবং তারপরে টি-টোয়েন্টির বাড়বাড়ন্ত এক নয়, তাই সচিন কেরিয়ারে মাত্র ১টি টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। তাহলে বিরাটের টি-টোয়েন্টি কেরিয়ার ব্যাটিং-কি এই বিশ্লেষণে আসবে না? নিঃসন্দেহে আসবে। আসবে, তৃতীয় স্তরে যেখানে আমরা ধরব ব্যাটারের ক্রিকেটীয় মেধার এককগুলিকে।

আরও পড়ুন: আইপিএলের কিং কোহলি নন, সব ধরনের ক্রিকেটের আজীবন ‘ঈশ্বর’ সচিনই

টেস্ট ক্রিকেটে সচিনের স্ট্যাটে নজর রাখা যাক। ২০০টি টেস্ট ম্যাচে ৩২৯টি ইনিংস খেলে সচিন রান করেছেন ১৫৯২১, ব্যাটিং গড় ৫৩.৭৯। সেঞ্চুরি ৫১টি, হাফ সেঞ্চুরি ৬৮টি। অন্যদিকে ১৫ নভেম্বর ২০২২ অবধি বিরাট কোহলি মোট টেস্ট খেলেছেন ১০২টি, যেখানে ১৭৩ ইনিংসে তাঁর রান ৮০৭৪। গড় ৪৯.৫৩। সেঞ্চুরি ২৭টি, হাফসেঞ্চুরি ২৮টি। এই পরিসংখ্যানের নিরিখে নিঃসন্দেহে সচিন বিরাটকে পিছনে ফেলেছেন। ইএসপিএন ক্রিকইনফো-র ডেটা অনুযায়ী একজন ব্যাটারের ব্যাটিং গড় সর্বোচ্চ থাকে পিক-৩৩ কিংবা পিক-৫০-এ। পিক-৩৩ বা পিক-৫০ এর অর্থ হলো, প্লেয়ারের কেরিয়ারের সবচেয়ে বেশি রান যে সময়ের ৩৩ বা ৫০ টি টেস্টে ওঠে।

একজন্য ব্যাটারের ২৮-৩৫ বছরের মধ্যে এই পিক-৩৩ বা পিক-৫০ থাকার সম্ভাবনা প্রবল হয়। বিরাটের এখন বয়স চৌত্রিশ পেরিয়েছে তাই অনুমান করা যায়, বিরাট পিক-৩৩ বা পিক-৫০ পেরিয়ে গিয়েছেন। ব্যাটারের ব্যাটিং গড়ের গ্রাফ পিক ছুঁয়ে যাবার পর শেষ দুই বছরে (ডিক্লাইনিং ইয়ার্স) ০.১৩% কমে (ফিটনেস, হ্যান্ড আই কোঅর্ডিনেশন ও অন্যান্য যাবতীয় ফ্যাক্টরের ফল) তাই যদি আমরা ধরে নিই বিরাট আর বছরতিনেক খেলবেন, তাতে সম্ভাবনা তত্ত্বানুসারে তাঁর ব্যাটিং গড় সচিনকে ছাপিয়ে যাবে না। যদিও বিরাটের ফিটনেস যে-কোনও মুহূর্তেই এই সম্ভাবনাতত্ত্বকে উলটে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে যদি -০.১৩ কে আমরা ০ কিংবা +০.১৩ ও ধরি, তবুও বিরাটের পক্ষে সচিনের গড়কে ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব না। এটি গেল প্রাথমিক পরিসংখ্যান।

এবার আসা যাক বহুলচর্চিত বিদেশের মাঠে টেস্ট ব্যাটিং রেকর্ডে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে সচিন ও বিরাটের ব্যাটিং গড় যথাক্রমে ৫৩.২১ ও ৫৪.০৩। সচিনের সেঞ্চুরি সংখ্যা ৬টি, বিরাটের ও ৬টি। কিন্তু বিরাট এই গড় এবং এই সেঞ্চুরির সংখ্যায় সচিনকে ছুঁয়ে ফেলেছেন প্রায় ১৩টি ইনিংস কম খেলে। তাই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ব্যাটিং-এর নিরিখে বিরাট সামান্য এগিয়ে থাকবেন সচিনের চেয়ে, অস্ট্রেলিয়ার মাঠে ফোর্থ ইনিংস ব্যাটিং-এ বিরাটের গড় বেশ ঈর্ষনীয়। তাই এই ক্ষেত্রটিতে বিরাট এগিয়ে থাকবেন তাঁর পূর্বসূরির চেয়ে। তেমনই আবার ইংল্যান্ডের সুইং কন্ডিশনে সচিনের গড় প্রায় ৫৩ যেখানে বিরাটের মাত্র ৩৩, সচিন ব্রিটিশ মুলূকে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন ৪টি, বিরাট ২টি। অ্যাডভান্টেজ সচিন। দক্ষিণ আফ্রিকার পিচকে বলা হয় উপমহাদেশের ব্যটারদের অগ্নিপরীক্ষার ক্ষেত্র, আফ্রিকার পিচে গতি ও অতিরিক্ত বাউন্স সামলানোয় বিরাট এদেশের মানচিত্র শুধু নয় সমগ্র উপমহাদেশেরই অন্যতম সেরা ব্যাটার। জোড়া সেঞ্চুরি-সহ বিরাটের ব্যাটিং গড় ৫১.৩৬, সচিনের ৫৫টি আফ্রিকার মাটিতে সেঞ্চুরি থাকলেও ব্যাটিং গড় ৪৬। বিরাট আফ্রিকায় সচিনের অর্ধেক টেস্ট ইনিংস খেলে মাত্র ৪০০ রান কম করেছেন। শেষ, নিউজিল্যান্ড যেখানে সচিন অনেকটা পিছনে ফেলেছেন বিরাটকে, কিউয়িদের পিচে বিরাটের এখনও সে-অর্থে সেরা ফর্মের ব্যাটিং দেখেনি তামাম বিশ্ব, গড় ৩৬; যদিও বিরাট নিউজিল্যান্ডে ব্যাট হাতে নেমেছেন মাত্র ৮বার। সচিন এখানে প্রায় পঞ্চাশের কাছে গড় নিয়ে খেলে গেছেন মার্টিন ক্রো-র দেশে। তাই টেস্ট ব্যাটিং-এর সামগ্রিক চালচিত্রের নিরিখে এখনও (১৫ নভেম্বর, ২০২২) অবধি সচিন এগিয়ে রয়েছেন তাঁর উত্তরসূরির চেয়ে।

এবার আসি ওয়ান ডে ব্যাটিং-এ। সাদা বলের ক্রিকেটে সচিন খেলেছেন ৪৬৩টি ম্যাচ, রান করেছেন ১৮৪২৬, ব্যাটিং গড় ৪৪.৮৩। ৪৯টি সেঞ্চুরি, ৯৬টি হাফসেঞ্চুরি। অন্যদিকে বিরাট কোহলি খেলেছেন ২৬২টি ম্যাচ, রান করেছেন ১২৩৪৪, ব্যাটিং গড় ৫৭.৬৮; সেঞ্চুরি ৪৩টি, হাফ সেঞ্চুরি ৬৪টি। প্রাথমিক পরিসংখ্যানে বিরাট কোহলি নিঃসন্দেহে ওডিআই-তে পিছনে ফেলেছেন সচিনকে। তাঁর ব্যাটিং গড় আগামী ৩ বছরে সম্ভাবনাতত্ত্ব অনুযায়ী ১% অবধি কমলেও সচিনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাটিং গড় নিয়ে শেষ করবেন এই দিল্লির ক্রিকেটার। ওয়ান ডে ব্যাটিং-এর ক্ষেত্রে বিদেশের মাঠে পারফরম‍্যান্সের চেয়েও আমরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সামগ্রিক রানকে (হোম+অ্যাওয়ে) বিশ্লেষণের সূচকে রাখব কারণ লাল বলের চেয়ে সাদা বলে পিচ কন্ডিশনের ফ্যাক্টরটি অপেক্ষাকৃত কম কাজ করে, বেশি জরুরি হয় প্রতিপক্ষের বোলিং কোয়ালিটি।

সাদা বলের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল ছয়টি দল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সচিনের সামগ্রিক স্ট্যাটিসটিক্স- ১৩৯২২ রান, গড় ৪২.৪০। (এই স্ট্যাটিস্টিক্স, ৬ দলের বিরুদ্ধে মোট রান ও মোট গড়ের সাপেক্ষে ব্যক্তিগত ক্যালকুলেশন)। বিরাট এই ৬ দলের বিরুদ্ধে করেছেন ৮৯৭০ রান, গড় ৫৪.৬২- অর্থাৎ নিঃসন্দেহে বিরাটের সাদাবলের ক্রিকেটে বিগ সিক্সের বিরুদ্ধে সামগ্রিক পরিসংখ্যান সচিনের চেয়ে ভাল। তাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ওডিআই ক্রিকেটে বিরাট কোহলি ব্যাটিং পারফরমেন্সের নিরিখে সচিনের চেয়ে এগিয়ে। (জিম্বাবোয়ে-বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ডস ও আরও ৪টি দেশের বিরুদ্ধে স্ট্যাটিসটিক্স ক্যালকুলেশনে আনা হলো না)

ব্যাটিং স্ট্যাটিসটিক্সে সচিন লাল বলের ক্রিকেটে বিরাটকে পিছনে ফেলেছেন, আবার সাদা বলের ওডিআই ক্রিকেটে বিরাট পিছনে ফেলেছেন সচিনকে। তাই প্রাথমিক স্তর বিশ্লেষণে কাউকে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখা সম্ভব না।

দ্বিতীয় স্তর (সময়ভেদে ব্যাটারের ওপর ক্রিকেটীয় ফ্যাক্টরের প্রভাব)

১। ব্যাটিং পাওয়ার প্লে
২০০৫ সালে আইসিসি সাদা বলের ক্রিকেটে নিয়ে এল সেগ্রিগেটেড পাওয়ার-প্লে রুল। ১৯৮০ সাল থেকেই সাদা বলের ক্রিকেটে প্রথম পনেরো ওভার তিরিশগজ বৃত্তে দু’জন ফিল্ডার রাখা যেত এবং বাকি ম্যাচের ৩৫ ওভারে কোনও নির্দিষ্ট ফিল্ডিং রুল ছিল না। পাচজন ফিল্ডার বৃত্তের বাইরে রাখা যেত। ওভারভেদে ক্রিকেট মাঠের ৩০ গজ বৃত্তকে ধরে ফিল্ডিং রেসট্রিকশন এল ২০০৫ সালে। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ওভার থেকে নির্দিষ্ট ওভার অবধি তিরিশ গজের ভেতর ও বাইরে ফিল্ডার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিল আইসিসি। এর ফলে ব্যাটারদের সুবিধা হল। ১৫-২০ ওভারে মাত্র ৪ জন ফিল্ডারকে বৃত্তের বাইরে রাখার অনুমতি দিল আইসিসি যা আগের নিয়মের চেয়ে একজন কম। ২০০৮ সালে আইসিসি নিয়ে এল ৫ ওভারের ব্যাটিং পাওয়ার প্লে রুল, যেখানে ব্যাটারদের রানের গতি বাড়ানোর জন্য ৫ ওভারের ফ্লেক্সিবল পাওয়ার প্লে নেওয়ার অনুমতি দিল আই সি সি। বাড়ল রানের গতি। টেস্ট ক্রিকেটে সবথেকে বড় ফ্যাক্টর যদি হয় হেলমেট, তবে সাদা বলের ক্রিকেটে সবচেয়ে জরুরি ফ্যাক্টর হলো ব্যাটিং পাওয়ার প্লে। সমীক্ষা বলছে, ২০০৫ সালের পর ওয়ান ডে ক্রিকেটে গড় রান বেড়েছে।

২০০৮ সালে ব্যাটিং পাওয়ার প্লে আসায় ইনিংসের গড় রান ১৩.৩৫ বেড়ে যায়। বিখ্যাত ক্রিকেট-বিশ্লেষক ও উইসডেন ইন্ডিয়ার এডিটর সুরেশ মেনন যে কারণে ২০১৩ সালে জানিয়ে দেন পাওয়ার প্লে রুল ও ডাবল নিউ বল রুলের কারণে ওয়ান ডে-তে বোলারদের অবস্থা আরও সঙ্গিন হয়ে যাবে (বিবিসি নিউজে প্রকাশিত মেননের দীর্ঘ আর্টিকল)।

সচিনের ব্যাটিং অভিষেক ঘটে ১৯৮৯ সালে। কেরিয়ার শেষ হয় ২০১৩ সালে। ফলে, সচিনের কেরিয়ারের ৭০%-ই কেটেছে প্রি-পাওয়ার প্লে যুগে। বিরাট কোহলির আবির্ভাব লগ্ন থেকেই পাওয়ার প্লে-রুল জারি ছিল। এখনও অবধি প্রি এবং পোস্ট পাওয়ার প্লে-তে ব্যাটারদের রানের তুলনা করার জন্য কোনও কনভার্সান ফ্যাক্টর অঙ্ক কষে বের করা যায়নি, তবু, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় সাদা বলের ওডিআই ক্রিকেটে বিরাটের যে গড় এবং সচিনের যে গড় তার তারতম্যের কিছুটা অংশ নিঃসন্দেহে পাওয়ার-প্লে ফ্যাক্টরটির কারণে। সচিন যেহেতু কেরিয়ারের ৭৫% সময়ে সাদা বলের ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে খেলেছেন তাই প্রথম দশ ওভারের পাওয়ার প্লে-তে সচিনের স্ট্যাটিস্টিক্স বদলে যেতে পারত কিছুটা।

এই ফ্যাক্টরটির সুবিধা পেয়েছেন বিরাট।

২। ডিআরএস-ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম
২০০৮ সালে আইসিসি আম্পায়ারের হিউম্যান এরর কমানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে এল ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম। অর্থাৎ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ব্যাটসম্যান বা বোলার সহমত না হলে ব্যাটিং বা বোলিং টিম টিভি আম্পায়ারের সাহায্য নিতে পারে। ১৯৯২ সালে থার্ড আম্পায়ার রুল এনেছিল আইসিসি, কিন্তু তখন অন ফিল্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা ব্যাটিং বা বোলিং টিমের ছিল না। একমাত্র অনফিল্ড আম্পায়ার চাইলেই টিভি বা থার্ড আম্পায়ারের সাহায্য নিতে পারতেন। সমীক্ষা বলছে, ডিআরএসের তিনটি ইউনিট- হক আই, হটস্পট, রিয়েল টাইম স্নিকো নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও নিঃসন্দেহে ডিআরএস আসার পর আম্পায়ারের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জায়গা তৈরি হয়েছে এবং বহু ক্ষেত্রে ব্যাটারের আউটের সিদ্ধান্ত নট আউটে পালটে গেছে রিভিউ-র সৌজন্যে। সমীক্ষা বলছে, ২৬% ক্ষেত্রে অনফিল্ড আম্পায়ারের সিদ্ধান্তকে পালটে দিয়েছে রিভিউ-র প্রয়োগ। সচিন তেণ্ডুলকর তাঁর কেরিয়ারের ৯০ শতাংশ সময়ই কাটিয়েছেন রিভিউ সিস্টেম-পূর্ববর্তী ক্রিকেটীয় যুগে। সচিন এন্ড ক্রিটিকস সাইটের তথ্য অনুযায়ী, ইএসপিএন এবং স্পোর্টস উইকি-র তথ্য থেকে পাওয়া যায় কেরিয়ারের কমবেশি ৩৮-৩৯টি ইনিংসে সচিন অনফিল্ড আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের স্বীকার হয়েছেন। ১৯৯৯ অ্যাডিলেড, ২০০২ সালে পোর্ট অফ স্পেন থেকে শুরু করে ২০০৫ দিল্লি টেস্ট কিংবা ২০০৬ সালের পেশোয়ারে কখনও স্টিভ বাকনার, কখনও রুডি কর্টজেন-সাইমন টাফিলদের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন মাস্টারব্লাস্টার।

বিরাট কেরিয়ারের নব্বই ভাগ সময়ই রিভিউ সিস্টেমের সুরক্ষা বুলয়ে খেলেছেন, তাই মার্জিন অফ এরর তাঁর ক্ষেত্রে অনেক অনেক কম। অনুমান করা যেতেই পারে সচিন যদি তাঁর সুদীর্ঘ কেরিয়ারের ৩৫-৪০টি ম্যাচে এই রক্ষাকবচ পেতেন তাহলে বদলে যেতে পারত তাঁর ব্যাটিং পরিসংখ্যান। তাই এই দ্বিতীয় ক্রিকেটীয় ফ্যাক্টরটিতেও অ্যাডভান্টেজ সচিন।

৩। ডাবল নিউ বল রুল- রিভার্স সুইং-এর বিলুপ্তি
সরফরাজ নওয়াজ, ইমরান খান, ওয়াসিম আক্রম এবং ওয়াকার ইউনিস- চার বোলার নয়ের দশকের গোড়া থেকে এক প্রবাদ চালু করে দিলেন ক্রিকেট বিশ্বে- ‘ওনলি পাকিস্তান ক্যান ডু রিভার্স সুইং…’- ব্যাটারের জন্য মোক্ষম বিষবাণ প্রস্তুত করতে পেরেছিল এই রিভার্স সুইং। যে বলের ভয়ংকর রূপ প্রসঙ্গে কিংবদন্তি কিউয়ি ব্যাটার মার্টিন ক্রো-র সাক্ষাৎকারটি মনে রাখা আশু প্রয়োজন, তিনি বলছেন রিভার্স সুইং খেলার টেকনিক হলো আদতে সব বলকেই ইনসুইং হিসেবে খেলা। কী এই রিভার্স সুইং?

৩০-৩৫ ওভার বা তার চেয়ে বেশি পুরনো বলের একদিকে যদি লালা দিয়ে মসৃণ করানো হয়, তবে মসৃণ ও অমসৃণ পিঠের বদান্যতায় চিরাচরিত আউটসুইং (বাইরের দিকে বেরনো বল) হাওয়ার বাঁকে ইনসুইং হয়ে যাবে ব্যাটারের কাছে। অর্থাৎ, তা ব্যাটারকে বোকা বানাবে অনায়াসে। কিন্তু রিভার্স সুইং-এর জন্য দরকার পুরনো বল। সাদা বলের ক্রিকেটে বল অপরিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে আইসিসি দুই এন্ড থেকে দু'টি নতুন বলের নিয়ম চালু করায় শেষ দশকে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যায় রিভার্স সুইং। সমীক্ষা বলছে পেস বোলিং-এর এই অন্যতম সেরা বোলিংটি যেসব বোলার করে সাফল্য পেয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগকেই খেলেছেন সচিন, রান তুলেছেন অবলীলায়। যেমন ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, ডেল স্টেইন, আন্দ্রু ফ্লিনটফ, উমর গুল। বিরাটকে রিভার্স সুইং-এর বিস্ময় বল সহ্য করতে হয়নি সেভাবে ২০১১ সালে দু'টি নতুন বলে খেলার চল চালু হয়ে যাওয়ার কারণে। তাই বিরাট রিভার্স সুইং-এর বিরুদ্ধে সে অর্থে পরীক্ষিত নন, একথা বলাই যায়।

৪। কুইক রিস্ট স্পিনার- আধুনিক ক্রিকেটের সেরা অস্ত্র
লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে গত দুই দশকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো রিস্ট স্পিনারদের আকাশচুম্বী চাহিদা। এর কারণ কী? এর কারণ বর্তমানে ফিল্ড রেস্ট্রিকশন- শর্টার বাউন্ডারির যুগে রিস্ট স্পিনারদের সাবলীল উইকেট নেওয়ার ক্ষমতা। গতিশীল রিস্ট স্পিনারদের গুগলি-লেগস্পিন বুঝতে না পারে উইকেট ছুঁড়ে আসা খুবই চর্চিত ঘটনা। সাদা বলের ওডিআই ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২০১০ সালের পর থেকে বাড়বাড়ন্ত এইসব রিস্ট স্পিনারদের। টপ স্পিন-ফ্লিপারের মতো অস্ত্রে শান পড়ল আরও।

অস্ট্রেলিয়ার আডাম জাম্পা, আফগানিস্তানের রশিদ খান, ইংল্যান্ডের আদিল রশিদ, পাকিস্তানের শাদাব খান, দক্ষিণ আফ্রিকার ইমরান তাহির গত দশকে কার্যত রাজত্ব করলেন নিজের দলের বোলিং ইউনিটে। ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সাল অবধি ৫ বছরে আদিল রশিদ নিলেন প্রায় শ’দেড়েক উইকেট, ভারতের সাদা বলে অশ্বিন-জাদেজা জুটির থেকে বেশি এফেক্টিভ হয়েছিল কুলদীপ-চাহাল জুটি। একথা অনস্বীকার্য যে, নয়ের দশকে ব্যাটারের ত্রাস যদি হয় রিভার্স সুইং তবে এই দশকে কুইক রিস্টস্পিন ছিল ব্যাটারদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। সচিন কেরিয়ারে শেন ওয়ার্নকে অবলীলায় মাঠের বাইরে পাঠালেও সইদ আজমল কিংবা সুনীল নারিনের বিরুদ্ধে খুব সাবলীল দেখায়নি তাঁকে এবং মডার্ন রিস্ট স্পিনের ভেল্কির বিরুদ্ধে তিনি সে অর্থে পরীক্ষিত নন। এই ফ্যাক্টরটিতে নিঃসন্দেহে এগিয়ে বিরাট কোহলি। গত তিনবছরে কোহলির অফফর্মের সময়ে রিস্ট স্পিনারদের বিরুদ্ধে বারে বারে উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এলেও ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল অবধি কোহলি যথেষ্ট পরিমাণে রিস্ট স্পিনারদের বিরুদ্ধে সাবলীল রান তুলেছেন। স্ট্রাইকরেট প্রায় ১৩৭ (টি-টয়েন্টি)। রিস্ট স্পিনের বিরুদ্ধে খেলার জন্য নিজের ব্যাটিং স্টান্সেও একসময়ে বদল এনেছিলেন বিরাট। তাই সাদা বলের ক্রিকেটে মডার্ন রিস্ট স্পিনারদের খেলার ক্ষেত্রে বিরাট কিছুটা এগিয়ে থাকবেন সচিনের চেয়ে। যদিও সচিন সেই অর্থে খেলেনওনি ফাস্ট রিস্ট স্পিনার। তবে অফস্পিনের বিরুদ্ধেও সচিনের দুর্বলতা চর্চিত ছিল এককালে। এমনকী, টেস্ট ক্রিকেটে ৯২ বার সচিনের উইকেট নিয়েছেন স্পিনাররা, যার মধ্যে বেশিরভাগই অফস্পিনার। মুরলি-মন্টি পানেসার-ভেত্তোরির বিরুদ্ধে সচিনের দূর্বলতা স্পষ্ট। বিরাটের অফস্পিনের বিরুদ্ধে স্ট্যাটিসটিক্স অপেক্ষাকৃত অনেক ভাল। যদিও সচিন মুরলিধরনের মতো কিংবদন্তি ফিঙ্গার স্পিনারের বিরুদ্ধে খেলেছেন, তবু সামগ্রিক অফস্পিন বোলিং ইউনিট হিসেবে ধরলে বিরাট বা সচিনের ক্ষেত্রে খুব তফাৎ থাকে না কারণ নাথান লিও-র মতো কার্যকর অফস্পিনারকে বিরাট এক দশক ধরে সাবলীলভাবে সামলেছেন।

এই ফ্যাক্টরটিতে অ্যাডভান্টেজ বিরাট কোহলি!

এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, চারটি ফ্যাক্টরের মধ্যে তুলনামূলক ব্যাটিং বিশ্লেষণে সচিন এগিয়ে থাকছেন ৩-১-এ।

তৃতীয় স্তর (ব্যক্তিগত ক্রিকেটীয় মেধা এবং সময়ের সাপেক্ষে ব্যাটিং নির্মাণ ভেঙে বিনির্মাণের ক্ষমতা)
একজন কালজয়ী ব‍্যাটারের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষমতা হলো নিজের ক্রিকেটীয় দক্ষতার নির্মাণকে ভেঙে বারে বারে উঠে আসার ক্ষমতা এবং এই উঠে আসতে তাঁকে সাহায্য করে তাঁর প্রতিভা, মেধা। বলাই বাহুল্য, সচিন এবং বিরাট এই দুই ব্যাটারই এই ক্ষমতা দেখিয়েছেন, দেখিয়ে চলেছেন অনেক বছর ধরে। ১৯৯৪ সালের আগে সচিন সাদা বলের ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে খেলতেন না। ১৯৯৪ সালে নভজ্যোত সিং সিধু চোটের কারণে খেলতে না পারায় অকল্যান্ডে ওপেনার হিসেবে অভিষেক হয় সচিনের। প্রতিভাবান তরুণ থেকে মহাতারকা হয়ে ওঠার জন্য সচিন ব্যবহার করেছিলেন এই সুযোগটিকে। মাত্র তেইশ বছর বয়সে সচিন ওপেনার হয়ে যে শুধু নিজের ব্যাটিং-এর বিনির্মাণ করলেন তা-ই নয়, ১৯৯৪ সাল থেকে সাদা বলে ইনিংস ওপেন করার বহু মিথ ভাঙলেন সচিন।  উইকেট বাঁচিয়ে ধীরে রান তোলার বদলে ওপেনে নেমেই স্ট্রাইক রেট বাড়ানোর দিকে মন দিলেন সচিন। সমীক্ষা বলছে, মিডল অর্ডার থেকে ওপেনার করে দিতে সচিনের ব্যাটিং গড় ৩৩.৪৫ থেকে লাফিয়ে বেড়ে গিয়েছিল ৪৮-এ। ১৯৯৫-২০০৩ অবধি সচিনের সোনালি ব্যাটিং অধ্যায়ে তিনি বিশ্বের প্রায় সমস্ত কঠিন পিচে ভারতের হয়ে ইনিংস ওপেন করেছেন। সচিনের ক্রিকেটীয় মেধার অন্যতম স্মারক এই ওপেনার হিসেবে বিশ্বের কাছে একটি মডেল তুলে ধরার ইতিহাস। সনৎ জয়সূর্য এক্ষেত্রে সচিনের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও এই কাজ সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে করেছেন সচিনই। পরবর্তীকালে হাশিম আমলা সচিনের রেকর্ড ভেঙেছেন, দ্বিতীয় দশকে।

অন্যদিকে বিরাট কোহলির সবচেয়ে বড় ক্রিকেটীয় বিনির্মাণ বোধ করি ঘটে এই বছর। টানা তিন বছরের খারাপ ফর্ম থেকে বিরাট ফিরে এলেন, এশিয়া কাপ ও এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিরাট যা ক্রিকেট খেললেন, তা বিস্মিত করল ক্রিকেট দর্শকদের।

আউটসুইং বলে খোঁচা এবং রিস্ট স্পিনারের বিরুদ্ধে বারে বারে মিসটাইম কিংবা মিসজাজ করে আউট হওয়ার সমস্যা কাটিয়ে উঠলেন বিরাট। নিজের কেরিয়ারে তিন মাসের ব্রেক নিলেন, স্টান্সে আনলেন সামান্য বদল, লেট আউটসুইং-এর বিপদ এড়াতে ক্রিজে এগোলেন, বিশ্বের উন্যতম সেরা স্পিন ইউনিটের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান ম্যাচে একেবারে সাবলীলভাবে খেললেন শুধুমাত্র নিজের ব্যাটিং দক্ষতার বিনির্মাণের মাধ্যমে। যেভাবে সিডনিতে ‘নো-কভার ড্রাইভ’ ইনিংস খেলে বিশ্বে ঝড় তুলেছিলেন সচিন, বিরাটের ফিরে আসাও তার ক্রিকেটীয় মেধাকে নিয়ে যায় মাস্টার ব্লাস্টারের নিকটবর্তী গ্রহেই। বিরাটের ক্রিকেটীয় প্রতিভার আর একটি দিক, যা গোড়াতে আমরা ছুঁয়ে গিয়েছিলাম, তা হলো টি-টোয়েন্টি ব্যাটার হিসেবে নিজেকে তুলে আনা, ওয়ান ডে থেকে নিজের ব্যাটিং স্টাইলকে টি-টোয়েন্টির জন্য খুব বেশি পালটালেন না বিরাট, বিশেষত, শট খেলার বৈচিত্র দেখালেন না কেরিয়ারজুড়ে। কিন্তু, টি-টোয়েন্টির অ্যাঙ্কর রোলটির জন্য যে সর্বোত্তম ফর্ম হয়, সেখানে নিজেকে নিয়ে গেলেন ডট বলের সংখ্যা কমিয়ে, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটকে আরও ধারালো করে। এক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালের পর সচিনের ওয়ান ডে ক্রিকেটে সিঙ্গেলস নেওয়ার সংখ্যা ( সমীক্ষা বলছে ওপেনার হিসেবে সমসাময়িক যেকোনও ব্যাটারের চেয়ে ৩৪% বেশি সিঙ্গেলস এবং ১১% কম ডটবল খেলেছেন সচিন)  বাড়িয়ে খেলার ধারণা বদলে দেওয়ার ঘটনাটিকে একাসনে রাখা যেতে পারে।

এই ক্রিকেটীয় মেধা প্রসঙ্গে সবচেয়ে জরুরি অংশটি হলো কেরিয়ারজুড়ে প্রতিপক্ষ বোলিং শক্তি। সচিনের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ বোলিং-এর সর্বশ্রেষ্ঠ ছয় অস্ত্র ছিলেন ওয়াসিম আক্রম-কার্টলি আম্ব্রোজ-এলান ডোনাল্ড- ম্যাকগ্রা-শ্যেন ওয়ার্ন ও মুরলিধরন। (সচিনকে সর্বাধিক আউট করেছেন ব্রেট লি- কিন্তু ব্যক্তিগত ডুয়েল নয়, এখানে আমি ধরতে চাইছি সামগ্রিক বোলিং শক্তি)। আক্রমের টেস্ট বোলিং গড় ২৩.৪৬, উইকেট ৪১৪। ম্যাকগ্রার গড় ২১.৬৪ এবং উইকেট ৫৬৩। ডোনাল্ড  ২২.২৫, ৩৩০। আমব্রোজ ২০.৯৯, ৪০৫। ওয়ার্ন এবং মুরলি একত্রে নিয়েছেন দেড় হাজারেরও বেশি উইকেট, গড় যথাক্রমে ২৫.৭৬ ও ২২.৭২। প্রথমে দেখি এই চার পেসারের বিরুদ্ধে সচিনের স্ট্যাটিস্টিক্স। স্ট্যাটিসস্টিক্স বলছে ম্যাকগ্রা যখনই অজি বোলিং ইউনিটে থেকেছেন সচিনের গড় ছিল ৩৫, ম্যাকগ্রা না থাকলে ৭০.২২। ডোনাল্ড থাকাকালীন দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সচিনের গড় ৩২, আক্রম থাকাকালীন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সচিনের গড়ও কাছাকাছিই, খুব আহামরি নয়। যদিও আমব্রোজের সেরা ফর্মের বোলিং-এর বিপক্ষে সচিনের স্ট্যাট বেশ ভালো এবং একবার খারাপ আম্পায়ারিংয়ের শিকারও হতে হয় তাঁকে। অন্যদিকে শ্যেন ওয়ার্নকে এ বিশ্বে যদি কোনও ব্যাটার সবচেয়ে বেশি সাবলীল শট খেলে থাকেন তবে তা সচিন। ২৯ বার সাক্ষাতে সচিনকে মাত্র ৪ বার আউট করতে পেরেছেন ওয়ার্ন, অন্যদিকে শারজার ঐ অতিমানবিক ইনিংস-সহ প্রায় ৪৫-এর ওপর ব্যাটিং গড় সচিন ধরে রেখেছেন ওয়ার্নের বিপক্ষে (যদিও ব্যাটারের গড় এক্কজন বোলারের বিপক্ষে এত সহজে ক্যালকুলেট করা যায় না, তবু ক্রিক-ইনফোর ক্যালকুলেশন অনুযায়ী +/_ ৪৫ হিসেবেই ধরা হলো)। মুরলীর বিপক্ষে সচিনের রেকর্ড গড়পড়তা, আহামরি নয়, তবে খুব সাদামাটাও নয়। ১৩ বার আউট হয়েছেন, গড় ধরে রেখেছেন ৩৮+।

তবে একথা অনস্বীকার্য, সমসাময়িক ব্যাটারদের চেয়ে এই ছয় কালজয়ী বোলারের বিপক্ষে সচিনই সবচেয়ে ধারাবাহিক ছিলেন (একজনের বিরুদ্ধে না, ছয় জনের বিরুদ্ধে গড় ধরা হলো)।

বিরাট যে ছ'জন শ্রেষ্ঠ বোলারকে কেরিয়ারের বড় অংশজুড়ে খেললেন, তাঁরা হলেন মিশেল স্টার্ক, ট্রেন্ট বোল্ট, ইমরান তাহির, কাগিসো রাবাডা,জেমস এন্ডারসন, প্যাট কামিন্স। এছাড়া সাদাবলে রশিদ খান। টেস্টে নাথান লিও-র নাম নিতে হবে। টেস্টে স্টার্কের বোলিং গড় ২৭.৬২, উইকেট ২৮৭; বোল্টের ২৭.৪৯, উইকেট ৩৭০। কামিন্সের গড় ২১.৬৬।, উইকেট ১৯৯, রাবাডার গড় ২২.৪৬, উইকেট ২৫৭, জিমির উইকেট সংখ্যা প্রায় ৬৭০। এই সামগ্রিক পেস ইউনিটের বিরুদ্ধে বিরাটের স্ট্যাটও খুব আহামরি নয়। প্যাট কামিন্সের বিরুদ্ধে বিরাটের গড় ১৬, যা একেবারেই বিরাটোচিত নয়। আবার বোল্টের বিপক্ষে টেস্টে বিরাটের গড় বেশ ভাল, প্রায় ৪৮.৪৩। স্টার্কের বিপক্ষে গড় ৩৫.৬৫। যদিও বিরাটের সবচেয়ে ভালো ব্যাটিং গড় অস্ট্রেলিয়ার পেসার মিশেল স্টার্কের বিপক্ষে, প্রায় ৬০-এর কাছে গড় নিয়ে স্টার্কের বিপক্ষে খেলেছেন বিরাট। নাথান লিও-র বিরুদ্ধে বিরাটের অফস্টাম্পে সরে এসে শাফল করার অভ্যাসকে লিওন আক্রমণ করেছেন, তবু লিওনের বিরুদ্ধে খুব খারাপ স্ট্যাট ধরে রাখেননি বিরাট। যদিও ৭ বার লিওনের বলেই টেস্টে আউট হয়েছেন বিরাট।

সচিন-বিরাট তুল‍্যমূল্য বিশ্লেষনে এই প্রতিপক্ষ বোলিং ইউনিটের বিষয়টি অতি জরুরি। বা হয়তো কাউকে উনিশ-বিশে এগিয়ে রাখার অন্যতম সূচক। পরিসংখ্যান বলছে, বিরাট তাঁর সমসাময়িক সেরা বোলারদের বিপক্ষে টেস্টে সচিনের চেয়ে সামান্য এগিয়ে। কিন্তু একথা মনে রাখা আশুই প্রয়োজন আই সি সি-র রেটিং পয়েন্টের বিচারে বিশ্বের সর্বকালের সেরা ৫০ জন টেস্ট পেসারের মধ্যে ১২ জন খেলেছেন সচিনের বিপক্ষে এবং ৮ জন খেলেছেন কোহলির বিপক্ষে; ওডিআই ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা পঞ্চাশ বোলারের মধ্যে সচিন খেলেছেন ২২ জনকে, বিরাট খেলেছেন মাত্র ৪ জনকে। তাই সমসাময়িক ছয় বোওলারের বিরুদ্ধে দুই ব্যাটারের পরিসংখ্যানে বিরাট সামান্য এগিয়ে থাকলেও ওই এডভান্টটেজ কিছুটা লঘু করছে এই শেষ পরিসংখ্যান।

সর্বশেষ যে বিষয়টিতে আমরা আসব, তা হলো বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে পারফরম‍্যান্স। যদিও একথা ক্রিকেট বিজ্ঞান অনুমোদিত হতে পারে না যে, একজন ব্যাটারের ব্যাটিং দক্ষতা একটি বা একাধিক নকআউট ম্যাচের পারফরম‍্যান্সের ওপর নির্ভর করে, তবুও এই ফ্যাক্টরটিকে আলোচনায় আনার কারণ অবশ্যই চাপ সহ্য করার ক্ষমতার মতো একটি বিষয়কে টেনে আনা। ২০০৩ সালের সেঞ্চুরিয়নে পাকিস্তানের দুরন্ত বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠিন ম্যাচে সচিনের ৯৮ রান, মুম্বইতে ৯৬ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৯০ রান, বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৮৫ রানের তিনটি ইনিংস সচিনের বিশ্বকাপের কঠিন ম্যাচে খেলা অন্যতম সেরা ইনিংস, এছাড়া সাক্লিন-আক্রম-শোয়েবের বিপক্ষে ৯৯ বিশ্বকাপে ম্যাঞ্চেস্টারে সুইং আবহে ওপেন করে কঠিন ভারত-পাক ম্যাচে ৪৫ রানের একটি দুরন্ত ইনিংস খেলেন সচিন। অন্যদিকে বিরাট কোহলির বিশ্বকাপের সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস নিঃসন্দেহে ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে ৩৫ রানের মহামূল্যবান ইনিংস। সচিন-সেহবাগ ফিরে যাওয়ার পর ওই ইনিংসটি ভারতের জয়ের ভিত গড়ার আখর হতে পেরেছিল। কোহলি ২০১৫,২০১৯ সামগ্রিক বিশ্বকাপে ভাল রান পেলেও (যেমন সচিন পেয়েছিলেন ২০০৩,২০১১ বিশ্বকাপে) কঠিন ম্যাচে একক দক্ষতায় ম্যাচ বের করে দেয়ার মতো ইনিংস খেলতে পারেননি, যেমনটা সচিন পারেননি ২০০৩ বা ২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে। তবে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বিরাট কোহলির পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫৫ রানের ইনিংস এবং ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে অতিমানবিক ৮২ রানের ইনিংসটিকেও বিশ্বকাপের কঠিন ম্যাচ উইনিং নকের তালিকায় রাখা যায়। এই জায়গায় দুই কিংবদন্তির বিশ্বকাপে পারফরম‍্যান্স কার্যত একই রেখায় দাঁড়িয়ে, নকআউট ম্যাচে একক দক্ষতায় ম্যাচ জেতানোর মতো ব্যাটিং কেউই সেভাবে দেখাতে পারেননি, যে কারণে কাউকে এগিয়ে পিছিয়ে রাখা যায়।

এই দীর্ঘ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু এক ও একমাত্র ব্যাটিং। বিরাটের টেস্ট ক্যাপ্টেন্সির অবিশ্বাস্য সাফল্য, ফিল্ডার হিসেবে নিজেকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাওয়া কিংবা সচিনের অন্যতম সেরা পার্টটাইম বোলার হয়ে ওঠার মতো ফ্যাক্টর এ আলোচনায় স্বেচ্ছায় আনিনি। নিক্তিতে মেপে বিচার করতে চেয়েছি ভিন্ন দশকের দুই মহাতারকার ব্যাটিং-এর তুল্যমূল্য আলোচনা।

‘শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে…’- সত্যিই শেষ কথা বলে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। বিরাট ও সচিনের ব্যাটিং প্রতিভা সমগ্র বিশ্বের বিস্ময়। তবু, যদি এ বিশ্লেষনের ফলাফল দেখি, তবে ‘সচিন নন। ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান কোহলিই’- এই স্টেটমেন্টের বিপক্ষেই দাঁড়াব। অন্তত নভেম্বর ২০২২ অবধি যে সময়খণ্ড, তার সাপেক্ষে। বিরাট প্রথম স্তরে অর্থাৎ স্ট্যাটিসটিক্সের দিক থেকে সচিনের সমআসনে আসছেন। তৃতীয় স্তরে ক্রিকেটীয় মেধা ও ব্যক্তিগত ব্যাটিং স্টাইলের বিনির্মাণের ক্ষেত্রেও প্রায় ছুঁয়ে ফেলছেন সচিনকে ( বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিটি ফ্যাক্টর ধরেই), কিন্তু দ্বিতীয় স্তর অর্থাৎ ক্রিকেটীয় ফ্যাক্টরে ব্যাটিং প্রভাবিত হওয়ার স্তরটিতে সচিন এগিয়ে থাকবেন। সমকালীন ব্যাটার না হওয়ার দরুণ আমাদের সচিন-বিরাট তুলনায় কিছু কনভার্সন ফ্যাক্টর রাখতেই হত, তা ক্রিকেটীয় অঙ্ক মেনেই রাখা হল তাই। অর্থাৎ একথা বলা চলে - ক্রিকেটের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে ১৫ নভেম্বর ২০২২ অবধি ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান এখনও সচিন তেণ্ডুলকর। বিরাট কোহলি আপাতত দ্বিতীয় স্থানেই। তবে, কোহলির কেরিয়ার বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়ার পর এ বিশ্লেষণের ফলাফল বদলে যেতেই পারে।

তথ্য সূত্র
ইএসপিএন ক্রিকইনফো
ন‍্যাশনাল হেরাল্ড
ক্রিকবাজ
ক্রিকইনফো
চেজ ইয়োর সাপোর্ট
ক্রিকেট মান্থলি
বিবিসি নিউজ
উইজডেন
ক্রিকেটওয়েব
সচিন অ্যান্ড ক্রিটিকস

More Articles