লুকিয়ে থাকা রুটম্যাপ: সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়
Bengali Short Story: “প্রতারিত হবেন না। সতর্ক থাকুন। সঠিক ঠিকানায় পৌঁছতে হলে এখানে আসুন। সস্তায় আপনার গন্তব্যের একেবারে দরজা অবধি পৌঁছে দেব।"
সারাদিন লোকটার কোনও কাজ নেই। সারা সকাল, সারা দুপুর এমনকি সারা সন্ধ্যা লোকটার কাজ নেই। তবু অনেক রাতে লোকটা বাড়ি ফেরে। বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লোকটা প্রথমে প্যান্টের বাঁ পকেটে হাত ঢুকিয়ে চাবি খোঁজে, সেখানে না পেয়ে লোকটা ডান পকেটে খুঁজতে শুরু করে। অনিবার্য ভাবেই এই দু’টো পকেটের কোনওটাতেই চাবি থাকে না। পুরোনো বাসের টিকিট, বিপত্তারিনীর লাল সুতো, ভেঙে যাওয়া বিড়ি, এমনকি ভবানী হার্ডওয়ারের পেরেক, ছেনি আর হাতুড়ির বিলটাও লোকটা বারবার খুঁজে পায়। কিন্তু চাবির গোছাটা পায় না। এই এক সামান্য পাঁচটা চাবির গোছা লোকটাকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। পাঁচটা চাবির একটা এই বাইরের গেটের, আরেকটা ভেতরের দরজার। বাকি তিনটে চাবি আসলে যে কীসের লোকটা জানেও না। কিন্তু চাবিগুলো লোকটা ফেলেও দেয় না। হয়তো কখনও কোনও তালা খুঁজে পাবে, তখন এই চাবিগুলোই কাজে লাগতে পারে এসব ভেবেই লোকটা তিন বছর এই চাবিগুলো রেখে দিয়েছে। কিন্তু যতই সে মাত্র পাঁচটা চাবির গোছা হোক, প্রতিবার লোকটা প্রয়োজনের সময় খুঁজে পায় না।
সব পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে লোকটাকে তার ব্যাগের চেনটা খুলতেই হয়। প্রায় প্রতিবারই তিনদিনের পুরোনো খবরের কাগজের ভেতর থেকে লোকটা চাবির গোছাটা খুঁজে পায়। তারপর আরেক ঝক্কি। এই তিন বছরেও লোকটা কিছুতেই প্রথমবারেই ঠিক চাবিটা ঢোকাতে পারে না। বিভিন্ন চাবি ঢুকিয়ে ঢুকিয়ে তবেই সে বাইরের গেটের আসল চাবিটা খুঁজে পায়। তারপর আবার এভাবেই ভেতরের দরজার চাবি খুঁজতে হয়। ইদানিং লোকটার জীবনে কাজ বলতে শুধু এইটুকুই। চাবি হারানো এবং চাবি খোঁজা। একবার চাবিটা খুঁজে পেলেই লোকটা ওর হলুদ রঙের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। যেন গর্তের মধ্যে একটা দিন আস্তে করে ঢুকে গেল। বাইরে তখন অন্ধকার রাত। রাত আস্তে আস্তে আকাশ পেরোচ্ছে। রাতে আর বেশিক্ষণ জেগে থেকে লোকটা কাজ বাড়ায় না। শুয়ে পড়লেই ছুটি। তাই তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ে লোকটা এবং শুয়ে শুয়ে নানান নম্বর মুখস্থ করে। বিভিন্ন রকমের নম্বর। ২২/৬, ৩৪/১২, ৩০ বি/১৭, ৬৪/৮ সি এবং আরও আরও নম্বর। রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে হাঁটলে ১২ থেকে শুরু হয়। ১২/১, ১২/২, ১২/৩, ১২/৪ এভাবে। তবে ১২/৪ এর আবার এ, বি, সি এমন তিনটে ঘর আছে। জগন্নাথ স্ট্রিটে কিন্তু নম্বরগুলো এমন ঝামেলার নয়। সেখানে পরপর ১, ২, ৩, ৪, ৫.... এমন চলছে। হ্যাঁ, মাঝে যদি ফ্ল্যাট পড়ে যায় তবে ৬/এ, ৬/বি এগুলোও মনে রাখতে হয়। আজকাল পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙে আবার ফ্ল্যাট হতে শুরু করেছে। তবে তাতে লোকটার এমন কিছু অসুবিধা হচ্ছে না। এই তো ৩ নম্বরের ডাক্তার দত্তর ওই মান্ধাতার আমলের রঙ ওঠা, ইঁট বেরোনো বাড়িটা নাকি ফ্ল্যাট হবে। মানে ৩/এ, ৩/বি, ৩/সি এমনি করে আবার নম্বর হবে। শুনেছে ফ্ল্যাটের নাম হবে অন্নপূর্ণা অ্যাপার্টমেন্ট। সে যেটাই হোক, এই সব নম্বর মনে রাখা লোকটার কাছে জলভাত প্রায়। হাতের তালুর মতো।
আর হবে নাই বা কেন? সাত বছর লোকটা রোজ রাতে এই নম্বরগুলো মনে করে আসছে। নিজের মতো করে একটা ম্যাপ বানিয়ে নিয়েছে। সেই ম্যাপ ধরে রোজ রাতে লোকটা মনে মনে হাঁটতে থাকে। জামতলা মোড় থেকে বাঁ দিকে বিজুবাবুর রাস্তা আর ডানদিকে বড় দুর্গা মন্দিরের রাস্তা। বাঁ দিকে চলে গেলে সোজা এসে পড়বে জগন্নাথ স্ট্রিট। বিপিন মুদির দোকান ডানদিকে রেখে এগিয়ে গেলেই সমাদ্দার লেন। কিন্তু সেদিন যখন লোকটা হঠাৎ দেখল, ফোনের ম্যাপে বিপিন মুদির দোকান অবধি দেখানো আছে লোকটার অবাক হওয়ার শেষ রইল না। ম্যাপ খুলেই যদি সবাই ঠিকানা জেনে যায় তাহলে লোকটার কাজই তো চলে যাবে। কী হবে তখন? আজ প্রায় সাত বছর লোকটা রোজ সকালে স্নান করে, ডাল ভাত আলুমাখা আর একটা যে কোনও ভাজা খেয়ে, লোকনাথ বাবা আর রামকৃষ্ণসহ কালিকে ধূপ দেখিয়ে ওই জামতলা মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটার হিসেব মতো জামতলাতে রোজ অন্তত দশ হাজার মানুষ আসে। কেউ কোনও অফিসে ইন্টারভিউ দিতে আসে বা কেউ হয়তো নতুন বাড়ি ভাড়া খুঁজতে। যদিও ইন্টারভিউয়ের থেকে বাড়ি ভাড়া খোঁজার ক্যান্ডিডেটই বেশি। কী করতে যে লোকজন এই ভিড় প্যাচপ্যাচে জায়গায় বাড়ি খুঁজতে আসে কে জানে!
যাই হোক, তাতে তার কী! তার কাজ হলো শুধু ওই জামতলা মোড়ে একটা হোর্ডিং হাতে দাঁড়িয়ে থাকা। “প্রতারিত হবেন না। সতর্ক থাকুন। সঠিক ঠিকানায় পৌঁছতে হলে এখানে আসুন। সস্তায় আপনার গন্তব্যের একেবারে দরজা অবধি পৌঁছে দেব।" লোকজন খোঁজ করতে এলে দরদাম করত। এক কিলোমিটারের মধ্যে ১৫ টাকা, দুই কিলোমিটার পেরোলে টাকা ডবল। রিকশা বা অটো ভাড়া ক্লায়েন্টের। লোকটার কাজ শুধু জামতলা মোড় থেকে নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া। দিনের শেষে রোজগার যা হতো তাতে লোকটা বাড়ি ফেরার সময় মাসির দোকানে চা টোস্ট খেয়ে সিগারেট ধরিয়ে বাড়ি ফিরত। তখন লোকটা এই ছোট মাঠের পাশের গলিতে থাকতও না। ভাড়া নিয়েছিল পালপাড়ার ওখানে। কিন্তু এই গত তিন বছর আর কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ইদানিং তো ক্লায়েন্ট এত কমে গেছে যে মাঝে মাঝে শুধু চা খেয়েই লোকটাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয় সন্ধ্যায়। এখন আর তেমন কোনও কাজ নেই লোকটার। সারাদিন কোনও কাজ নেই। সব ক্লায়েন্টরাই মোবাইলে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পৌঁছে যায়। প্রথমে তো লোকটা বিশ্বাসই করতে চায়নি যে, মোবাইলে ঠিকানা দেখা যায়। কিন্তু সেদিন যখন খোঁড়া বাপি বলল, “দেখো দেখো বিপিন মুদির দোকানটা পৰ্যন্ত মোবাইলে দিয়ে দিয়েছে,” লোকটার প্রথম মনে হলো আটটা দশের লোকালে মাথা দিয়ে দিই। আর এমন বেকার বেঁচে কী লাভ? আর তো কেউই তার কাছে ঠিকানা খুঁজতে আসবে না। লোকটার নাকের ডগা দিয়ে সব ঠিকানা খোঁজা লোকেরা মোবাইলের ম্যাপ দেখে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে যাবে।
কিন্তু পরশু দিনের ঘটনাটা লোকটাকে আবার নতুন করে বাঁচার সাহস দিয়েছে। পরশুদিন যখন এই সন্ধ্যা হব হব করছে তখনই লোকটা নতুন ঠিকানা খুঁজতে বেরিয়েছিল। এই কাজ তার গত সাত বছরের। লোকটার বাবা বলতেন, “পরিশ্রমের দাম আছে। পরিশ্রম করলে ঠিক একদিন তার ফল পাবে।” তাই লোকটাও কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না। আজও সে বাড়ি ঢোকার আগে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যনগর আর মাস্টারপাড়ার কোন গলিতে ক’টা নতুন ভাড়া এসেছে, কী নাম তাদের সব জেনে এসেছে। ক্লায়েন্ট এলে নাম বললেই যাতে লোকটা বুঝে যায় কোথায় যেতে হবে। যাতে ঠিকানা বলতেই না হয়। ক্লায়েন্টও চমকে যাবে আর যার ঠিকানায় ক্লায়েন্ট পৌঁছাবে সেও চমকে যাবে। ভাববে, আমাকেও এক ডাকে সবাই চেনে। এই ভেবে সেও লোকটাকে মনে রাখবে। মনে রাখানোটাই আসল কাজ। এখন সবাই সবকিছু কত তাড়াতাড়ি ভুলে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে লোকটা পরশু দিন সন্ধ্যায় যখন ঘোষপাড়ায় ঢুকেছে তখনই দেখে দুজন অল্প বয়সী ছেলে, ১৭/৩/৫ বি ঘোষ পাড়া আর খুঁজে পাচ্ছে না। সহজ ঠিকানা, তাও খুঁজে পাচ্ছে না। লোকটা তো শুনেই বুঝে গেছে। ওই ঠিকানা মোবাইল ম্যাপে কী করে খুঁজে পাবে আর? মোবাইল ম্যাপে তো আর এটা লেখা নেই ওই গলিতে এখন মোমোর দোকান হয়ে গেছে। মোবাইল ম্যাপ জানে না এখন ওই ঠিকানায় যেতে গেলে লক্ষ্মী মিষ্টির দোকান দিয়ে ঘুরে যেতে হবে। তার মানে কোনও রাস্তায় হঠাৎ মোমোর দোকান হলো, কোন ঠিকানা ছেড়ে কে চলে গেল, কোন ঠিকানায় নতুন কারা এল, কোন অফিস বন্ধ হয়ে গেল, কোন মুদির দোকান পালটে হোম ডেলিভারি হোটেল হয়ে গেল সেটা আর মোবাইল ম্যাপ হিসেব রাখে না। রাস্তা খোঁড়া থাকলে বা ভাঙা থাকলে মোবাইল ম্যাপ জানতে পারে না। গাড়ি এসে থমকে যায়। লোকটার হেবি মজা লাগে তখন। শালা মোবাইল ম্যাপের বাচ্চা। কর এবার কী করবি! আর পালপাড়ায় যে হাবু নামের তিনজন থাকে, ড্রাইভার হাবু, মাস্টার হাবু আর ছোটো হাবু সেটাও মোবাইল ম্যাপ জানে না। এই একমাত্র সুযোগ লোকটার। খুঁজে খুঁজে মানুষ বার করতে হবে। আর শুধু ঠিকানা জানলে চলবে না, সেই ঠিকানার বাসিন্দাদেরও জানতে হবে। মাসির দোকানে আটদিনের টাকা দেওয়া হয়নি। বিপিন মুদিও টাকা পায়। লোকটা মনে করতে থাকে কোন ঠিকানায় কে থাকে। ১৩/৪ এ গগন সামন্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করে, ১৩/৫ এ নতুন ভাড়া এসেছে দু’টো মেয়ে। একজন নার্সিং পড়ে আর আরেকজন বিউটি পার্লারে চাকরি করে। ১৩/৬ ফাঁকা আর ১৩/৭ এ ভবানী হার্ডওয়ারের গোডাউন। সব মনে রাখতে হবে। মোবাইল ম্যাপ শুধু ঠিকানা জানে, লোকটাকে খুঁজে বার করতে হবে ওই ঠিকানার মানুষগুলোকে। তবেই আবার লোকটার কাজ থাকবে। প্রচুর কাজ। সারাদিন।