বাংলা ভাষা একটি চব্বিশ ঘণ্টার বিনোদন প্যাকেজ

International Mother Language Day: তিরিশ বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভালো স্কুল বলতে বুঝত হিন্দু, হেয়ার, বেথুন, বালিগঞ্জ কি উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট, পুরুলিয়া কি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি বহু প্রতিষ্ঠানকে

বাঙালি তার সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখবে নাকি ‘মিল দেবে কনডেন্সড মিল্কে’ – তা নিয়ে আমি বলার কে! স্বয়ং নীরদবাবু কবে বলে গিয়েছেন, আত্মঘাতী বাঙালি। আর আমি কোন-সা চৌধুরী! তাহলে এ-লেখার অবতারণা কেন? কারণ, মাসটা ফেব্রুয়ারি। আর দুয়ারে ফেব্রুয়ারি এলে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বড্ড বাংলা ভাষা পায়।

ভাষা দিবস, কার্যতই বাংলাদেশের অহংকার। কিন্তু এ-রাজ্যের গড় বাঙালির কাছে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে অলংকার মাত্র। এ-কথা বললে অনেকে রুষ্ট হবেন জানি, কিন্তু অন্যরকম ভাবার কোনো কারণ ও পরিস্থিতি দেখি না। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে কি বাংলা ভাষার জন্য বচ্ছরকার বরাদ্দ স্রেফ চব্বিশ ঘণ্টার প্যাকেজ? শাড়ি, পাঞ্জাবি, আর হালকা ভলুমে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে…’ ইত্যাদি? আজকের ভদ্র ও ভণ্ড বাঙালির মুখে এইসব গান শুনলেই অন্তরাল থেকে যেন কেষ্টদার বাণী ভেসে আসে – ‘লজ্জা লাগা দরকার!’ যেভাবে আমরা প্রভু যিশুর ‘হ্যাপিওয়ালা বাড্ডে’ পালন করি, ভাষা দিবসও আদপে আমাদের কাছে তা-ই। একটা জন্মদিন উদ্‌যাপন, আর একটা মৃত্যুদিন – ফারাক বলতে এটুকুই।

স্বীকার করি বা না করি, বাংলা ভাষার ন্যূনতম সম্মানটুকু আমরা অবশিষ্ট রাখতে পারিনি। সে আজ সমর্যাদায় যেটুকু বরং বেঁচে আছে, তা আলোকপ্রাপ্ত সমাজ থেকে ঢের দূরে দাঁড়িয়ে থাকা গরিব-গুরবো, শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে। তাঁদের কাছে বাংলা অন্তত এখনও হীনম্মন্যতার পরিচায়ক নয়। তাই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে তাঁদের ঘাড়ে ডিও মেরে মিছিলে হাঁটতে হয় না, মুখস্ত করা স্লোগান দিতে হয় না, দেড় হাজার শব্দের মরসুমি গদ্য নামাতে হয় না ‘বাংলা ভাষা বাঁচাও’ শিরোনামে। বাংলা ভাষা তাঁর কাছে ঘামের মতো স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। অথচ বিত্তের সঙ্গে, খানিক বেশি অর্থের সঙ্গে যেখানেই যোগ, বাংলা ভাষার আসন সেখান থেকে টলে গিয়েছে অনেকদিন। কারণ, মাতৃভাষাকে কেবল মুখে ‘প্রাণপ্রিয়’ বলে গেলেই হয় না, ভিতরে বিশ্বাস এবং বাইরে প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কথায় নয়, প্রমাণ করতে হয় কাজে, কাজে এবং একমাত্র কাজে।

আমরা দেখেছি, এককালে আমদানি হয়েছিল এফএম-এর দো-আঁশলা বাংলা বুকনি। সেই কুৎসিত ভাষা নিশ্চয় ‘অশ্রাব্য’ ছিল না, নইলে অত মানুষ শুনতেন কেন? কলকাতার বিনোদন জগতের অধিকাংশ কলাকুশলীর মুখের বাংলায় ওই বিচিত্র ঢং আজও প্রাধান্য পায়। লক্ষণীয়, আপাত রঙিন এই দুনিয়ায় লগ্নি হয় অনেক বেশি টাকা। হয়তো সে-কারণেই বাংলা হরফ না-চেনা তরুণ প্রজন্মের বং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রোমান স্ক্রিপ্টে লিখে দেওয়া বাংলা ডায়লগ আউড়ে পার পেয়ে যান। সাম্প্রতিককালে এমন অনলাইন সংবাদ মাধ্যমেরও উত্থান হচ্ছে যেখানে সজ্ঞানে ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃত বাংলায় লিখতে হয়, তা বহু মানুষের, বিশেষত শহুরে অল্পবয়সিদের নিত্য ব্যবহৃত ভাষার কাছাকাছি বলে। বিস্মিত হবেন না অদূর ভবিষ্যতে সার্বিকভাবে ভারতের জন্য নির্দিষ্ট করা আন্তর্জালের ভাষার তালিকায় ‘বাংলিশ’ দেখতে পেলে।

আপত্তিজনক বিলক্ষণ, তবে এই পর্যন্ত ততটা আশঙ্কাজনক ঠেকে না। কিন্তু অসহায় লাগে, যখন দেখি আমাদের ব্যবহৃত অপশব্দে বা স্ল্যাঙে, সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থাকা সত্ত্বেও ক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে বাংলা। গোপালের ‘সঁড়া অন্ধা আছি’ জনশ্রুতিটির কথা মনে পড়ে যায়। প্রতিবর্ত ক্রিয়ার উপরে যদি প্রভাব পড়ে, তাহলে বুঝতে হবে, নিশ্চিত আমরা মূল থেকেই সরছি। হিন্দি আর ইংরাজির আগ্রাসন যদি সবচেয়ে বেশি আজ কোথাও থাবা বসিয়ে থাকে, তা এই বুলশিট আর মাদারবোর্ডে।

বাংলাকে হীন জ্ঞান করা আজকের প্রবণতা নয়। ঔপনিবেশিক প্রভুর দাসত্বের অন্যতম প্রাপ্তি ছিল এই অবজ্ঞা। কিন্তু বিশ্বায়ন-পরবর্তী গত বিশ-পঁচিশ বছরের মতো তা এমন সার্বিক রূপ কখনও পেয়েছে বলে মনে হয় না। এইখানে শিক্ষাক্ষেত্রে মাধ্যম নির্বাচনের প্রসঙ্গটি আসবে। আগেও বাঙালি তার সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম ইশকুলে পড়িয়েছে; সেই পক্ষপাতে অন্যায় বা অপরাধ কিছু ছিল না। বরং তা কারো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলেই মনে করি। কিন্তু দু-আড়াই দশকে ছবিটা একটু বেশিই বদলাল। ‘ভালো’ স্কুল আর ‘তত ভালো নয়’ স্কুলের বাইনারিটা বদলে গেল ‘খুব ভালো’ আর ‘খারাপ’ স্কুলে; এবং সেই বিভাজনও হয়ে পড়ল পূর্ণত ইংরেজি মাধ্যম আর বাংলা মাধ্যমের সমার্থক। তিরিশ বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ভালো স্কুল বলতে যেমন বুঝত হিন্দু, হেয়ার, বেথুন, বালিগঞ্জ কি উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট, পুরুলিয়া কি নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি বহু প্রতিষ্ঠানকে, তেমনই সাউথ পয়েন্ট কিংবা লরেটোর মতো স্কুলকেও সে একইরকম ভালোর তালিকায় ফেলত। ভালো-মন্দের এমন বিভাজন তখনও যে সবসময় খুব উচিত কাজ ছিল, তা বলছি না। কিন্তু পড়ানোর মাধ্যম অন্তত তখন ইশকুলের বিশেষণ হয়ে উঠতে পারেনি। বেতনের অঙ্ক হয়ে ওঠেনি ভালো-খারাপের মাপকাঠি। এই যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘ভালো’-র সংজ্ঞা বদলে দিতে পারা, শিক্ষাকে পুরোদস্তুর বিপণনের সামগ্রী করে তুলতে সফল হওয়া, আগাগোড়া ব্যবস্থাটাকেই বিত্তশালীর পোষ্যসম ন্যাওটা প্রমাণ করে ফেলা – এ-সবই ঘটে গেল খুব অল্প সময়ে। আর, সেই পুতুলনাচের ইতিকথায় পিঠে সুতো বেঁধে মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি।

একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে পড়ার মাধ্যম কোনওদিনই নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়নি। এমনকী ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সঙ্গেও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কোনও সম্পর্ক নেই, যেমন বাংলা ভাষায় দখল তৈরির সঙ্গে নেই বাংলা মাধ্যমে পড়ার সামান্যতম যোগ। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূত্রে দেখেছি, আজও বাংলা ভাষা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম করেন এমন অনেক বন্ধুর পড়াশোনাই ইংরেজি মাধ্যমে। কাজেই, মাধ্যম নির্বাচনের ক্ষেত্রটিতে নয়; সমস্যার শিকড় গাঁথা রয়েছে ইংরেজি মাধ্যমের প্রতি তৈরি হওয়া আদেখলাপনায়, সন্তানকে ঘোর অ্যাংলো বানাতে চাওয়ার দুর্মর বাসনায়। বুঝতে পারি, প্রভু বিদায় নিয়েছেন পৌনে শতক হল বটে, কিন্তু বাঙালি বাবু-বিবির মন এখনও ফেরেনি। বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের মর্যাদাবোধ যে আর ছিটেফোঁটাও বেঁচে নেই, সে-কথা বুঝিয়ে দেয় গত দু-দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালি অভিভাবকদের ক্রমবর্ধমান এই নালঝোল-ফেলা প্রবণতা। ‘বেঙ্গলি মিডিয়াম’ থেকে মাসমাইনে নেওয়া শিক্ষক-অধ্যাপকও নিজ ত্বকের পুরুত্ব বিবেচনা না করে সন্তানের জন্য লাইন লাগান সদ্য গজিয়ে-ওঠা ইংরেজি মাধ্যম ‘ভালো’ স্কুলে; বছর বছর বই-বিয়োনো কবিও বিন্দুমাত্র অনুশোচনায় ভোগেন না তাঁর মেয়েটি বাংলা হরফ ঠিকমতো চিনতে শিখল না বলে; স্বনামধন্য গদ্যকার, জাঁদরেল সাংবাদিক কিংবা বৌদ্ধিক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক ভারী ভারী বাক্যে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলেন, কিন্তু একটি বারও ভাবেন না তাঁর ছেলের মুখ ফসকে একটি বাংলা শব্দ বের হলেও সটান গার্জেন কল হতে পারে। তাহলে, কীসের একুশে ফেব্রুয়ারি? কে বলেছে, বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নাকি নিকোনো উঠোনে ঝরে রৌদ্র?

এসব ক্ষেত্রে অতি পরিচিত ও অন্তিম সাফাই – সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে…। সন্দেহ হয়, সন্তানের ভবিষ্যৎ না কি তাঁর নিজের হীনম্মন্যতা, সত্যিই কোনটি অধিক সক্রিয় ভূমিকা নেয়। অনেকটা ওই পইতে-আংটি পরা যুগপৎ বিজ্ঞান ও বামমনস্ক বামুনের মতো; যাঁরা বলেন, ‘আমি মানি না, কিন্তু বাড়ির লোককে তো আর আঘাত দেওয়া যায় না!’ এমতাবস্থায় দিবস উদ্‌যাপনের অলীক কুনাট্যে মজে থাকা ছাড়া আর পথ কী? কিন্তু শুধু এই দিয়ে যে কোনোদিনই বাংলা ভাষার হাল ফিরবে না, তা হলফ করে বলা যায়। রাষ্ট্রের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ প্ল্যানিং’ বা ভাষা পরিকল্পনার সুদূরপ্রসারী ক্ষেত্রটিতেও বাংলা ভাষার গৌরবোদ্ধারে যাবতীয় ক্ষুদ্র স্বার্থ সরিয়ে রেখে প্রকৃত প্রস্তাবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের সম্ভাবনা আজ ক্ষীণতর। একইভাবে পুঁজির সঙ্গে জোর শক্তপোক্ত না হওয়া পর্যন্তও পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ফাঁকা শ্লেটের চেয়ে কালো। আর এসবের জন্য সর্বাগ্রে দরকার বাংলা ভাষাকে যথাসম্ভব কেজো হিসেবে প্রতিপন্ন করা। মরাকান্না, বিপ্লব কিংবা গ্যাদগেদে ন্যাকামির বদলে স্রেফ বাঙালি হিসেবে নিজের আত্মসম্মানটুকু বজায় রাখতে পারলে এবং নিজের প্রাত্যহিক জীবনে তা অভ্যাস করে গেলেও হয়তো সে-কাজে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যেত। আমরা পারিনি, এ আমাদেরই ব্যর্থতা।

 

More Articles