বড় ভাষার দাদাগিরিতে আজ যে ছোট ভাষাগুলির নাভিশ্বাস

২১ ফেব্রুয়ারি আসলেই প্রতিটি বাঙালি যেন নিজেকে আরো বেশি করে বাঙালি ভাবেন। খানিক কলার তুলেই গর্ব করে বলেন সেইসব বীর শহfদদের কথা, যারা সেদিন প্রাণের তোয়াক্কা না করেই ঝাঁপিয়ে পরেছিল বাংলা ভাষার জন্য। হয়তো বা আবেগে গা ভাসিয়ে পাড়ি দেন ১৯৫২ সালেই।  তাই হয়তো আজকের দিনে বাংলা ভাষা নিয়ে মাতামাতি করতে গিয়ে তাঁরা ভুলে যান, আজকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। শুধু বাংলা নয়, আজকে প্রতিটা জাতিগোষ্ঠীর নিজেদের ভাষাকে উদযাপন করার দিন। সেইকথা মাথায় রেখেই আজ বরং বাংলা ভাষা নয়, আজ বলা যাক এমন কিছু মাতৃভাষার কথা যা বাংলা তথা অন্যান্য ভাষার আগ্রাসনে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে কিম্বা দাঁড়িয়ে আছে বিলুপ্তির অন্তিম সীমানায়।       

পৃথিবীতে ক্রমাগত ভাষার বিলুপ্তি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীরা আজ রীতিমত শঙ্কিত। সেই বিলুপ্তির তালিকায় বাংলা ভাষার উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ১৯৬১ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছিল, সেই সময়ে ভারতে মোট এগরোশোটি ভাষার প্রচলন ছিল কিন্তু পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে তারমধ্যে প্রায় ২৩০টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০১৩ সালে ভারতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৮৭০-এ। নন-প্রফিট ভাষা ট্রাস্ট’র প্রতিষ্ঠাতা গণেশ ডেভি জানান, সেই ৮৭০টি ভাষার মধ্যে ৪৮০টি ছিল বিভিন্ন জন গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, যা তাঁরা প্রায় সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করতেন। সেই সময়েই তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, ভারতে এই ভাষাগুলিরও অতি দ্রুত বিলুপ্তি ঘটবে এবং তাঁর সেইদিনকার অশঙ্কা যে বর্তমানে বাস্তবায়িত হয়েছে, তা বোধ হয় বলার অবকাশ রাখে না। ২০১০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার হাসপাতালে মারা গেছিলেন ‘আকা বো’ ভাষায় কথা বলা শেষ মানুষটি। তাঁর নাম ছিল সিনিয়র বোয়া। তিনি মৃত্যুর আগে প্রায় বাহান্ন বছর নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার মত কোনো মানুষ পাননি।

আন্দামানের নয়টি জনজাতির ভাষা আজ বিলুপ্ত। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ভারতের প্রায় ৪০টি ভাষা নতুন করে অস্তিত্ব হারানোর পথে পা বাড়িয়েছে। মাত্র কয়েক হাজার মানুষই এই ভাষাগুলি ব্যবহার করেন। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের এগারোটি ভাষা ইউনেস্কোর তালিকা অনুযায়ী আজ লুপ্তপ্রায় ভাষায় পরিণত হয়েছে। সেই এগারোটি ভাষা হল – গ্রেট আন্দামানিজ, জারুয়া, ল্যামংসে, লুরো, মুয়োট, অনগে, পু, সাননো, সেন্টিলেজ, শম্পেন এবং টাকাহানিং। এছাড়াও রয়েছে মণিপুরের সাতটি ভাষা যথা- আমল, আকা, কইরেন, লামগাং, লাংগ্রং, পুরম এবং  তারাও। এই ভাষাগুলি ছাড়াও হিমাচল প্রদেশের চারটি ভাষা ( বাঘাতি, হান্দুরি, পাংভালি ও সিরমাদিও), কর্ণাটকের কোরাঙ্গা এবং কুরুবা, অন্ধ্রপ্রদেশের গাবাদা ও নাইকি, তামিলনাড়ুর কোটা ও তোদা,  ঝাড়খণ্ডের বিরহর, মহারাষ্ট্রের নিহালি, মেঘালয়ের রুঘা এবং পশ্চিমবঙ্গের তোতো  চর্চার অভাবে বিলুপ্তির পথে ভেলা ভাসিয়েছে।

 সারা পৃথিবীতেই ইউরোপীয় ভাষাগুলির আগ্রাসনে আজ বহু ভাষাই বিলুপ্তির পথে। মেক্সিকানদের আদিভাষা কী ছিল, তা সঠিক করে বলা যায় না, মরিসাসের আফ্রিকান কিম্বা ভারতীয়দের বর্তমান ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইংরেজি অথবা ফরাসি। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভাষায় কথা বলেন না। ভারতে মূলত হিন্দি ভাষার বহুল ব্যবহারে এবং সরকারি নানান ক্ষেত্রে এই ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে একসময়ের ‘ভাষার হটস্পট’ ভারতও নিজের ভাষা বৈচিত্রতা থেকে আজ অনেকটাই বঞ্চিত।   

এবার আসা যাক, বাংলাদেশের কথায়। ১৯৫২ সালে আজকের দিনেই যে দেশের মানুষ নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা স্থাপনের লক্ষ্যে পুলিশের বন্ধুকের নলের সামনে দাঁড়াতেও দুবার ভাবেনি, সেই দেশের অনেক ভাষাও আজ বিলুপ্তির পথে। নিজেদের ভাষার প্রতি অবহেলা এবং সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যপক প্রভাবে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলির ভাষা আজ হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে বাংলা ছাড়াও আরো ৪০টি ভাষা থাকলেও এরমধ্যে প্রায় ১৮টি বর্তমানে বিপন্ন ভাষায় পরিণত হয়েছে। তবে এই ক্ষুদ্র ভাষাগুলি রক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান পরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলি বলেছেন, লুপ্তপ্রায় এই ভাষাগুলির মধ্যে ছোঁওরা ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা মোটে চার। এছাড়াও কোল ভাষায় ২ হাজার ৮৪৩ জন, মালত ভাষায় ৮ হাজার জন, কন্দু ভাষায় ৬ হাজার সাতশো জন মত মানুষ কথা বলেন।

ভাষা গবেষকরা আবার এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষদের, জীবিকার কারণে বাস্তুচ্যুত হবার ঘটনাকেও ভাষা বিলুপ্তির কারণ হিসাবে দায়ী করেছেন। এই ভাষাগুলিকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হিসাবে তাঁরা মাতৃভাষায় শিক্ষাদনের বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অনেক্ষেত্রেই আবার দেখা যাচ্ছে এই নৃ-গোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের মধ্যে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও, বর্ণমালার সঙ্গে তাঁদের কোন পরিচয় নেই। ২০০৮ সালে গড় এলাকায় ১২টি বিদ্যালয় প্রথিস্থা করে হয়েছিল। সেখানে গারো শিশুদের আচিক ভাষায় পাঠদান করা হত কিন্তু তিন বছর পর অর্থের অভাবে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০১০ সালে ক্ষমতাসীন সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতিমালায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

More Articles