কলকাত্তাইয়া সাইনবোর্ডের সাতকাহন : কীভাবে বদলে গেল বিপণনের ভাষা?

History of Kolkata Signboards: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে দেখলেই মালুম হয়, বাংলা সাইনবোর্ড সামাজিক নয়, বরং রাষ্ট্রের চোখরাঙানির শিকার।

উনিশ শতকীয় বটতলার ডাকসাইটে লেখক শ্রীভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। ১৮৯৯ সনে প্রকাশিত তাঁর ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’র নায়ক হরিদাসের জীবন রীতিমতো অ্যাডভেঞ্চারাস। পাগলা গারদ থেকে আলিশান নবাবি চাল- সবেরই অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। এহেন হরিদাস, উপন্যাসের শেষে হয়ে ওঠে ন্যায়বান, নীতিবান, আদর্শ পুরুষের সমতুল্য। কলকাতা ছেড়ে বর্ধমানে পাকাপাকিভাবে ডেরাডাণ্ডা পাতার আগে সে নাগরিক জীবনের প্রতি কয়েকটা চোখা চোখা হুঁশিয়ারি দিয়ে যায়। তার মধ্যে একটা হচ্ছে-

বাঙালীরা কারবার জানে না, কেবল চাকরী জানে, এই একটা দুর্নাম ছিল; এখন সেই দুর্নামমোচনের অভিলাষে বাঙালী সন্তানেরা এক একটা কারবারের নামে এক একটা দোকান খুলে বোসছেন, দোকানে দোকানে এক এক সাইনবোর্ড ঝুলছে। সব সাইনবোর্ডে প্রায় দোকানদারের নামের সঙ্গে “এন্ড কোং” জোড়া।

নজিরটা সাহিত্য থেকে নেওয়া বটে, তবে এর থেকে ইতিহাসেরও একটা আঁচ পাওয়া যায়। সেটা এই, উনিশ শতকের শেষাশেষি নাগাদ, কলকাতার পথেঘাটে সাইনবোর্ড একটা চোখে পড়ার মত সামগ্রী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জিনিসটা নতুন বই কি! শ’খানেক বছর আগেও, শহর কলকাতার হাটবাজারের চেহারা ছিল একেবারেই অন্যধারার। ১৭৯১ নাগাদ, জনৈক ফ্রাসোঁয়া বালথাজার দূর ইউরোপ থেকে এসেছিলেন, এই কলকাতায়। ধান্দা ছিল প্রাচ্যদেশীয়দের ছবি এঁকে বিলেতে নাম করবেন। ১৭৯৬ আর ১৭৯৯ সনে দু-ভাগে প্রকাশিত তাঁর ছবির বই, সাবাশি তো পায়নি, উল্টে প্রচুর পয়সা গচ্ছা গিয়েছিল। তবে তাঁর বইতে সেদিনের কলকাতার বিস্তর ছবি মেলে। বাজারের একটি ছবি আঁকতে গিয়ে তাঁর তুলিতে ফুটে ওঠে, ইতস্তত চলমান জনতা, খড়ের চালাঘর, কোথাও আবার ছাউনিটুকু ছাড়াই, দোকানিরা বসে আছেন তাঁদের পসরা সাজিয়ে।

সময়টা একটু এগিয়ে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি, চিৎপুর রোড তখন জমজমাট, তবে তার বাজারের চেহারা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। ১৮৫১ সাল অঙ্কিত, ফটোগ্রাফের উপর হাতে রং চাপানো একটি ছবিতে বাজারের এক ধরনের নতুন রূপের সঙ্গে পরিচিত হই। পূর্বতন ছবির মত অগোছালো বাজার আর নেই। তবে ধরনটা একই রয়েছে। সেই একই চালাঘর, সেখানেই চলছে বিকিকিনি।

আর ১৮৬৭ সালে উইলিয়াম সিম্পসনের আঁকা একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে চিৎপুর রোড, ক্রমশ ঘন হচ্ছে সেখানে বাজারের ভিড়ভাট্টা।

ছবিগুলো সামনে রেখে যেটা বলতে চাইছি তা হল, সে সময়ের বাজারে সাইনবোর্ডের চিহ্ন ছিল না, বরং গ্রামীণ হাটের সঙ্গেই তার মিল বেশি ছিল। ব্র্যান্ড নেই, ফলে গরহাজির সেটিকে বিজ্ঞাপিত করার জন্য কোন সাইনবোর্ড। ব্র্যান্ডনির্ভর বাজার (মার্কেট) আসছে ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রে। সুতরাং, সাইনবোর্ড, সেটা কিন্তু শুধু কোম্পানি বা ব্র্যান্ডের চিহ্ন নয়; সেটা ‘আধুনিকতা’রও চিহ্ন। সেদিনের কেনাবেচার দুটো রূপ। একটা দেশীয়, ব্র্যান্ডবিহীন, অনেকাংশে অসংগঠিত ও বিকেন্দ্রীভূত। অন্যটা  ইউরোপীয়, ঝাঁ-চকচকে, সংগঠিত। সে কারণেই প্রায় সমসময়ের হোয়াইট টাউনে দিব্যি দেখা যাচ্ছে সাইনবোর্ড। উনিশ শতকের মাঝামাঝি তোলা দুটি ছবিতে দেখা যায়, ক্ষমতার ভাষ্য হিসেবেই যেন বা, সাহেবপাড়ার দোকানগুলোতে টাঙানো রয়েছে রোমান হরফের সব সাইনবোর্ড।

এবার আসা যাক সাইনবোর্ডের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্কের তালাশিতে। আন্দাজ করতে তকলিফ নেই, বিপণনের জন্য সাইনবোর্ড ব্যবহার করতে এগিয়ে আসছেন যে বাঙালিরা, তাঁরা কোনও না কোনও ভাবে ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত, শাসনব্যবস্থার কাছাকাছি তাঁদের অবস্থান। এমনই একজন হলেন দ্বারিকানাথ গুপ্ত। ১৮৩৫ সালে মেডিকেল কলেজে মধুসূদন গুপ্তর হাত ধরে প্রথম যে শবব্যবচ্ছেদ হয়েছিল, সেখানে উপস্থিত চারজন ছাত্রের মধ্যে একজন এই দ্বারিকা। কলেজ থেকে বেরিয়ে ডাক্তারিতে পসার জমানোর পাশাপাশি হাত দিয়েছিলেন ব্যবসাতেও। বস্তুত, একেবারে প্রথম পর্বের বাঙালি ওষুধ ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি একজন। ডি গুপ্ত মিক্সচার নামে তাঁর জ্বরের দাওয়াই ছিল জনপ্রিয়। এই দ্বারকা ডাক্তারের বাড়ির সঙ্গেই লাগানো ছিল ইয়া জাবদা কয়েকটা সাইনবোর্ড। রোমান হরফে তাতে লেখা ‘D. Gooptu & Co’।


উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে মেট্রোপলিটন মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠেছিল, তার চাহিদা মেটাবার জন্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী জোগান দিতে দরকার ছিল ভারি ও মাঝারি শিল্প। মিলের কাপড়, মহামারি-রোগজ্বালার সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য রাসায়নিক ওষুধ, রেল, সড়ক ও বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে ঘরবাড়ি তৈরির জন্য যে বিপুল লৌহসামগ্রীর প্রয়োজন পড়ছে- তার জন্য লোহাশিল্প- এ সবই তার উদাহরণ। নিত্যদিনের জিনিস হয়ে উঠছিল হরেক কিসিমের প্রসাধনী, দেশলাই, জুতোর মতো মালসামান। উনিশ শতকের শেষ দশকগুলিতে সেই শিল্পের জগতে পা রাখছিলেন দেশীয়রা। কলকারখানা-নির্ভর এই বিশেষ পুঁজিব্যবস্থার জন্য দরকার পড়ছিল নতুন রকম বিক্রিবাটার। উনিশ শতকের শেষে এসে, সাইনবোর্ড এই ব্যবসার একটা জরুরি চিহ্ন হয়ে উঠছিল। রাস্তাঘাটে হরহামেশা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল তাদের। তবে, পুঁজির সূত্র মেনে গড়ে ওঠা নতুন ব্যবসাদারির দুনিয়ায় হাজির হল যে সাইনবোর্ড- ভাবভঙ্গি, ভাষায়- সেটা পশ্চিমের অনুসারী। ডি গুপ্তর সাইনবোর্ড তারই সাক্ষ্য দেয়।

সাইনবোর্ডের ভাষায় বড়সড় বদলটা এল স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে। সেই সময়ে গড়ে ওঠা শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলি সাইনবোর্ডের ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিল বাংলাকে। ভাষার ইতিহাসেও এই সময়পর্বটি খেয়াল করার মতো। একটি সমাজ-রাজনৈতিক আন্দোলন কিন্তু ক্ষমতাহীনের ভাষাকে একরকম বাণিজ্যিক গ্রহণযোগ্যতা দিচ্ছিল। এর আগে শুধু বাংলায় সাইনবোর্ড লেখা হলেও তা ছিল চোখে পড়ার মতো সীমিত। এবার এতদিন যে ভাষায় সাইনবোর্ড লেখাকে খানিকটা নীচু চোখে দেখা হত, এখন সেই ভাষার অনুপস্থিতিকে দেখা হতে লাগল নীচু চোখে। ১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি যে ভাষা আন্দোলন সম্ভব হয়েছিল, তা তো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নানা স্তরে বাংলা ভাষার ক্ষমতায়ন সম্ভব করেছিল সেই জাদুমুহূর্তটিকে। ভাষার ক্ষমতায়নের ইতিহাসে একটি জরুরি ঘটনা স্বদেশি সময়পর্বে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠালাভ। শুধু মৌখিক ব্যবহারে নয়, ক্ষমতার বিপরীতে ঝলসে ওঠা পাল্টা চ্যালেঞ্জ হিসেবে। সাইনবোর্ডের ভাষা হিসেবে। 

আজকের কলকাতায় ইতিউতি ‘সাধনা ঔষধালয়ে’র যে বর্ণাঢ্য সাইনবোর্ডগুলি চোখে পড়ে, সেই প্রতিষ্ঠানটি এই সময়েরই ফসল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র, রসায়নের অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র ঘোষ ঢাকায় গড়ে তোলেন ‘সাধনা ঔষধালয়’, ১৯১৪ সালে। তবে তাঁর ব্যবসা শুধু ঢাকায় থেমে থাকেনি। দুই বাংলায় অনেকগুলো বিপণি আর কারখানা গড়ে উঠেছিল এই সফল প্রতিষ্ঠানের। হরেক কিসিমের ওষুধের বিস্তারিত বিবরণ চোখে পড়ত তাদের সাইনবোর্ডে। 

স্বদেশি সময়পর্বে গড়ে ওঠা আরও কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের ইতিহাস ধরে রেখেছে সাইনবোর্ডে। ‘স্বদেশি’ শব্দটাই কোথাও কোথাও হয়ে উঠছে ব্যবসার ইউএসপি। 

১৯৪০-এর দশকের একটি ছবিতে বড়বাজারের (স্ট্র্যান্ড রোড আর হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থল) চেহারা তো বাংলা সাইনবোর্ডে ছয়লাপ। স্বদেশি নানা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে তা ভরা।

এইখানে দাঁড়িয়েই আরেকটা কথা বলে নিতে হয়। সেটা এই, আমরা ইতিহাস-রচনার যে উপাদানগুলির কাছে মুখ্যভাবে হাত পাতি, মহাফেজখানা বা পুরোনো বইপত্র- তার বাইরেও শহর কলকাতা নানাভাবে তার ইতিহাস ধরে রেখেছে। কোথাও গণস্মৃতিতে, কোথাও রাস্তার নামকরণে, কোথাও নামফলকে, আবার কখনো সাইনবোর্ডে। নেহাত স্বাভাবিক যে, অতীত সংরক্ষণের এই মাধ্যমগুলি একান্তভাবেই তার নাগরিকদের সৃজন। ঐতিহাসিকতা রক্ষার দায় তার নেই। তবে কলকাতা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বা বিদ্যায়তনিক চর্চা ব্যতিরেকেও তার অতীত সংরক্ষণে সক্ষম, সে নিজেই এক জীবন্ত আর্কাইভ।কী আশ্চর্যভাবেই না বউবাজার লোহাপট্টির সাইনবোর্ডগুলি প্রমাণ করছে এই ব্যবসায় বাঙালির দু'শতকের অংশীদারির কথা। খেয়ালযোগ্য দোকানগুলির প্রতিষ্ঠা-সাল। ১৮৩৬- ১৯৩৬- এই একশো বছর জমাট বেঁধে রয়েছে সেখানে।

লক্ষ্যণীয়, উপরের সাইনবোর্ডগুলোর সবই প্রায় দোভাষী। ইংরেজির পাশাপাশি সেখানে স্বচ্ছন্দে জায়গা পেয়েছে বাংলা। জন্মলগ্ন থেকেই কলকাতায় এসেছেন বহু ভাষাগোষ্ঠী। তাঁদের সবগুলি জায়গা না পেলেও, ইংরেজি আর বাংলা বাদে, আরও অনেক ভাষায় লেখা হয়েছে কলকাতার সাইনবোর্ড। হিন্দি আর উর্দু ভাষার সাইনবোর্ডগুলো তো বাংলার সম্পদ। দুশো বছরের পুরনো আতরের দোকান থেকে শুরু করে হাল আমলের ‘লেডীস ব্যেগ মটেরীয়লস’- সবই হাজির সেখানে।

উপমহাদেশে ভাষার সাথে নানাবিধ পরিচিতিকে জড়িয়ে নেওয়ার অভ্যাস আজকের নয়। উৎসগতভাবে সহোদরা ভাষা হলেও, হিন্দি আর উর্দুর মাঝে পাঁচিল তোলার কাজ চলেছে বছরের পর বছর। সেখানে মূলত ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এই দুই ভাষার হাত ধরাধরি আমাদের আশ্বস্ত করে। জানতে ইচ্ছা হয় এই সহাবস্থানের শর্ত, ইতিহাস। এও স্মর্তব্য, একটি শহর বহুভাষিক হলেও, সেখানে সব ভাষার সমান সামাজিক স্বীকৃতি নাই থাকতে পারে।  সাইনবোর্ড চিনিয়ে দেয় একটি শহর সামাজিক ভাবে কোন ভাষাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। সরকারি ভাবে বাংলার স্বীকৃতি থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষমতার ভাষা হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতা সামান্যই। তাই, কলকাতা কী ভাবে পুঁজির ভাষা হিসেবে এতগুলি ভাষার সহজ সহাবস্থান আয়ত্ত করতে পেরেছিল- তা আজ ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে যাঁরা শঙ্কিত, তাঁদের ভেবে দেখতে হবে বাংলা ভাষা এক সময়ে সংখ্যাগুরুর ক্ষমতার ভাষা হলেও অন্যান্য ভাষাগুলির সঙ্গে স্বচ্ছন্দ্যে মিশে যেতে পেরেছিল, কোনো কারণে।

তবে সাইনবোর্ডের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক শুধু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং নানা সময় রাজনীতি নিজেও নিয়ন্ত্রণ পেতে চায় পুঁজির ভাষার। সাইনবোর্ডের ভাষার ইতিহাসে রাজনীতির সাথে তার সম্পর্ক তলিয়ে দেখার মতো। ভাষাকে কেন্দ্র করে যখনই নেমেছে দাঙ্গা তখনই আক্রান্ত হয়েছে সাইনবোর্ড। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আসামের ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের কথা অনেকেরই জানা। আসামের কোন অংশই যাতে পশ্চিমবঙ্গের সাথে যুক্ত না হয়, মূলত এই দাবিতে ১৯৫০’র পর থেকেই আসামে দানা বাঁধছিল আন্দোলন। ১৯৫৫ নাগাদ, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন আসামে এলে পরিস্থিতির অবনতি হয়। মার্চ-এপ্রিল মাস থেকেই আক্রান্ত হতে থাকেন বাংলাভাষীরা। ৯ এপ্রিল, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ধুবড়ির বাঙালিদের পক্ষ থেকে ডেপুটি কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া আবেদনপত্র- “আমরা বাঙালীরা দুইবার আপনার নিকট আমাদের রক্ষার জন্য আবেদন জানাইয়াছি। তথাপি বাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের সাইনবোর্ড টানিয়া নামানো হইয়াছে, দোকান লুন্ঠিত হইয়াছে এবং আমাদের কয়েকজনের বাড়িতে ইঁট-পাটকেল নিক্ষিপ্ত হইয়াছে।” শুধু একটি দিন নয়, এই আক্রমণ নেমে এসেছিল বারংবার। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে পড়ছিল, বাংলার জাঁদরেল নেতা ও প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অতুল্য ঘোষ প্রকাশ্য বিবৃতি দেন কংগ্রেস পরিচালিত আসাম সরকারের বিরুদ্ধে। সেখানেও হাজির সাইনবোর্ড ভাঙার প্রসঙ্গ।

সময়পথে আরেকটু এগোলেই আসবে মুক্তিযুদ্ধের একাত্তর। ভাষা আগ্রাসনের কোপ সেখানে ভালোমত পড়ে সাইনবোর্ডের উপর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে দেখলেই মালুম হয়, বাংলা সাইনবোর্ড সামাজিক নয়, বরং রাষ্ট্রের চোখরাঙানির শিকার। আর অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গেই চুপিসারে ডানা মেলে প্রতিরোধ। ঐতিহাসিক এম এ মোমেন তাঁর স্মৃতিচারণে জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকেই তাঁরা পরিকল্পিতভাবে ইংরেজি, উর্দু সাইনবোর্ডে লেপে দিতেন কালো রং। এই কর্মসূচির পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন আলকাতরা’। দখলদার পাকিস্তান আর স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশ- এই দুই বিবদমান পক্ষের ক্ষমতা আস্ফালনের ক্ষেত্র সাইনবোর্ড।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮৭ সালে তৈরি হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয় সেখানে। হলে হবে কী, সাইনবোর্ডে সেই রোমান হরফের রবরবা। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের এক বেঞ্চ জানান, দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দপ্তরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে। বছরখানেকের মাথায় আদালত উষ্মা প্রকাশ করে জানান, খোদ সরকারি আপিসের সাইনবোর্ডের ভাষাতেই কোনও বদল আসেনি, বেসরকারি ক্ষেত্র তো অনেক দূরের কথা। আর মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছরে পা দিয়েও রকমসকম একই। ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন রীতিমতো অভিযান চালাতে থাকে বাংলা সাইনবোর্ড চালু করার জন্য। বহু ইংরেজি সাইনবোর্ড ভেঙে দেওয়া হয় বুলডোজার দিয়ে। সুতরাং এটুকু খুব সাফ, যে বাংলাদেশকে বাংলা ভাষার নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করেন অনেকেই, সেখানেও ক্ষমতার ভাষা, পুঁজির ভাষা হিসেবে পয়লা নম্বরি আসনখানার দখল নিয়েছে ইংরেজি। রাষ্ট্র ফের হাত ওঠাচ্ছে সাইনবোর্ডের উপর।  

মনে প্রশ্ন আসে, হয়তো অযথাই, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি না মিললে ২১ ফেব্রুয়ারি নিয়ে এতটা আগ্রহ থাকত কি? বোধহয় সাইনবোর্ডের ভাষা এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব, কারণ সেখানে এই স্বীকৃতির মূল্য বড়ই কম। সেটাই স্বাভাবিক, পুঁজি তা বেচবে না, যাতে তার লোকসান হয়। কিন্তু সাইনবোর্ডের ভাষা তো সবসময় ক্ষমতার সূত্র মেনে চলেনি। নানা ঘটনায় তার ভিতর জেগে উঠেছে অন্তর্ঘাত। সেই ইতিহাস ফিরে দেখলে, আজকের গোলকায়িত ভাষাবিশ্বে, মাতৃভাষার আপন পরিসর সন্ধানের কিছু সুবিধা হলেও হতে পারে।

More Articles