ভাষার মাতৃত্ব সংক্রান্ত চাট্টি কুকথা
পৃথিবীতে যত সংস্কার রয়েছে তার মধ্যে কৃষ্টি ও ভাষা সংস্কার থেকে মুক্ত মানুষের সংখ্যা হয়তো সবচেয়ে কম। একজন আধুনিক মননের মানুষ যত অনায়াসে ‘ধর্ম’ ও ‘জাতিসত্তা’ কে প্রশ্ন করেন, যত সহজে ভেঙে ফেলতে পারেন ‘সামাজিক’ সব বিধি আরোপ, তছনছ করতে পারেন ‘বিধিবদ্ধ’ যৌনরুচি, ঠিক ততটা আয়াসে মাতৃকৃষ্টি ও মাতৃভাষাকে (সমাজ ভেদে পিতৃও হতে পারে) নিয়ে প্রশ্ন করতে স্বস্তি বোধ করেন না । আমি যতটা সহজে নিজের ভোটার আই-ডি তে থাকা ‘ভারতীয়’ জাতিসত্তাকে একটি চাপিয়ে দেওয়া রাজনৈতিক কাল্পনিক নির্মাণ মনে করি, ফর্ম ফিলাপের সময় ধর্মের জায়গায় থাকা ‘হিন্দু’ ধর্মীয় সত্তাকে একটা অতিরিক্ত বোঝা মনে করি, ঠিক ততটা সহজে কি প্রশ্ন করি মাতৃভাষা হিসেবে থাকা বাংলাকে? উত্তরটা নেতিবাচকই।
অথচ ‘ভারতীয়ত্ব’, ‘হিন্দুত্ব’ এরই মতো তো বাংলা ভাষাটাকেও তো আমি নিজ ইচ্ছায় নিজের মাতৃভাষা হিসেবে টিক মার্ক দিইনি। যে যুক্তিতে ভারত আমার দেশ হয়েছে, যে কুযুক্তিতে আমি হিন্দু হয়েছি, সেই একই যুক্তিক্রম অনুযায়ী আমার মাতৃভাষা বাংলা। ‘প্রথম ভাষা’, ‘দ্বিতীয় ভাষা’র মতো শব্দ দিয়ে ‘মাতৃভাষা’র ক্ষমতার জোর ঠিক বোঝা যায় না। যে কোনো ‘বাঙালি’-সূচক পদবির মানুষ বাংলায় থেকে শিক্ষার জন্য প্রথম ভাষা হিসেবে ইংরেজি বেছে নিলেও , মাতৃভাষা থেকে তার দায়মুক্তি ঘটে না। ‘সচেতন সুশিক্ষিত’ মানুষরা সেই ব্যক্তির মাতৃভাষা চর্চা করা, কিংবা, চর্চা না করা দুই দিয়েই বিচার করতে থাকেন। আবার আমার মতো ‘অবাঙালি’-সূচক পদবি দেখলেই , আমার মাতৃভাষা হিসাবে বাংলাকে মেনে নিতে প্রাথমিক ভাবে খানিক দ্বিধা আসে তাদের।
অর্থাৎ মাতৃভাষা ‘প্রথম ভাষা’, ‘দ্বিতীয় ভাষা’র মতো যৌক্তিক কাঠামো নয়, বরং একটা সমূহের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। সুতরাং ‘জাতিসত্তা’ ও ‘ধর্ম’ যে কাঠামোর উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে মাতৃভাষাও সেই একই কাঠামো থেকে জাত। এই ভাষা ব্যক্তির উপর আরোপিত এবং ব্যক্তিসত্তাকে পরাধীন করে রাখতে একটি পরিশীলিত হেজেমনিক বাধ্যতামূলক অনুশীলন। আর সেই অনুশীলনের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া আপাদমস্তক সংস্কারগ্রস্ত অহমিকার নাম মাতৃভাষা । তাই ‘জাতিসত্তা’ ও ‘ধর্ম’ যে অর্থে একজন আধুনিক ব্যক্তিসত্তার কাছে ‘ট্যাবু’, মাতৃভাষাও সেই একই নিরিখে আরেকটি ট্যাবু মাত্র। তাই মাতৃভাষা নিয়ে সোচ্চারে স্লোগান দিতে থাকা প্রজাতিরা “ভারত মাতা কি জয়!” বা “গর্বের সাথে বল আমি হিন্দু” এই প্রজাতিদের সঙ্গে তুতো ভাবে সম্পর্কিত।
বস্তুত ভাষার সঙ্গে মা-কে মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করে যে ‘পবিত্রতা’ ও ‘চিরানুগত্য’ লেজুড় হিসেবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে তা সামন্ততান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের পরিচায়ক । জন্ম ও লালনপালন সূত্রে পাওয়া একটি ‘উত্তরাধিকার’ কী করে একজন ব্যক্তির সহজাত হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তা নিয়ে ভাবলে বিপন্ন হতে হয় । একটা খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাক। ১৯৮০ থেকে ২০০১ অবধি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ও মেক্সিকো থেকে প্রচুর স্প্যানিশ মাতৃভাষী অভিবাসী ঢুকতেন আমেরিকায় সেইসব দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার হেতু। মার্কিন ইংরাজি মাতৃভাষা বিশিষ্ট শিশুদের দেখভালের জন্য এই সমস্ত অভিবাসীদের মহিলারা নিয়োগ হতে থাকেন যথেচ্ছ ভাবে । আশির দশকের শেষ থেকেই ‘অসুবিধাটা’ পরিলক্ষিত হয়, দেখা যায় ইংরাজি মাতৃভাষাবিশিষ্ট শিশুরা স্প্যানিশে বেশ দরের হয়ে উঠছে ইংরাজির চেয়েও। মাতৃভাষাকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে প্রত্যেক স্প্যানিশভাষী শিশুপালিকাদের মার্কিন ইংরাজি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং বাধ্যতামূলক নির্দেশ দেওয়া হয় শিশুদের সঙ্গে শুধুমাত্র মার্কিন ইংরাজিতে ( ভাঙা ভাঙা হলেও) কথা বলার ও শোনার। এই নির্দেশকে আপাত দৃষ্টিতে ‘মাতৃভাষা বাঁচাও’ -এর নিরীহ নিক্তি ঠেকলেও, একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে এক সামন্ততান্ত্রিক লেঠেল ভয় পাচ্ছে আরেক লেঠেল তাকে যদি উৎখাত করে দেয় ।
ঘরের কাছে উদাহরণগুলি নিলে ব্যাপারগুলি আরো স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারা যায়। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণিয়ার গঙ্গা দিয়ারার যে অংশটি তৎকালীন বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয় সেই অংশের ভাষা ছিল দ্বারভাঙিয়া মৈথিলি ( যা পরবর্তীতে ‘খোট্টা’ নামে অভিহিত হয়) । বাংলা প্রভিন্সের যাবতীয় আধিপত্যবাদী অংশ হয়ে ওঠার জন্য এই অঞ্চলের সাবর্ণ হিন্দুরা ইংরেজির পাশাপাশি যে ভাষাটি শুধুমাত্র শিক্ষায়াতনে নয়, বাড়ির অন্দরেও ধীরে ধীরে প্রবেশ করাতে শুরু করে তা হল বাংলা। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এর ফলাফল হিসাবে এই অঞ্চলের ‘মৈথিল’ এবং ‘রাজপুত’ পদবিসূচক সাবর্ণ হিন্দুদের মাতৃভাষা হিসাবে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ফলাফল হিসেবে এই দুই সম্প্রদায়ই বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতার ভাগ পায়। অথচ এই অঞ্চলের মুসলমান, চাঁই, তিয়োর, দুসাধ’রা বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসেও প্রথম ভাষা হিসাবে শিক্ষায়তনে বাংলা চর্চা করতে খুব অসুবিধার সম্মুখীন হতো এবং তারপরেও জোর করে তাদের মাতৃভাষা বাংলা হিসাবেই সরকারি ভাবে নথিভুক্ত করে এই অঞ্চলেরই সাবর্ণ হিন্দুরা। এই ‘অস্বাভাবিক’ চাপিয়ে দেওয়ার ফলাফল হিসেবে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মালদহের এই অঞ্চলের মাতৃভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা। বাংলাতেই এখন ‘স্বাভাবিক’ ভাবে নিজের আবেগকে প্রকাশ করে থাকে এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষজন। মাতৃভাষা বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ‘সহজাত’ হলে এইটা ঘটত না।
একই ভাবে অসমে বাংলা-ডায়াস্পোরার মুসলমান প্রাথমিক ভাবে অহমীয়াকে মাতৃভাষা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে পুরো বিংশ শতাব্দী ধরে স্রেফ প্রাণে বাঁচার জন্য। সাম্প্রতিক ভারতের এনআরসি ইস্যুতে যখন তার সেই অহমীয়া-সত্তা প্রশ্নের মুখে এলো, প্রতিরোধের রাস্তা হিসাবে কিন্তু অসমের বাংলা-ডায়াস্পোরার মুসলমান নিজের পৃথক ভাষা ‘দোয়ান’কে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্যই একের পর এক কবিতা ও গদ্য লিখতে শুরু করে যার রাজনৈতিক নাম ‘মিঞা কবিতা’। মজার ব্যাপার এই যে অসমে ‘মিঞা কবিতা’র অন্যতম প্রধান স্বর কাজী নীলের বিরুদ্ধে পুলিশে যে অভিযোগটি নথিভুক্ত হয় তা হল অহমীয়া ভাষাকে বিপন্ন করতে নতুন একটা ভাষার জন্ম দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছেন নীল। আরো মজার ব্যাপার নীলের মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃত ভাষাটি হল অহমীয়া। মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে বাধ্যতামূলক এই নির্দেশ সকল ও সমস্ত আস্ফালন এই ধারণাকেই জোরদার করে যে গা-জোয়ারি ছাড়া যেমন ধর্ম ও জাতিসত্তা রক্ষা করা যায় না, ঠিক একইভাবে, হরেকরকমের নরম ও গরম পন্থা ব্যতীত মাতৃভাষাকে রক্ষা ও বিস্তৃত করা যায় না।
হিন্দি মাতৃভাষীদের ভারতবর্ষের উত্তর-১৯৪৭ নরম পন্থাটি হল বলিউডকে ভারতীয় সিনেমা বলে চালানোর চেষ্টা, আর গরম পন্থাটি হল ভারতীয় কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে মূলত হিন্দিভাষী প্রশাসন করে তোলা। এই আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য শিবসেনা মারাঠি অস্মিতা দিয়ে বা তামিলরা নিজদের ফেকলোরগুলোকে সত্যি বানানোর চেষ্টা দিয়ে বা সাম্প্রতিক কালে কিছু ডন কিয়োতে মার্কা পশ্চিমবঙ্গীয় ‘জয় বাংলা’ দিয়ে যা করে থাকেন তা কাউন্টার-ফান্ডামেন্টালিজম ছাড়া আর কিছুই নয়। আর যে সমস্ত ভাষার এই মাতৃভাষা নামক হেজেমনিক আগ্রাসন প্রবণতা নেই, তাদের গ্রাস করে ফেলে অন্যের মাতৃভাষা। টোটো ও রাভা ভাষার ভূমে এসে ডায়াস্পোরিক সাদ্রী ভাষা গ্রাস করে ফেলে টোটো ও রাভা ভাষাকে; বাংলা ভাষা রাজবংশীয় তীব্র প্রতিরোধের আগে প্রায় গিলে নিতে চেয়েছিল রাজবংশীয় স্বাতন্ত্র্য; গোর্খালি নামক এক কাল্পনিক মাতৃভাষার নির্মাণ করে মুছে ফেলা হয় লিম্বু, রাই, লেপচাদের ভাষাস্বাতন্ত্র্য। এই সমস্ত কিছুই দেখায় যে মাতৃভাষা মূলত এক শক্তি রাজনীতির স্তম্ভ যা নিয়ে সংস্কারগ্রস্ত হয়ে থাকে আপাতভাবে সংস্কারহীন মুক্তমনন । এটিই মাতৃভাষার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)