ভাষা আন্দোলনের অক্লান্ত সৈনিক ছিলেন শেখ মুজিব

International Mother Language Day: একজন বাংলাভাষীর সঙ্গেই যেন সমান অধিকার পান একজন উর্দুভাষী বা মালয়লী।

নদীর নাম বিদ্যাধরী। তার উপর দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রিজ। মধ্যিখানে দাঁড়ালে বড় রাস্তার উপর দেখা যায় মস্ত লাল বাড়ি, বসিরহাট জেল। ব্রিজ পেরিয়ে সোজা এগিয়ে গেছে সড়ক, হাকিমপুরের দিকে। সেখান থেকে জিরো পয়েন্ট। ওপারে ভাষা আন্দোলনের মুলুক।স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করে আজও '৫২-র অভ্যুত্থানের স্মৃতিকে সগৌরবে বহন করে চলেছে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের দেশ। ভাষা শহিদের মৃত্যু নেই। শতাব্দী প্রাচীন ভূতের মতোই তাঁরা এসে উপস্থিত হন 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে, ১৯৬৯ সালের মহামিছিলে। এ ছাড়াও সেপাই বিদ্রোহের ফাঁসি যাওয়া সেপাইদের রূহরাও গলা থেকে রজ্জু নামিয়ে এসে মিশে গিয়েছিলেন সে মিছিলের ভিড়ে। তার ঠিক দু'বছর পর দেশ স্বাধীন হল। পৃথিবীর বুকে লাল সূর্যের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠল বাংলা নামের একমাত্র দেশ, বাংলাদেশ। তার রাষ্ট্রনায়ক হলেন  এক মস্ত নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৭ মার্চের জনসভায় দরাজ বক্তৃতায় যিনি মঞ্চ কাঁপিয়েছিলেন, ভাষা আন্দোলনের সময়েও তাঁর ভূমিকা ছিল তাক লাগানোর মতো। 

১৯৪৭ সালে লক্ষ লক্ষ বাঙালির বুকের উপর দিয়ে চলে গেছিল পার্টিশনের কাঁটাতার। সম্পূর্ন ভিন্ন সংস্কৃতির এক ভূখণ্ডকে বলপূর্বক পাকিস্তানের অংশ করে তোলা হয়েছিল। অবশ্য কিছুদিন পরেই বোঝা গেল, পূর্ববঙ্গ নামে মাত্র পাকিস্তানের অংশ। আসলে সে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ। ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের চিন্হগুলো তার মাটিতে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে লাগল। ১৯৪৮ সালে, অর্থাৎ স্বাধীনতার ঠিক এক বছর পর মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করলেন, উর্দুই হবে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। নিয়ম ঠিক হল, যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এতদিন বাংলায় কথা বলে অভ্যস্ত, এবার থেকে তাঁদের জবান পাকাতে হবে উর্দুতে। এ সময় থেকেই ভাষার অধিকারকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন দানা বাঁধছিল। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের জাতিগত বিদ্বেষ প্রবলভাবে ধরা পড়ছিল। যেমন ধরা যাক, ১৯৫২ সালে ফিরোজ খাঁ নুন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের 'আধা মুসলিম' বলে অপমান করেন। একদিকে ঔপনিবেশিক প্রভুদের অনবরত চোখ রাঙানি, অন্য দিকে সাধারণ মানুষের 'অধিকার বুঝে নেওয়া'র আন্দোলন। এভাবেই দিনে দিনে এসে পড়ল রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। 

ঢাকা শহরে সেদিন প্রশাসন ১৪৪ ধারা আগেই জারি করেছিলেন। কোনো রকম মিছিল, মিটিং বা জমায়েত ছিল আইনবিরুদ্ধ। কিন্তু যে দেশ হাজার হাজার মুক্তিসেনার জন্ম দিয়েছে, সেখানে কি আর প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা খাটে? সরকারি বিধি নিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তা ধরে চলতে লাগল মিছিল। পড়ুয়া এবং রাজনৈতিক কর্মীদের সেই দীর্ঘ মিছিল যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে এসে পৌঁছল, তখন পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে লাগলেন। তার আঘাতে পাঁচজন যুবক এলিয়ে পড়লেন মাটির উপর। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তাঁদের নাম, রফিক, সালাম, বরকত এবং জব্বার। ফুঁসে উঠলেন পূর্ব বাংলার মানুষজন। ২২ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হল। ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের এলাকায় শহিদদের সম্মানে গড়ে উঠল শহিদ মিনার। এই সমগ্র কর্মকাণ্ডের সময় কোথায় ছিলেন শেখ মুজিব?

পাকিস্তান সরকার যখন নির্বিচারে পূর্ববঙ্গের সিংভাগ বাঙালির উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন মুজিবের নেতৃত্বে খাস কলকাতায় এক সংগঠন সে দেশের অত্যাচারিত মানুষজনের স্বাধিকারের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলছিল। মুজিব তখন ছাত্র। দিন কয়েকের মধ্যেই তিনি তাঁর শহর ঢাকায় ফিরে এলেন। কিন্তু সেখানে হাত গুটিয়ে বসে থাকলেন না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ভাষা আন্দোলনে। সে সময়ে আন্দোলনের সপক্ষে তমুদ্দিন মজলিস, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মতো সংগঠন তৈরি হচ্ছিল। অনেকের মতোই বঙ্গবন্ধুও তার নেতৃত্বের সমান ভাগীদার ছিলেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষাযোদ্ধাদের সিদ্ধান্ত ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়েছিল। সে ধর্মঘটের সংগঠকের ভূমিকাতেও নাম ছিল শেখ মুজিবের। এমনি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তাঁর কার্যকলাপ যে পুলিশ বাধ্য হয় তাঁকে মারধর করে গ্রেফতার করতে। শোনা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে তিনিই ছিলেন সর্বপ্রথম গ্রেফতার হওয়া কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। 

স্পর্ধার ১৯৪৯ সাল। ভাষা আন্দোলনের আগুন ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। এমতাবস্থায় ফের হাজতবাস ভোগ করতে হল মুজিবকে। গাজিউল হকের মতো ব্যক্তিত্বের লেখায় উঠে এসেছিল ভাষা আন্দোলনের সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে মুজিবের গুরুত্ব প্রসঙ্গ। ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকান্ডের ঠিক পাঁচদিন পর জেল থেকে ছাড়া পান মুজিব। তার এক বছর পর ভাষাশহিদদের স্মরণে আয়োজিত হয়েছিল প্রভাতফেরি, সেখানেও মওলানা ভাসানির মতো নেতার পাশে উপস্থিত ছিলেন তিনি। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করে তোলার দাবি জানিয়ে বঙ্গবন্ধুরা দীর্ঘদিন ধরে লড়াই করেছিলেন। অবশেষে ১৯৫৪ -এ প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হল যুক্তফ্রন্ট। প্রশাসন থেকে তারপর সর্বপ্রথম সিদ্ধান্ত নেওয়া হল বাংলাকে এক অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। 

স্বাধীন বংলাদেশের সংবিধানই সম্ভবত প্রথম বাংলায় রচিত সংবিধান। ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব বাংলাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছিলেন। জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে সেদিন তিনি নিজের বক্তব্য আগাগোড়া বাংলায় পেশ করেছিলেন। তাত্ত্বিক শুভরঞ্জন দাশগুপ্ত মনে করেন বাংলাদেশের হাত ধরেই ইতিপূর্বে বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রসার ঘটেছে এবং ভবিষ্যতেও এ দেশই বাংলাকে রক্ষা করবে। এমনটা সম্ভব হয়েছে কারণ একমাত্র বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা পেয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। 

২১ ফেব্রুয়ারির তাৎপর্যর সূত্রপাত ঘটেছিল বাংলা ভাষা দিয়ে। কালক্রমে দিনটা হয়ে উঠল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষা সকল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের কর্তব্য। একজন বাংলাভাষীর সঙ্গেই যেন সমান অধিকার পান একজন উর্দুভাষী বা মালয়লী। এমন সাম্যাবস্থাই কাঙ্খিত। ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক বহুত্বকে অস্বীকার করে যেমন করে হিন্দিকে অলিখিতভাবে রাষ্ট্রভাষার পদমর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তার বিরুদ্ধে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো আমাদের দায়িত্ব।

তথ্যঋণ: ভাষা আন্দোলন ও আমাদের বঙ্গবন্ধু: ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ

 

More Articles