মহাপাজি, বানান নাজি – ভাষাদিবসের নয়া স্লোগান
International Mother Language Day: শুধু ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ বা ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ বলে চিৎকার করে বাংলা ভাষাকে বাঁচানো যাবে না, আসল কথা হল নির্ভুল বানান লেখার সদিচ্ছা থাকতে হবে।
‘একে তো ফাগুন মাস দারুণ এ সময়’ - স্বয়ং হেমন্তই বসন্তের ফাগুন সম্পর্কে এই কথা বলে গিয়েছেন, তার উপর এই মাসে বাঙালির প্রিয় ভাষাদিবস। শুধু ভাষাদিবস নয়, ভাষাশহিদ দিবস, পরবর্তী কালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এইসব ইতিহাস ইন্টারনেটে খুঁজলে বিস্তারিত জানা যাবে সংক্ষেপে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা শহরের আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর সরকার গুলি চালালে অনেক ছাত্র শহিদ হন, ঘটনাটি ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এই বিষয়ে ঢাকার সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী গান লেখেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’। সেই গান শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি, ভাষাদিবসের অন্যতম ট্যাগলাইন গানের প্রথম লাইনটি। যদিও বাংলা ভাষাদিবসটিকে আমরা ইংরেজি বা খ্রিষ্টীয় দিনপঞ্জির হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারি বলেই জানি, সেটা কি ওই গানের ‘ভুলতে পারি’ সঙ্গে ‘ফেব্রুয়ারির’ মিল দেবার জন্য? অথচ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল বাংলায় ৮ ফাল্গুন। আবার এই ফাল্গুনেই বাঙালির সরস্বতীদিবস আর প্রেমদিবস। দ্বিতীয়টির সঙ্গে বাংলা ভাষার তেমন যোগ না থাকলেও সরস্বতী দিবস ও ভাষাদিবসের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র আছে, সেটি বাংলা পড়া ও লেখা।
এদিকে বাঙালির প্রিয় অভ্যাস হল ভুল বাংলা বানান লেখা, অন্তত ফেসবুকে তাই দেখি, দেওয়াল লিখন, দোকানের সাইনবোর্ডের কথা আর নাই বা তুললাম, কোন পাড়াতে ‘লক্ষী’ স্টোর্স কি ‘লক্ষীনারায়ণ’ ভান্ডার নেই? কেউ সেই দোকানমালিকদের বলে দেননি যে এই বানানে স্বয়ং লক্ষ্মী রুষ্ট হয়েছেন। তো ফেসবুকে কারও বাংলা বানান ভুলের উল্লেখ করলে লেখক ‘টাইপো’ বলে পাশ কাটিয়ে যান অথবা যিনি ভুলের উল্লেখ করেছেন তাঁকে ‘বানান নাজি’ বলে বিদ্রূপ করেন। যাঁরা এইগুলো করেন বাংলা বানান সম্পর্কে তাঁদের এই ঔদাসীন্য আর ঔদ্ধত্য দেখে বাঙালি হিসেবে লজ্জাই করে। ওদিকে বাংলা শব্দভাণ্ডারের দেড় লক্ষ শব্দর কেউ না কেউ প্রতিদিন এঁদের হাতে অপমানিত হয়ে চলেছে। অনেকে বলেন, এঁরা ফেসবুকে লেখার সময় বানান সম্পর্কে ততটা সচেতন থাকেন না, কারণ তাঁরা সামাজিক যোগাযোগের উপর বেশি প্রাধান্য দেন, আমার প্রশ্ন, ভুল বানানে বাংলা লিখে তাঁরা সমাজের সঙ্গে কী যোগাযোগ স্থাপন করতে চান? ভুল বানানে লেখা তাঁর সামাজিক বার্তা পাঠক গুরুত্বই বা দেবে কেন?
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখব বাংলা ব্যাকরণ তথা বানান নিয়ে কাজ হচ্ছে গত ২৪৪ বছর ধরে। ১৭৭৮ সালে নাথনিয়েল হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায় লেখেন বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ 'আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ' , ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরি লেখেন ‘আ গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ’, ১৮৩৩ সালে রাজা রামমোহন রায় লেখেন ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ গ্রন্থ’, ১৮৫৫ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লেখেন ‘বর্ণপরিচয়’, ১৮৮৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লেখেন ‘শব্দতত্ত্ব’, ১৯১৭ সালে জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস লেখেন ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’, ১৯২৬ সালে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় লেখেন ‘অরিজিন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট অফ বেঙ্গলি ল্যাঙ্গোয়েজ’ ১৯৩২ সালে হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। এতগুলি কাজ হওয়ার পরও বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলা দূর করা যায়নি দেখে, রবীন্দ্রনাথের প্রস্তাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে রাজশেখর বসুর সভাপতিত্বে বানান সংস্কার সমিতি গঠিত হয়, এবং 'বাংলা বানানের নিয়ম' প্রকাশিত হয় ১৯৩৫/ ১৯৩৬ সাল নাগাদ। এই বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্কের ঝড় ওঠে, কোনো কোনো সমালোচকের পণ্ডিতম্মন্যতা ও রবীন্দ্রবিরোধিতা প্রকট হয়ে ওঠে। তা সত্ত্বেও এই বানানবিধি একটা নির্দিষ্ট পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নেয় ও বেশির ভাগ অভিধানের মান্যতা লাভ করে। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয় রাজশেখর বসুর বাংলা অভিধান গ্রন্থ ‘চলন্তিকা’।
১৯৮১ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক নতুন কমিটি গঠন করে। এই কমিটি একটি বানান পুস্তিকা প্রকাশ করে ২০০ বিদ্বজনের কাছে মতামত চেয়ে পাঠিয়েছিলেন এবং নতুন সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন, কিন্তু অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে বানান সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন মণীন্দ্রকুমার ঘোষ, জগন্নাথ চক্রবর্তী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, পবিত্রকুমার সরকার।
এত বিতর্ক সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি ‘বাংলা বানানবিধি’ বইটি প্রকাশ করেছেন ১৯৯৭ সালে, এখন প্রায় সবাই সেই বানান অনুসরণ করে।
তবু ফেসবুকে ভুল বানান লেখার প্রিয় অভ্যাসটি বাঙালির আজও গেল না। এই মাসেই ভাষাদিবসে দেখব ভাষাপ্রেমী বাঙালির ফেসবুক পোস্ট, অবশ্যই কিছু বানান ভুলসহ, সবাই যে ভুল করেন তা নয়, যাঁরা করেন তাঁদের সংখ্যাও কিছু কম নয়। তবে হ্যাঁ, এক বাঙালি কাপড় ব্যবসায়ী দেখলাম এ বছর মাতৃভাষা দিবসে কেনাকাটার উপর ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, বিজ্ঞাপনে বানান ভুল নেই। দক্ষিণ কলকাতার এক পাড়ায় দেখলাম, সেই ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের হাসিমুখে ছবি-সহ বড় ফ্লেক্সে বাংলায় পৌরবিজ্ঞপ্তির প্রথম লাইনেই বানান ভুল।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে, পিছিয়ে না পড়ার জন্য এক অবশ্য পাঠ্য বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় [বিজ্ঞাপনের পাতায়] এক মোবাইল ফোন কোম্পানির পাতা জোড়া বাংলা ভাষায় লেখা বিজ্ঞাপনে ক্ষতের মত বানান ভুল দেখে বন্ধু চিকিৎসক মৈনাক পাল, সেই মোবাইল কোম্পানির ওয়েবসাইটে এই বানান ভুল বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমালোচনামূলক একটি পোস্ট করেন। তাই নিয়ে ফেসবুকে হইহই হয়েছিল, সম্ভবত অন্য একটি সংবাদপত্রে [বলা বাহুল্য, পিছিয়ে থাকা] খবরও হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু এই উদ্যম কতজন বাংলাভাষাপ্রেমীর আছে?
লেখক হিমানীশ গোস্বামী তাঁর বই ‘বাংলা বনধ বা শেষের শুরু’ [জানুয়ারি / ২০০৪ ] নামক কৃশকায় গ্রন্থটিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে অনেক প্রশ্ন তুলেছেন রসিকতার ছলে, কিন্তু প্রশ্নগুলো সঠিক। যেমন ‘আন্তরিক শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন’, এই বাক্যটি বহু জায়গায় দেখা যায়, শুভেচ্ছা কি আন্তরিকতাহীন হওয়া সম্ভব? তাহলে কেন এই অতিরিক্ত ব্যবহার অথবা ‘স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠান’, এই হাস্যকর বাক্যটি আজও সংশোধন হল না, রক্ত মানুষ স্বেচ্ছায়ই দান করে, বলপূর্বক রক্তদান বলে কিছু হয় কি?
‘মাতৃভাষা’ শব্দটি নিয়েও প্রশ্ন আছে, মানুষের সব ভাষাই গোষ্ঠীভাষা। যে ভাষা গড়ে উঠেছে প্রথমে পরিবারে, তারপর বেড়ে উঠেছে একটি অঞ্চলে। যে ভাষা বেড়ে ওঠার পিছনে শুধু মা নয়, বাবা, কাকা, কাকি, পিসি, জেঠা, জেঠিমা সবার অবদান আছে, তাকে শুধু মাতৃভাষা বলাটা কি ঠিক? সুতরাং প্রশ্নটা ‘আপনার মাতৃভাষা কী’ না হয়ে হওয়া উচিত ‘আপনার ভাষা কী?’
এসব বিতর্ক থাকবে, তাই বলে নির্ভুল বানান কেন আমরা লিখব না? আর যে সব বাঙালিরা রোমানে বাংলা লেখেন, সেটা একটা ভয়াবহ দৃশ্যদূষণ ও পঠনবিভ্রাট। ফেসবুকে বাংলায় টাইপ করা কঠিন ব্যাপারই নয়, একটু চেষ্টা করলেই শেখা যায়, তাহলে রোমানে বাংলা লেখার এই উদগ্র কামনা কেন?
দু'টি জনপ্রিয় ভুল বানান ব্যবহারের কথা বলে শেষ করছি,
১. কি ও কী – এই দুটির ব্যবহার অধিকাংশ বাঙালি জানেন না অথবা জেনেও ভুল লেখেন। যে প্রশ্নের উত্তর না /হ্যাঁ দিয়ে হবে, সেখানে 'কি' হবে। 'কি' ব্যাকরণে অব্যয় পদ। যেমন, প্রশ্ন: আপনি কি খেয়েছেন? উত্তর: হ্যাঁ অথবা না।
যে প্রশ্নের উত্তর না/হ্যাঁ ছাড়া অন্য কোনও নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে হবে, সেখানে 'কী' হবে। ' কী' ব্যাকরণে সর্বনাম পদ। যেমন, প্রশ্ন: আপনি কী খেয়েছেন? উত্তর: ভাত খেয়েছি।
২. সে আমার সাথে দিল্লি গিয়েছিল – এটি ভুল, লিখতে হবে সে আমার সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিল।
শুধু ‘মাতৃভাষাই মাতৃদুগ্ধ’ বা ‘আ মরি বাংলা ভাষা’ বলে চিৎকার করে বাংলা ভাষাকে বাঁচানো যাবে না, আসল কথা হল নির্ভুল বানান লেখার সদিচ্ছা থাকতে হবে। কোনও বানান নিয়ে সংশয় থাকলে থাকলে তা ইন্টারনেটেই দেখে নেওয়া যায়, তবে হ্যাঁ, একটু সময় লাগে। যে বাঙালিরা বাংলা রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে শহিদ হয়েছেন, তাঁদের কথা ভেবে এই সময়টুকু না হয় আমরা বাংলা ভাষাকে দিলাম।