যৌনতার ভাষা কেমন, সে প্রশ্ন থেকে অনেক দূরে আমরা
মাতৃভাষা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে নিশ্চয়ই আমরা চাইব, ভাষা সমস্ত রকম আধিপত্য, অবদমন এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শাসানির হাত থেকে মুক্তি পাক। এই রক্তচক্ষুর প্রতর্কে যৌনতা এবং পর্নোগ্রাফির মতো বিষয় যে নীতিবাগীশের উত্তমমধ্যম প্রদানের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের দিনে ব্যাপারটা একটু অন্য ভাবেও ভাবার দরকার আছে। একদিন সমাজ যৌনতার নাম শুনলেই নাক-কান-মুখ-চোখ বন্ধ করতে চাইত। আজ উল্টো দিকে যৌনতা নিয়ে যারা চর্চা করেন বা যৌনতার পক্ষে সাওয়াল করেন তারাও নিজেদের মসিহা ভাবা শুরু করেছেন। তাঁদের ভাবটাই এমন যে যৌনতা নিয়ে কথা বললেই কেউ পণ্ডিত, আর যারা যৌনতার ধরণ-ধারণ জানেন না বা কথা বলতে স্বচ্ছন্দ নন-তারা মূর্খ। সবাইকে বাদ রেখে উদ্ধত, একলা চলার একটা প্রবণতা গ্রাস করেছে যৌনতাচর্চার জগতে। আমাদের গার্হস্থ্য ব্যবস্থায় আমরা যৌনতাকে স্থান না দিয়ে, নিজে কতখানি আলাদা, নিজে কতখানি উদার তার বেসাতি তৈরি করতে বসেছি। কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও এই দিনে, চিন্তাগুলোর কাছে আবার একবার ফিরে যাবার দরকার আছে। বোঝার দরকার আছে, যৌনতাচর্চা এবং সমাজ জীবনের মধ্যে ঠিক কোথায় অসঙ্গতি রয়ে গেল। কেন আমরা একে অন্যের পরিপূরক হতে পারলাম না। যৌনতার ভাষা তো আখেরে খুব অল্প লোকই বুঝবে- এমন অবান্তর, বালখিল্য এবং মেরুদণ্ডহীন যুক্তির থেকে প্রশ্নটাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক।
তবে পর্নোগ্রাফির ভাষা প্রতর্কের প্রসঙ্গটি খানিক ভিন্ন। নারীবাদী পরিসর থেকেও পর্নোগ্রাফির প্রতি একটা স্পষ্ট অভিযোগ আছে। সেই অভিযোগের যুক্তিগ্রাহ্য কারণও রয়েছে। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে, এই ‘কলিকাতা’ শহরে ১৯৪০-এর কালপর্বে এক ধরনের দেশি পর্নোগ্রাফির জগত তৈরি হয়ে উঠছিল। আক্ষরিক অর্থেই বাংলা পর্নোগ্রাফি চল্লিশের পরিসরে এক উদ্দাম, বাধা বন্ধনহীন জগত তৈরি করে। এই পর্নোগ্রাফির জগত গার্হস্থ্যর পরিচিতি চৌহদ্দির বাইরে। কিন্তু ১৯৬০ থেকে ৭০-এর কালপর্ব পর্যন্ত, এমন এক দেশি বিনোদনের পরিসর তৈরি হয়েছিল বাংলায় যা পর্নোগ্রাফি এবং যৌনতার এক মিশ্র সাংস্কৃতিক জগতকে তুলে ধরে আমাদের সামনে।
১৯৩৮-এ প্রকাশিত ‘নর-নারী’, ১৯৪৪-র, ‘নতুন জীবন’, ১৯৬০-র, ‘প্রজাপতি’, ১৯৬৫-র, ‘যৌবন’ ইত্যাদি পত্রিকা সেদিন যৌনতা এবং পর্নোগ্রাফির মিশ্র সাংস্কৃতিক রূপটির প্রচারক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পত্রিকাগুলি কোনোটা মাসিক ছিল, কোনোটা ত্রৈমাসিক আবার কোনোটা ষাণ্মাসিক। পত্রিকাগুলির লেখক তালিকায় ছিলেন- বিমল কর, বুদ্ধদেব বসু বা শিবরাম চক্রবর্তীর মতো গুণীজন। এই ধরনের পত্রিকা, সামাজিক ভাবে অবৈধ ছিল বললে ভুল করব আমরা। বরং বৈধ-অবৈধ প্রতর্কে একটা মধ্যবর্তী স্থানে এদের অবস্থান ছিল। পত্রিকা পাঠের অধিকার ছোটদের ছিলনা। কিন্তু বাড়ির বড়রা এবং মহিলারা এমন পত্রিকার মুগ্ধ পাঠক ছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর যৌনতার জগতকে বুঝতে গিয়ে আমরা তার যৌনতা কেন্দ্রিক বিপ্লবের প্রতর্ককে সামনে নিয়ে আসি বারবার। কিন্তু এই ধরনের পত্রিকায় লেখনের মাধ্যমে, বুদ্ধদেব যে এক নতুন গার্হস্থ্যের ধরন নির্মাণ করছিলেন তা একেবারেই এড়িয়ে যাই। এই নতুন গার্হস্থ্য ব্যবস্থায় পাঠের অভ্যেস কেমন হবে, তারও এক রকমের গতায়ত নির্মাণ হচ্ছিল সেদিন। আর সেই গার্হস্থ্যে যৌনতা মোটেই উপেক্ষার বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়নি।
প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগের যৌনতার জগত বুঝতে আমরা কোনো সময় ভারতচন্দ্র রায়ের বিদ্যা সুন্দরের কাহিনি বলি, আবার কখনও দৌলত কাজির- ‘লোরচন্দ্রানী’ নামক গ্রন্থটির উদাহরণ পেশ করি। এই ধরনের গ্রন্থের আলোচনায়, নায়ক নায়িকাদের উদ্দাম যৌন জীবনকে সামনে নিয়ে আসি আমরা। কিন্তু যা একেবারে আনালোচিত রয়ে গেছে, তা হল যৌনতার প্রতর্কে, নায়ক-নায়িকাদের পারিবারিক বোঝাপড়ার ইতিহাস।
সপ্তদশ শতকে রচিত হয়, দৌলত কাজির ‘লোরচন্দ্রাণী’ কাব্য। কাহিনি খুব সামান্য কথায় বললে, গোহারী দেশের রাজকন্যা চন্দ্রাণীর বিবাহ হয়েছে শুরবীর বামনের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের পর রাজকন্যার মাথায় বাজ পড়ল। কারন তার স্বামী একজন নপুংসক। রাজকন্যার সখীরা নানা ভাবে বামনের কামনার জগতকে জাগ্রত করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়। চন্দ্রাণী কাতর অভিমানে বলে- ‘পষু মতে নিদ্রা জাএ শ্বামি নরাধম’। পরবর্তীকালে নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এগোয় রাজা লোরের সঙ্গে চন্দ্রাণীর প্রণয়ের ইতিহাস। আর সবশেষে লোর এবং বামনের যুদ্ধে বামনের মৃত্যু। নিশ্চিত ভাবে নিজের অসুখী দাম্পত্যকে অস্বীকার করে, চন্দ্রাণী প্রেম ভালোবাসার প্রতিস্পর্ধী রূপটিকে সামনে নিয়ে আসে। সেই চন্দ্রাণী এবং লোরের মিলন দৃশ্য বর্ণনায় আলাওলের ভাষাকে কোনো অবদমন গ্রাস করেনি। আলাওল নির্দ্বিধায় বলেন- “দোহো ঊনমত্ত দোহো রসিক ষুজান।/কাম তাপে রতি সাস্ত্রে দোহান বিশ্বান।।/কি কহিব দোহানের মনোরথ রং।/কিছু ষুন নায়ক পাএ জুদ্ধের প্রসং।।/প্রথমে কেলি রস ঘন আলিঙ্গন।/কামতাপে ভয় লৈজ্জ্যা ধ্যৈজ্জ্যেত পালন।।/দন্তে ২ ঘরিসন বদনে বদন।/পুলকে পুলক তনু সঘন চুম্বন।।/হৃদে পাও ধরাধর ঘন বাহু তারি।/রতি রঙ্গে দুইজন মল্ল জরাজরি।।/...ভেদিল রসের গড় পাইল পরিশ্রম।/সহজে সিতল হইল মদন বিক্রম।।”।
তবে যৌনতার উদ্দাম বর্ণনার ভাষার পূর্ণশক্তি তুলে ধরেননি কবি। এমন সংগোপন মূহুর্তটির বর্ণনা আরও আদিরসাত্মক হলেও সমাজের কিছু যায় আসেনা। যে কোনো ব্যক্তি এমন বর্ণনা বাতিল করে ফেলতে পারেন তার পাঠের পরিসর থেকে। আর বাতিল বা সেন্সরশিপকে যে সবসময় নঞঅর্থক ভাবেই দেখতে হবে তারই বা মাথার দিব্যি কে দিয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে কারো যদি লেখার স্বাধীনতা থাকে, তাহলে ব্যক্তিস্তরে সেটাকে কারো বাতিল করার স্বাধীনতাও থাকাটা ভীষণ জরুরি। সেন্সরশিপ তখনই জটিল এবং চোখরাঙানি হয়ে ওঠে যখন রাষ্ট্র এবং তার কিছু পেয়াদা, বন্দুকের বদলে কলম বা প্রাতিষ্ঠানিক কাগজ উঁচিয়ে বলেন- এইটে বাতিল করলুম।
দৌলত কাজী যে অংশে যৌনতার একটি দৃপ্ত ভাষা নির্মাণ করেন, তাহল চন্দ্রাণীর পারিবারিক পরিসরে বোঝাপড়ার মুহূর্তটি। চন্দ্রাণীর সঙ্গে বামনের ব্যর্থ মিলনের কথা শুনে, চন্দ্রাণীর মা নিজে নেমে পড়েন জামাইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে। শাশুড়ি ধাই-কে পাঠান বামনের কাছে, যাতে সে বামনকে বোঝাতে পারে যে দাম্পত্যের মধ্যে যৌনসুখের প্রয়োজনীয়তা। এই যৌন-অসুখী দাম্পত্যের কথা শুধুমাত্র, নারীদের আলোচনা হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকছে না। বরং চন্দ্রাণীর পিতা গোহারীরাজও সামিল হয়েছেন এই আলোচনায়। শুধু আলোচনা নয়, কন্যার অপূর্ণ সুখের কথা জেনে বিষাদে ডুবেছেন রাজা। কিন্তু কোনো আলোচনাই কোনো ফল দেয় না। বামন এবং চন্দ্রাণীর মধ্যে কোনো যৌনসুখের সম্পর্ক তৈরি হয় না।
অতঃপর, চন্দ্রাণী মায়ের কাছে ‘লজ্জা’, ‘ভয়’ বিসর্জন দিয়ে বলে, একদিন যৌবন শুকিয়ে যাবে, তা আর ফিরে আসবে না। ‘কামাকুলসাগরে’ স্বামী-ই নারীর সেতু। কিন্তু এই ‘পশু’-র মতো স্বামীর সঙ্গে সে আর একেবারেই থাকতে চায় না। নিজের জন্য একটি পৃথক ভবন নির্মাণের দাবি জানায় সে। এখানে সখীগণের সঙ্গে সে ‘কৌতুকে’ জীবন যাপন করতে চায়। সর্বোপরি, এবার যদি, চন্দ্রানী এবং বামনের মধ্যে কেউ সম্পর্ক তৈরির ঘটকালি করে, তাহলে চন্দ্রাণী বিষপান করে জীবনত্যাগ করবে। রাজা সবটা শোনেন এবং রাজার অনুমতিতেই চন্দ্রাণীর জন্য পৃথক ভবন গড়ে ওঠে। পরিবারের সঙ্গে চন্দ্রাণীর এই বোঝাপড়ার ইতিহাস অসামান্য। প্রাক-ঔপনিবেশিক যৌনতার সঙ্গে ঔপনিবেশিক যুগের যৌনতার পার্থক্য বলতে গিয়ে আমরা বারবার বলি, প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে- যৌনতার উদযাপন হতো, আর উপনিবেশ কালে ভিক্টোরিয় নৈতিকতার ঠেলায় যৌনতার অবদমন হল।
কিন্তু এমন একটি গোদা বিভাজনের ঠেলায়, মূল প্রশ্নটাই হারিয়ে যায় যে, পরিবর্তনটা ঠিক কোথায় এবং কী ভাবে হল? প্রাক-ঔপনিবেশিক কালে, যৌনতার আলোচনায়, পরিবার বাতিল হয়নি। বাতিল হয়নি যৌনতার সঙ্গে গার্হস্থ্যের পরিক্রমা। বিবাহ করে চন্দ্রাণী যে যৌন সুখ পায় নি, এই কথাটা খুব ভালো ভাবেই সে তার মাতা-পিতার সঙ্গে আলোচনা করতে পারত সেদিন। সমস্ত মাতা-পিতা যে সন্তানের কথা শুনে সন্তানের চাহিদাকেই গুরুত্ব দিতেন এমনটাও নয়। চন্দ্রাণীর বাবা-মা দিয়েছিলেন। অনেক বাবা মা-ই দিতেন না। কিন্তু ঔপনিবেশিক কালে এসে, সন্তানের সঙ্গে পরিবারের যৌন সুখের আলোচনা বাতিল হতে শুরু করল। পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তান কী বিষয়ে আলোচনা করতে পারেন, আর কী নিয়ে কথা বলতে পারেন না তা নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি হচ্ছিল। যৌনতা থেকে পরিবার ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করছিল। সম্পর্ক কাকে বলে, এক জনের সঙ্গে অন্য জনের কেমন সম্পর্ক হবে এই প্রশ্নগুলো নতুন সংজ্ঞা পাচ্ছিল সেদিন।
আজ যখন যৌনতার ভাষা নিয়ে কথা বলছি আমরা, তখন এই প্রশ্নটা করা খুব দরকার যে, চারটে ‘খিস্তি’ আর কয়েকটা উদ্দীপনকারী শব্দের ব্যবহারেই কি যৌনতার স্বাধীনতা প্রকাশিত হতে পারে? নিজের স্বচ্ছন্দের জায়গায়, কিছু সমমনস্ক মানুষকে নিয়ে যৌনবিপ্লবের কথা বললেই কি যৌনতার জয়জয়কার ঘটে যাবে? হয়ত এমন অনেক প্রশ্ন আছে, যা আখেরে ‘প্রশ্ন’ হিসেবে এই ‘প্রগতিশীল’ সমাজের কাছে জিজ্ঞেস করতেই ভয় হয়। যৌনতা খুব বড় মুক্তির কথা শোনাতে পারেনি এখনও। যৌনতার মূল প্রশ্ন থেকে আমরা এখনও অনেক অনেক দূরেই আছি।