বাংলা উচ্চারণের অভিধান থাকা কেন জরুরি?
কীসের উচ্চারণ শিখব ?
ভাষা মানেই উচ্চারণ এমন বলা যায়, তবে কথাটা পুরো সত্য হয় না। কারণ উচ্চারণের সঙ্গে ভাষা বলার সময় আরও কিছু আচরণ থাকে। আমরা হাত নাড়ি, হাতের আঙুল নাড়ি, চোখ ছোটবড় করি, গলা ফুলোই, টেবিলের ওপরে থাপ্পড় মারি, তাতে আমাদের ভাষাচার জীবন্ত হয়। আচ্ছা ঠিক আছে, ভাষা মানে উচ্চারণ ছাড়াও আরও অনেক কিছু, কিন্তু উচ্চারণটা তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, তাই না ? সবাই মুখবন্ধ করে বসে থাকলে ভাষা হবে কী করে? আচ্ছা মুখ না হয় খুললে, উচ্চারণও করলে, কিন্তু উচ্চারণ শিখতে হবে কেন ?
এইটা একটা ভালো প্রশ্ন। এইবার ব্যাপারটা বুঝে নাও। সব ভাষার উচ্চারণ শিখতে হয় না। তুমি জন্মালে, জন্মে বুঝতে পারলে তোমার বাড়িতে লোকে মুখ নেড়ে নেড়ে কী সব আওয়াজ করছে। আর সেই আওয়াজ সবাই করছে, মনে হচ্ছে আওয়াজগুলোই তাদের দিনের এক প্রধান কাজ। তুমি নতুন জন্মেছ, তুমি আওয়াজ করতে পার না। কিন্তু তুমি অবাক হয়ে দেখলে যে, তোমার গলায় কান্না প্রথম প্রথম একটা আওয়াজ চলে আসছে, খিদে পেলে (তুমি জানো না ‘খিদে’ কী তখনও), বিছানা ভিজিয়ে ফেললে (কাজটার নাম তখনও জানো না), ওই আওয়াজটার নামও যে কান্না তা তুমি জানো না। আর তাতেই কাজ হচ্ছে, তোমার নতুন চেনা এক ভদ্রমহিলা শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে ছুটে এসে সব কিছুর উপযুক্ত ব্যবস্থা করছেন। তুমি জান না, কান্নাটা তোমার ভাষার প্রথম ধাপ। এর পরে তুমি গুগুগুগু, বাব্বা, দাদ্দা নানা আওয়াজ শুরু করবে, তার পর আধো আধো কথা, তার পর এক শব্দের বাক্য দু-শব্দের বাক্য বলতে বলতে সাড়ে তিন বছর নাগাদ বক বক করতে শুরু করবে, তোমাকে থামানো মুশকিল হবে। কাজেই তুমি প্রশ্ন করতেই পার,--ভাষা তো শিখেই গেলুম, উচ্চারণ তো করছিই, তা হলে আবার উচ্চারণ শিখতে হবে কেন ?
ঠিক কথা। এ প্রশ্নটার উত্তর হল, তুমি যে ভাষাটা প্রথম শিখলে, তোমার ঘরের ভাষা, সেটা কী দরের ভাষা সেটা বুঝতে হবে। মানুষেরা এক অদ্ভুত জীব, তারা তাদের ভাষার মধ্যে নানা জাতিভেদ তৈরি করেছে। তারা জানে তাদের ভাষার একটা নাম আছে বটে, যেমন বাংলা বা হিন্দি বা ইংরেজি বা জাপানি। কিন্তু ভাষা আসলে একটা নির্ভেজাল জিনিস নয়। তা অনেকগুলো ভাষার একটা গুচ্ছ। তার মধ্যে বেশিরভাগই হল উপভাষা বা ঘরের ভাষা (dialect)। তার এক একটার মধ্যে আবার সামাজিক স্তরভেদ আছে, শিক্ষিতেরা বড়লোকেরা একরকম বলে তো নিরক্ষরেরা আর-একরকম বলে। তাকে বলে শ্রেণিভাষা (sociolect)। কিন্তু সে সবের ওপরে একটা আছে তার নাম মান্য বা প্রমিত ভাষা (standard)। তুমি একটু বড় হয়ে দেখবে যে এই প্রমিত ভাষার প্রচণ্ড প্রতাপ। রেডিয়ো, টেলিভিশন, বক্তৃতায় সবাই প্রমিত ভাষা বলছে, ইশকুলেও তাই। আর খবরের কাগজ, বইপত্রে সব প্রমিত ভাষা লেখা।
তোমার ঘরের ভাষা যদি প্রমিত ভাষার কাছাকাছি হয় তো বেঁচে গেলে, কিন্তু না হলেই ঝামেলা। তোমাকে ওই প্রমিত ভাষা বলতে আর লিখতে শিখতে হবে। আর বলতে শেখা মানেই উচ্চারণ শেখা। ধ্বনির উচ্চারণ, শব্দের উচ্চারণ, এমনকি পুরো বাক্যের উচ্চারণ। তুমি যদি সিলেট অঞ্চলের লোক হও, তোমার মুখে ‘অ্যাবং’ চলে আসবে, সেটা ছেড়ে তোমাকে ‘এবোং’ শিখতে হবে। যদি ময়মনসিংহের লোক হও, তা হলে ‘সুর’ না বলে ‘চোর’ বলা শিখতে হবে। যদি দক্ষিণ ২৪ পরগনার লোক হও তাহলে ‘রইয়েসে’ না বলে ‘রোয়েছে’ বলা শিখতে হবে। যদি ঢাকার লোক হও তা হলে ‘আমি খামু না’, আর চট্টগ্রামের লোক হলে ‘আইঁ ন খাইয়ম’-এর বদলা ‘আমি খাব না’ বলা শিখতে হবে।
শুধু লেখাপড়া শেখার জন্যেই নয়। যা আবৃত্তি করবে বাংলা কবিতা, যে গান গাইবে, নাটক করবে, টেলিভিশনে রেডিয়োতে খবর পড়বে, এমনকি নিজের এলাকার বাইরে চাকরির সাক্ষাৎকারে বসবে তাকে ওই মান্য বা প্রমিত বাংলা শিখতে হবে।
ওই উচ্চারণ শেখার নানা উপায়
অবশ্যই আমাদের লেখাপড়া করতে করতেই প্রমিত বাংলার উচ্চারণ কিছুটা শেখা হয়ে যায়। স্কুলকলেজে ঘরের ভাষা বললে শিক্ষকমশাই/দিদিমণি রাগ করেন, সহপাঠীরা ঠাট্টা করে। লেখাপড়ার বাইরেও টেলিভিশন, সিনেমা, নাটক দেকা, শহরের লোকজনের বক্তৃতা শোনা থেকে মুখের প্রমিত ভাষা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। এ ছাড়াও আবৃত্তির স্কুল, নাটকের দল, গানের ক্লাস—তাতে প্রমিত বাংলার উচ্চারণ শেখার সুযোগ আছে। ঢাকাতে তো দেয়ালে বিজ্ঞাপনই দেখা যায়, ফোন নম্বর দিয়ে, ‘এখানে প্রমিত বাংলার উচ্চারণ শেখানো হয়।’ তা ছাড়াও ইংরেজির ক্ষেত্রে নানা সিডি পাওয়া যায, ইন্টারনেটেও গুগ্লও শব্দের উচ্চারণ শুনিয়ে দেয়। বাংলাতেও এ সব হতে পারে, হয়তো এর মধ্যে হয়েছেও।
সমস্যা হল, আমাদের বাংলা লেখা থেকে শব্দটির উচ্চারণ ধরা খুব কঠিন। লেখাকে আক্ষরিকভাবে উচ্চারণ করলে তা বাংলার মতোই শোনাবে না। তা আরও প্রকট সংস্কৃত থেকে ওই বানানে এসে যাওয়া তৎসম শব্দে, কিন্তু বাংলা ক্রিয়াতেও তা কম ঝামেলার নয়। ‘বক্ষ’ যে বক্ষ নয় ‘বোক্খো’, গদ্যকাব্য যে ‘গদ্ইয় কাব্ইয়’ নয়, ‘গোদ্দোকাব্বো’, আর ‘বলব’ যে ‘বোল্বো’ এ সব বিদেশিরা না বুঝতে পেরে ঘাবড়ে যায়, আমাদের বাঙালিরাও অনেক সময় খেয়াল করে না, যদিও উচ্চারণটা হয়তো তারা মোটামুটি ঠিকই করে। তবে উপভাষার বাঙালিদের তো বেশ সমস্যা হয়, তারা হয়তো ‘কাইব্বো’ বলে ফ্যালেন। ‘গেল’ আর ‘গেছে’-তে যে ‘গ্যা’ আর ‘গেলে’-তে যে ‘গে’ তা বানান দেখে কে বুঝবে ?
তাই উচ্চারণ শেখার সবচেয়ে সহজ উপায় বোধ হয় একটি উচ্চারণ শেখার অভিধান। ইংরেজিতে সেই কবে থেকে চালু হয়েছে সুনীতিকুমারের অধ্যাপক ড্যানিয়েল জোন্সের English Pronouncing Dictionary, আছে আমেরিকান কেনিয়ন আর নট্-এর আমেরিকার ইংরেজি বিষয়ে উচ্চারণ অভিধান। এ ছাড়া সমস্ত বড়ো ইংরেজি অভিধানে সেই কবে থেকে উচ্চারণ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাতেও জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের ‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’এ একভাবে উচ্চারণ দেওয়া ছিল, তাঁর নিজস্ব উদ্ভাবনে। আজকাল ভাষাবিজ্ঞানসম্মত অভিধানে সাধারণত আন্তর্জাতিক ধ্বনিবিজ্ঞানের বর্ণমালা (International Phonetic Alphabet বা IPA)-তে পাশে উচ্চারণ দেয়। আমাদের উপমহাদেশে প্রকাশিত বাংলা উচ্চারণ অভিধানগুলিতে তা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি প্রকাশিত জামিল চৌধুরীর প্রমিত বাংলার উচ্চারণ অভিধান থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রয়াত নরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসও এই নীতিতে একটি উচ্চারণ অভিধান প্রণয়ন করেছিলেন। পরে এই বাংলায় সুভাষ ভট্টাচার্যের ‘সংসদ বাংলা উচ্চারণ অভিধানে’ও তার ব্যবহার করা হয়েছে, কারণ উচ্চারণ নিখুঁতভাবে দেখাতে হলে এই উপায়টি অবশ্যগ্রহণীয়। এই অধমের যে উচ্চারণ অভিধানটি বেরোতে যাচ্ছে পয়লা বোশেখ নাগাদ (‘প্রমিত বাংলা উচ্চারণ অভিধান’), তাতে বাংলাতেই সব উচ্চারণ দেওয়া হয়েছে, দল বা সিলেব্ল ভাগ করে, যেমন প্রোৎ-তুৎ-পন্-নো-মো-তিৎ-তো।
আমরা আশা করি, একদিন কম্পিউটার-হোয়াট্সঅ্যাপেও বাংলা উচ্চারণ পেয়ে যাবেন আপনারা। তদ্দিন ছাপা অভিধানগুলো নিয়েই কোনওরকমে কাজ চালান। নিজের ঘরের ভাষা ছাড়বেন না, কিন্তু প্রমিত বাংলাও আপনার মুখে উজ্জ্বলভাবে জেগে উঠুক।