'ফ্যাসিবাদের লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি, তাই ব্যারিকেড' || কথাবার্তায় দেবেশ চট্টোপাধ্যায়
‘In the dark times will there also be singing? Yes, there will also be singing. About the dark times,’ এমনটাই মনে করতেন বের্টল্ট ব্রেশ্ট । ফ্যাসিবাদ যেমন নিজের দাঁত-নখ সর্বস্ব অস্তিত্ব নিয়ে আক্রমণ শানাবে, তেমন তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে উঠবে। আর এমন সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের কথাই বলেছিলেন বাংলা থিয়েটারের রাজাধিরাজ উৎপল দত্ত। সে ধারা বিক্ষিপ্তভাবে হলেও আজ বজায় রয়েছে বাংলার রঙ্গমঞ্চে। সাম্প্রতিককালে প্রখ্যাত নাট্য-ব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ও ‘চাকদহ নাট্যজনে’র প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয়েছে উৎপল দত্তর নাটক ‘ব্যারিকেড’। উৎপল দত্তর ৯৩ তম জন্মদিনে আমরা কথা বললাম দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
‘ব্যারিকেডে’র প্লট তো জার্মানির নাৎসি শাসনের প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠছে। আপনি কেন এই সময় ভারতের রাজনীতির প্রেক্ষিতে নাটকটাকে ফিরিয়ে আনলেন?
-আসলে এর উত্তরটা প্রশ্নের মধ্যেই আছে। ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে নাটকটা করার কারণ একটাই। নাৎসি শাসনের লক্ষণগুলো আমি এই মুহূর্তে ভারতবর্ষেও খুঁজে পাচ্ছি। শুধুমাত্র ভারতবর্ষ কেন, আমি যে রাজ্যে বেঁচে আছি, সেখানেও দেখতে পাচ্ছি।
এই নাটকটা মঞ্চস্থ করার ক্ষেত্রে আপনি সামগ্রিক ভাবে ঠিক কী ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তা যদি জানান?
আসলে ‘ব্যারিকেড’কে কেন্দ্র করে আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল ২০১৮ সালে। সে বছর আমি ‘বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভালে’ আমার নতুন ছবিটা নিয়ে গেছিলাম। আমাদের ছবিটা যেখানে দেখানো হচ্ছিল, ঠিক তার পাশের বাড়িটাই ছিল গেস্টাপোদের। সেখানে ‘The Topography of Terror’ নামে একটা বড় প্রদর্শনী চলছিল। মানে এটা হচ্ছে যেখানে নাৎসিরা বন্দিদের আটকে রাখত এবং অত্যাচার করত, সেই ঘরগুলোর ঠিক সামনে এবং বার্লিন ওয়ালের পাশে। তখন সেখানে ১৯২৯-৩৩, অর্থাৎ হিটলার যে সময় জার্মানিতে ক্ষমতায় আসছেন, তাকে কেন্দ্র করে একটা বড় প্রদর্শনী এবং তথ্যচিত্র চলছিল। আমি সিনেমা দেখার অবসরে মাঝে-মধ্যেই সেখানে যেতাম। ওটা দেখতে দেখতে আমার হঠাৎ করে মনে হল, হিটলার তো ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আসলে ঘটনাটা কী ঘটেছিল? মানে ধরা যাক ফ্যাসিবাদ যখন বিপুল সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তখন ঠিক কী হয়েছিল? আমার তখন মুহূর্তের মধ্যে ‘ব্যারিকড’ নাটকটার কথা মাথায় এলো। এই একই জিনিস তো সেখানে দেখানো হয়েছে, মানে ঠিক সেই সময়টা, যেটা আমার দেশে এখন আমি দেখতে পাচ্ছি। তখন থেকেই ‘ব্যারিকেডে’র কথা আমার মাথায় ছিল। এরপর ২০১৯ সালে তো পিরানদেল্লো মঞ্চস্থ করলাম, আর তার পরের বছর লকডাউন হয়ে গেল। তারপর ২০২১ এর পর আমার মনে হল, না এবার নাটকটা করেই ফেলি, কারণ যে অনুভবটা আমার জার্মানিতে তৈরি হয়েছিল, সেটার একটা চূড়ান্ত প্রসব মুহূর্ত দরকার। সেই জন্যেই ব্যারিকেডকে বেছে নিয়েছি।
আর সত্যি কথা বলতে, ‘চাকদহ নাট্যজনে’ও কিন্তু নাটকটা আকস্মিকভাবে মঞ্চস্থ হয়েছে। আমি ‘প্লে টু প্রোডাকশন’ নামে ওদের একটা কর্মশালায় গিয়েছিলাম। চারদিন ধরে সেটা চলার পর আমার একটা কথা মনে হল। আসলে, যারা এই ‘ব্যারিকেডে’র কথাগুলো উচ্চারণ করবে, তাঁরা যদি ইতিহাস না জানে এবং কথাগুলো বিশ্বাস করে না বলে, তাহলে এগুলো করার কোনও মানেই দাঁড়ায় না। সেখানে অনেক বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছিল, তাদের নিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, হিটলার কে, ফ্যাসিবাদ কাকে বলে, এই আলোচনাগুলো আরম্ভ করলাম। মানে ধরা যাক আমি আজকে যদি মোদীকে ফ্যাসিস্ট বলি, তাহলে প্রথমেই প্রশ্ন উঠবে, ‘তুমি কেন ফ্যাসিস্ট বলছ ওঁকে?’ প্রথমে ধারণাগুলো স্পষ্ট হওয়াটা দরকার। ফলত, সব মিলিয়ে একটা লেকচার ডেমনস্ট্রেশনের মতো করে ওদেরকে বিষয়গুলো বোঝালাম। এটা হচ্ছে নাটকটা মঞ্চস্থ করার আগে আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। তখন আমি লক্ষ করলাম যে ছেলে-মেয়েরা আগ্রহ দেখাচ্ছে, এবং ভারতবর্ষের সঙ্গে লক্ষণগুলো মেলাতে পারছে। তারপর আমি টেক্সটটা আবার ওদেরকে পড়াই, আমাদের পুরনো গণনাট্যের গান শোনাই।
আসলে আমাকে কয়েকটা বিষয় ভাবাচ্ছিল। ‘কম্যুনিজম’ কাকে বলে? ‘কালচারাল কম্যুনিজম’ এবং ‘পাওয়ার কমুনিজমে’র দ্বন্দটা কোথায়? উৎপল দত্ত কেন হেমন্ত বসুর হত্যাকাণ্ডের সময় ব্যারিকেড নাটকটাকে বেছে নিচ্ছেন? আর এখনই বা আমরা কেন বেছে নেব নাটকটাকে, এগুলো ভাবতে হবে। সে সময় ফ্যাসিবাদের যে চেহারা উৎপল দত্ত দেখেছিলেন সেটা এ সময় সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু কথাগুলো কোথাও গিয়ে সার্বজনীন থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ফ্যাসিবাদের কোনও দল হয় না। বিভিন্ন সময় কিছু দলের নাম করে ফ্যাসিবাদের একেকটা মুখ তৈরি হয় এবং এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকে সাধারণ মানুষ, তাদের প্রতিরোধ নিয়ে। এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আমরা ‘ব্যারিকেড’ মঞ্চস্থ করার পথে হাঁটলাম। এবং খুবই কম পয়সায় প্রযোজনাটা নেমেছে। মানে, আমরা কোনও নতুন আলো বা সেট ব্যবহার করিনি। ‘চাকদহ নাট্যজনে’র কাছে যা ছিল, তা দিয়েই কাজ হয়েছে।
প্রতিরোধের থিয়েটার বলতে আমরা যা বুঝি, বর্তমান ভারতবর্ষে সেই ধারাটা ঠিক কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে? কারণ থিয়েটার অর্থনৈতিকভাবে চলচ্চিত্রের থেকে অনেক বেশি উপেক্ষিত। এবং বহু কলা-কুশলীকেই নিয়মিত পারিশ্রমিক দেওয়ার মতো অবস্থা দলগুলোর নেই।
একদম ঠিক বলেছেন। আসলে প্রতিরোধের থিয়েটার বিষয়টা দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাসের উপর। মানে একটা আর্ট ফর্মে এসে সেখান থেকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠা পাওয়া, এই ছকটার বাইরে গিয়ে যদি আদর্শের কথা সবাই বলতে চায় একসঙ্গে, তাহলেই প্রতিরোধের থিয়েটার হয়। নইলে হয় না। মানে সে ক্ষেত্রে হয়ত সেটা শুধুমাত্র স্কিল শেখার জায়গায় পরিণত হয়। বিভিন্ন মানুষ সেখানে আসে এবং স্কিলটা শিখে নিয়ে ফিল্ম বা সিরিয়ালে চলে যায়। আমার মনে হয় সময়টা কিন্তু আস্তে আস্তে ঘুরছে। আমার নিজেরই থিয়েটারে প্রায় ৩৮ বছর হয়ে গেল। ইদানিং আমি দেখছি প্রচুর নতুন ছেলে-মেয়ে আসছে যারা থিয়েটারকে একটা কথা বলার জায়গা হিসেবে রাখতে চাইছে। সেই জায়গাটা আবার তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে কমার্শিয়াল থিয়েটার বিষয়টা উঠে গেছে, সেহেতু এখন গ্রুপ থিয়েটারের একটা বাণিজ্যিক অভিমুখ তৈরি হচ্ছে।
তাহলে প্রতিরোধের থিয়েটারের ক্ষেত্রে কি আমাদের বাণিজ্যিক কাঠামোটা কিছুটা আয়ত্ত করা প্রয়োজন? উৎপল দত্ত নিজেই সম্ভবত একটা সাক্ষাৎকারে এটা বলছেন।
অবশ্যই, উৎপল দত্তর এই কথাটা খুব জরুরি বলে আমার মনে হয়। আমাকে থিয়েটারকে একটা পপুলার স্পেসে নিয়ে গিয়েই লোকজনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। মানে, এখান থেকে একটা স্থায়িত্ব তৈরি করতে হবে আর কী। ফলত এই পপুলার স্পেসের মধ্যে দিয়ে দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করার যে জায়গাটা, সেটা নিয়ে উৎপল দত্ত যা বলেছিলেন সেটা এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
আমার শেষ প্রশ্ন, কোভিডের কারণে বেশ কিছু সংস্থা উৎপল দত্তর কয়েকটা নাটককে ডিজিটাইজ করার ব্যবস্থা করছে। অর্থাৎ নাটক মঞ্চ থেকে উঠে আসছে মোবাইল স্ক্রিনে। আমরা আগাগোড়া থিয়েটারকে জেনে এসেছি একটা গণ মাধ্যম হিসেবে। এখন ডিজিটাইজেশনের ফলে মানুষ ঘরে বসেই তাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে। এর ফলে কি থিয়েটারের যে রাজনৈতিক বক্তব্য তা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা যেতে পারে?
হ্যাঁ পরিবর্তন অবশ্যই দেখা যাবে। আসলে এটা কে দেখতে হবে থিয়েটারের এক ধরনের ডকুমেন্টেশন হিসেবে। এটা কখনোই থিয়েটার নয়। কারণ থিয়েটার ডিজিটাইজড হওয়ার পর তা আর কখনোই থিয়েটার থাকে না। এটা তখন একটা অন্য মাধ্যমে চলে যায়। এই ডিজিটাইজড মাধ্যমটাকে আমরা পারফরমেন্সকে একটা ডকুমেন্টেশন হিসেবে দেখতে পারি। এর বেশি কিছু নয়। দর্শকাসনে আর পাঁচজনের সঙ্গে বসে একটা নাটক দেখতে দেখতে যে অনুভূতি আমার হবে, সেটা কোনো দিন একটা ডিজিটাল মাধ্যমে সম্ভব নয়।