মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে আগ্রহী? জানুন এ বছর কোথায় বিনিয়োগ করলে সর্বাধিক লাভ
২০২১ কে পিছনে ফেলে হাজির ২০২২। নতুন বছর নতুন করে শুরু করতে চাইছেন সকলেই। অনেকেই এই বছর নিজেদের জন্য নানা রকম ভাবনাচিন্তা করে রেখেছেন, তৈরি করে ফেলেছেন নিজেদের রেজোলিউশন। কিন্তু এসব সাত সতেরোর মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হল ফিনান্স প্ল্যানিং বা আর্থিক পরিকল্পনা। ২০২১ সালটা অনেকরই আর্থিক দিক থেকে কিছুটা মন্দায় কেটেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে ব্যবসায় ভাঁটা দেখা দিয়েছে বহু ক্ষেত্রেই। লকডাউনের সৌজন্য়ে সেই ক্ষতির খতিয়ান আকাশছোঁয়া হয়েছে।
কিন্তু এই অসুখী সময়েও ভালো ভাবে কাজ করেছে মিউচুয়াল ফান্ড। আপনারা যারা মিউচুয়াল ফান্ড বিষয়ে অবগত, যারা ভাবছেন এ বছরের জন্য মিউচুয়াল ফান্ডে কী কৌশল অবলম্বন করবেন আমাদের আলোচনা তাদের জন্যই। ২০২১ সালে যারা ইকুইটি মিউচ্যুয়াল ফান্ডে বেশি বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে বছরটা অনেকটাই ভালো ছিল। সাধারণ এসআইপি কৌশল ব্যবহার করে একটা বড় অঙ্কের অর্থ যারা এই ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা বেশ ভালো পরিমাণ লাভের মুখ দেখতে পেরেছিলেন। যারা ভারতের ইকুইটির উপরে বেশি বিনিয়োগ করে থাকেন তারা অনেকটাই বেশি লাভ পেয়েছেন, কারণ এই বছরে ভারতীয় ইকুইটি বিশ্বের অন্যান্য প্রথম সারির বেশ কিছু মার্কেটকে ছাপিয়ে উপরে উঠে এসেছিল। মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২০২১ ভালো একটি বছর হলেও ২০২২ যে একই রকম যাবে তা আগে থেকে বলা যায় না।
অনেকের মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগে গোড়াতেই ভুল করে বসেন। যেমন ধরুন যারা মিউচুয়াল ফান্ডের মার্কেটে নতুন যোগদান করেছেন তারা অনেকেই ২০২২-এর জন্য অত্যন্ত আক্রমণাত্মক কৌশল নিয়ে শুরু করতে চাইছেন। কিন্তু সব বছরে এই রকম আক্রমণাত্মক কৌশল কাজ করে না। মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞরা বারংবার বলছেন, অনেক মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগকারী, বিশেষত যারা নতুন, তারা ২০২১ এর মিউচুয়াল ফান্ড মার্কেটের সবথেকে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপরেই ২০২২-এ বেশি ভরসা করছেন। ক্ষুদ্র শিল্প বিনিয়োগ এবং টেকনোলজি সেক্টরের বেশ কিছু ব্যবসার উপরে মিউচুয়াল ফান্ড গ্রাহকদের লক্ষ্য বেশি রয়েছে ২০২২ সালে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব সময় সব কৌশল কাজ করে না ঠিকভাবে। তাই ২০২১-এ ভালো করেছে মানেই ২০২২-এও ভালো করবে এরকম ভেবে বিনিয়োগ করা উচিত না। তাহলে, ২০২২ এ কোথায় কোথায় কী ভাবে বিনিয়োগ করবেন? চলুন দেখে নেওয়া যাক এই ২০২২-এ কোন জায়গায় কী ভাবে বিনিয়োগ করলে এবং কোন কৌশল অবলম্বন করলে আপনার লাভ হবে সর্বাধিক।
১. গত বছরে ভালো করেছে মানেই এই বছরেও ভালো করবে; এমনটা নয় -
গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ভারতের ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড বাজারে দুর্দান্তভাবে সাফল্য এনে দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের। ভারতীয় ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের এই সাফল্য দেখে অনেকেই মনে করতে পারেন, ২০২২ এও এই মিউচুয়াল ফান্ড একইরকম ভাবে দুর্ধর্ষ সাফল্য এনে দেবে বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড যে সব সময়ে ভালো কাজ করবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। তাই যদি আপনি ওই একই ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করতে চান, তাহলে আপনাকে আগে ভাবনা চিন্তা করতে হবে। ট্র্যাক রেকর্ড বলে, পরপর দুই বছর একরকম ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড একই রকম সাফল্য আনবে এরকমটা হয় না। তাই, ২০২২ এ অন্য কোন মিউচুয়াল ফান্ড এর উপরে বিনিয়োগ করতে পারেন। আর যদি আপনি ভারতীয় ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের উপরে ভরসা করেন, তাহলে খুব একটা বেশি আশা রাখবেন না।
২. শুধুই ভারতের ইকুইটিতে বিনিয়োগ করবেন না -
২০২১ সালে ভারতের ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড এর উপরে যারা বিনিয়োগ করতেন তাদের জন্য বছরটা বেশ ভালো গিয়েছিল। ভারতের মিউচুয়াল ফান্ড মার্কেটের জন্য ২০২১ বছরটা খুবই ভালো কেটেছে। বিশ্বের সবথেকে ভালো কিছু মার্কেটের মধ্যে একটি হিসেবে উঠে এসেছে ভারত। কিন্তু এই পরিসংখ্যান দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। এর আগেও এরকম ভাবেই বিশ্বের মিউচুয়াল ফান্ড মার্কেটের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছিল ভারত, কিন্তু পরবর্তীতে ভারত ক্রমতালিকায় অনেকটা নীচেও নেমে যায়।
আরও পড়ুন-সবার মাঝে, সভার মাঝে, তবু একাকিত্বে ভুগছেন? কারণটা ‘আদিম’
আর শুধু ভারত কেন, পরিসংখ্যান এটাও বলে, প্রত্যেক বছর মিউচুয়াল ফান্ড মার্কেটে বিজেতা বদলাতে থাকে। তাই শুধুমাত্র ভারতের উপরে বিনিয়োগ না করে বিশ্বের অন্যান্য মার্কেটে বিনিয়োগ করুন। বিশ্বের বিভিন্ন রকম মার্কেটে যদি আপনি বিনিয়োগ করেন, তাহলে আপনার মিউচুয়াল ফান্ড পোর্টফলিওর অনেকটাই মানোন্নয়ন হবে। ভারতীয় ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে কিছুটা বিনিয়োগ করার পরে বিশ্বের প্রথম সারির কিছু উন্নত মার্কেটে বিনিয়োগ করুন। আর বাকি বিনিয়োগটা তুলে রাখুন উদীয়মান কিছু মার্কেট ফান্ডের উপরে। এরকমটা করতে পারলে আপনার পোর্টফোলিও যেমন অনেকটা শক্তিশালী হবে, তেমনি আপনার লাভের অঙ্কটাও অনেকটাই বাড়বে।
৩. খুব বেশি উচ্চ রিটার্নের ফান্ডে বিনিয়োগ না করাই ভালো -
ডেট ফান্ড বা ঋণ তহবিলের মত মিউচুয়াল ফান্ড এর ক্ষেত্রে রিটার্ন সাধারণত কিছুটা কম থাকে। তাই অনেকেই যারা ডেট ফান্ডে বিনিয়োগ করে থাকেন তারা উচ্চ রিটার্নের ডেট ফান্ডের উপরে বিনিয়োগ করতে চান। কিন্তু, ২০২০ এর পরিসংখ্যান দেখে এটা অবশ্যই বলা যায়, অত্যন্ত বেশি রিটার্ন বিশিষ্ট ডেট ফান্ড অনেক ক্ষেত্রে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ওই বছর অত্যন্ত উচ্চ রিটার্ন বিশিষ্ট কম রেটিংয়ের বন্ড প্রচন্ড সমস্যার মুখোমুখি হয়ে গিয়েছিল। রিটার্ন বেশি থাকার কারণে, যারা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের অনেকের টাকা পর্যন্ত আটকে গিয়েছিল। তাই আপনি যদি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে একটি স্থায়ী আয় করতে চান, এবং রিটার্ন কম হলে আপনার যদি তেমন অসুবিধা না হয়, তাহলে আপনি উচ্চ রিটার্নের ডেট ফান্ড থেকে দূরে থাকুন। অথবা খুব কম পরিমাণ অংশ এই জায়গায় বিনিয়োগ করুন, বাকিটা ঝুঁকিবিহীন কোন একটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন।
৪. সোনার মিউচুয়াল ফান্ডের উপর ভরসা রাখুন -
গতবছরের খারাপ পারফর্মেন্স থাকার কারণে ২০২২ এ অনেকেই সোনার মিউচুয়াল ফান্ড এর উপর ভরসা হারাচ্ছেন। আসলে সোনার মিউচুয়াল ফান্ড কখনোই ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড এর সঙ্গে মানানসই ভাবে কাজ করে না। এই কারণে দেখা যায়, বেশ কিছু জায়গায় যেখানে ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড ভালো কাজ করছে, সেখানে সোনার মিউচুয়াল ফান্ড ভালো কাজ করতে পারে না। কিন্তু ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ খুব বেশি হয়ে যায়। তাই যদি আপনি সোনার মিউচুয়াল ফান্ডের উপরে বিনিয়োগ করেন, তাহলে আপনার লাভের অঙ্ক কিছুটা কমলেও, আপনি ইকুইটির ঝুঁকি থেকে অনেকটা সুরক্ষিত থাকবেন, যা দীর্ঘমেয়াদী ক্ষেত্রে আপনার জন্য ভালো প্রমাণিত হতে পারে।
৫. ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন ভেবেচিন্তে -
এর আগেও বহুবার সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড যখন খুব তাড়াতাড়ি কারেকশন শুরু করে, সেই সময়, নিজের প্রাথমিক মূল্যে পৌঁছতে এবং সেখান থেকে আবারও রিটার্ন দেওয়া শুরু করতে ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের একটু সময় লাগে। অনেক সময় এই সময়ের তফাতটা কয়েক বছর হয়ে যায়। অনেকেই আছেন যারা এই কারেকশনের সময়ে ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে ফেলেন, উচ্চ রিটার্নের আশা রেখে। কিন্তু, এই মিউচুয়াল ফান্ডের কারেকশনের সময়সীমা যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে তাদের বিনিয়োগ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যাবে, কারণ সেখান থেকে রিটার্ন মেলা তো দূর অস্ত, আপনার বিনিয়োগ কার্যত জলে গেল বললেই চলে।
এই সময় যদি আপনি বিনিয়োগ করেন তাহলে আপনার বিনিয়োগের সময়সীমা অন্ততপক্ষে ৭ থেকে ১০ বছর হতেই হবে। এই সময়টায় ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড ধীরে ধীরে নিজের পুরনো জায়গায় ফিরে আসে, এবং তারপর আস্তে আস্তে আপনাকে রিটার্ন দেওয়া শুরু করে। কারেকশনের সময় যদি আপনি মিউচুয়াল ফান্ড কেনেন, তাহলে আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে, তাড়াহুড়ো করে কারেকশনের সময়ে মিউচুয়াল ফান্ড কিনবেন না।
৬. নিজের পোর্টফলিওর মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে আসুন -
অনেকে আছেন যারা মিউচুয়াল ফান্ডের মার্কেটে প্রবেশ করে উচ্চ রিটার্নের আশায় প্রথমেই বড় কিছু ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করে ফেলেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আপনার ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নতুন বছরে নিজের পোর্টফলিও এর মধ্যে একটু ভারসাম্য নিয়ে আসুন। ভালো করে চিন্তা করে তবে ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন। কিছু টাকা ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড থেকে সরিয়ে এনে কিছু ডেট ফান্ড এবং সোনার মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করুন। এর ফলে আপনার আয়ের পরিমাণ কিছুটা কম হলেও আপনার ঝুঁকি বেশ অনেকটাই কমে যাবে। অত্যন্ত উচ্চমূল্যের অ্যাসেটের পাশাপাশি সাধারণ মূল্যের কিছু অ্যাসেট রাখুন, পোর্টফোলিও ভালো হলে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনার সুবিধা হবে পরবর্তীতে।
৭. প্যাসিভ ফান্ড এবং ইটিএফ-র উপরে বিনিয়োগ করতে পারেন -
নিজের পোর্টফলিওর খরচ কিছুটা কমানোর জন্য কিছু ইনডেক্স ফান্ড এবং স্মার্ট বিটা ফান্ডের উপরে আপনি বিনিয়োগ করতে পারেন। এই ধরনের বিনিয়োগ এর ফলে আপনার বরাদ্দ ক্রমবর্ধমান হতে থাকবে, এবং রিটার্ন এর পরিমাণও মোটামুটি ঠিকঠাক থাকবে।