মমতা-বর্জিত একনায়কতন্ত্রের চেষ্টা আদৌ সফল হবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের?

Abhishek Banerjee - Mamata Banerjee : কয়েকজনকে বলির পাঁঠা করে এক নতুন পণ্য বাজারে এনে তাকে বেচার এক আপ্রাণ চেষ্টা বাংলা দেখছে।

গত কয়েকদিন ধরে বাংলা ও মহারাষ্ট্রে দু'টি ঘটনা সমান্তরালভাবে ঘটে চলেছে। বাংলার পথে যখন তৃণমূলের যুবরাজ জনজোয়ার ডেকে আনছেন এবং তাঁর পিসি যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছেন, ঠিক একই সময়ে মহারাষ্ট্রে ভাইপোকে এড়িয়ে মেয়ের হাতে দলের ব্যাটনটি তুলে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারছেন না রাষ্ট্রবাদী কংগ্রেস পার্টির সম্রাট। কয়েকদিনের বিস্তর নাটকের যদিও পরিসমাপ্তি হয়েছে মহারাষ্ট্রে। দলের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েও তা ফিরিয়ে নিয়েছেন এনসিপি বা রাষ্ট্রবাদী কংগ্রেস পার্টির নেতা শরদ পাওয়ার। তবে সেই সাংবাদিক বৈঠকে নিজের দিকেই যেন একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন- দলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের রূপরেখা তৈরির কাজটি তাড়াতাড়ি করতে হবে বলে।

প্রায় একই সময়ে ভিন্ন ইস্যুতে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে দুই কংগ্রেস নেতা শরদ পাওয়ার ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেদের আঞ্চলিক দল তৈরি করেছিলেন (এই দু'জনই পেরেছেন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করতে)। মমতা ১৯৯৮ আর পাওয়ার ১৯৯৯। দুই দশক পরে মমতা 'পরবর্তী প্রজন্মের' হাতে দলের ব্যাটনটি তুলে দিয়েছেন ইতিমধ্যেই। কারও মনে কোনও দ্বিধা নেই যে মমতার পরে কে হবেন তৃণমূলের কাণ্ডারি।

কিন্তু বৃদ্ধ শরদ পাওয়ার এখনও পরিষ্কার করে দিতে পারেননি তিনি ভাইপো অজিত না মেয়ে সুপ্রিয়াকে তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে দলের ভার দিয়ে যাবেন। যৌথ দায়িত্বের কথা উঠে আসছে বটে, কিন্তু পরিবারকেন্দ্রিক দলে এসব চলে না।

সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিংহ যাদব হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন এ কথা। পরিবারের মধ্যে দলের রাশ নিয়ে মুলায়ম-পুত্র অখিলেশ ও ভাই রামগোপাল যাদবের মধ্যে যে প্রকাশ্য কোন্দল হয়েছিল, তা কোনও রকমে নিজের রাজনৈতিক কূটচালে সামাল দিয়েছিলেন মুলায়ম। অখিলেশকেই একচ্ছত্র অধিপতি করে গিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলের বার্তা: সংখ্যালঘুরা শুধু ভোটব্যাঙ্ক নন

জয়ললিতা পারেননি। তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও এআইডিএমকের প্রধান জয়ললিতা তাঁর মৃত্যুর আগে দলের দায়িত্ব পরিষ্কার করে কারও হাতে তুলে দিয়ে যাননি। তাই তাঁর বিশ্বস্ত সহচরী ভি কে শশীকলা হিমশিম খেয়েছেন দলের উপর তাঁর কর্তৃত্ব ধরে রাখতে গিয়ে। পালানিস্বামী মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন না পনিরসেলভম আবার মুখ্যমন্ত্রী হবেন এই চক্করে দলই দু' টুকরো হয়েছে।

পরিবারকেন্দ্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক দলে এই রকম বিবাদের অজস্র উদাহরণ রয়েছে। তা সে লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল হোক বা তেলেগু দেশম পার্টিই হোক।

এ সব ভুল মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায় করেননি। তিনি ধীরে ধীরে তাঁর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে দলের নেতৃত্বে তুলে এনেছেন। তৃণমূল যুবার সভাপতি থেকে দলের যুব সংগঠনের সভাপতি। তারপর ডায়মণ্ড হারবারের নির্বাচিত লোকসভার সাংসদ। তারপর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক। এখন তিনি নবজোয়ারে ভেসে বেড়াচ্ছেন কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ। চলছে তাঁর ব্র্যান্ডিং।

শরদ পাওয়ার হোক বা মুলায়ম- দলের মধ্যে তাঁদের পছন্দের উত্তরসূরির জন্য পথের অনেক কাঁটা ছড়ানো আছে বা ছিল। মমতা ও অভিষেক সে সব কাঁটাও উপড়ে ফেলেছেন সযত্নে। মুকুল রায় থেকে যে কাঁটা তোলার পালা শুরু তা পার্থ হয়ে ববিতে এসে আটকে রয়েছে। সেটা আর বড় বিষয় নয় এখন। সে কাঁটা তোলা শুধু সময়ের অপেক্ষা। কল্যাণ যদিও বা ট্যাঁ-ফোঁ করেছিলেন কিছুদিন। এখন তিনি চুপ। বক্সী তো অভিষেক দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক হওয়ার দিনই চোখের জলে ভেসে গিয়ে আলিঙ্গন করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি মমতার ভাইপোকে সব উজাড় করে দিয়ে দেবেন তাঁর সব রাজনৈতিক সম্পদ। বাকিরা চুপ করে গেছেন বা ক্যামাক স্ট্রিটে পুজো চড়িয়েছেন। বুকে পাথর রেখে মমতা তাঁর পুরনো দিনের সঙ্গীদের কাছ ছাড়া করেছেন। পথ প্রশস্ত করেছেন অভিষেকের। যিনি মমতার মতো দিলখোলা রাজনীতি করেন না। সবার হিসেব সবাইকে বুঝিয়ে দেন।

তবে এতদিনে অভিষেক বুঝে গেছেন যে, তিনি উদ্ধব ঠাকরে হলে চলবে না। শিবসেনার বাল ঠাকরের ছেলে উদ্ধবও খুড়তুতো ভাই রাজের মাথার উপর দিয়ে গিয়ে দলের সিংহাসনে বসেছিলেন। কোনও রকম রাজনৈতিক সংগ্রাম ও দক্ষতা ছাড়াই, বাবার কল্যাণে। পরে তিনি মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছিলেন। কিন্তু না তো মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি না দলের রাশ- কোনওটাই তিনি শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। নিজের রাজনৈতিক কৌশলের ও দক্ষতার অভাবেই তা পারেননি।

কিন্তু অভিষেক নিজেকে পাল্টে ফেলেছেন দ্রুত। সোনার চামচ নিয়ে জন্মালেও এবং পিসির কল্যাণে দলের শীর্ষস্তরে আসীন হলেও নিজের ভুলগুলি তিনি শুধরে নিতে চেয়েছেন। ২০১৯-এর পর প্রশান্ত কিশোরের সৌজন্যেই তিনি কৌশল বদলেছেন। ধীরে ধীরে পথে নেমেছেন, বুঝেছেন দলকে ও পিসির প্রশ্রয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। সমান্তরাল সংগঠন তৈরি করেছেন। দলকে কর্পোরেট কায়দায় চালানোর চেষ্টা করছেন। যে দল মমতা-আবেগে তৈরি ও বহু গোষ্ঠীতে বিভক্ত, তাকে মমতা-বর্জিত এক নায়কের ছাতার তলায় আনার চেষ্টা কষ্টকর। তবে অভিষেক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জানেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবর্তমানে দল ভাঙবেই। অনেক নেতা চলে যাবেন অন্য দলে। কিন্তু কেউ তাঁকে যেন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে না পারেন। এ লড়াই তাঁর বাঁচার লড়াই।

আরও পড়ুন- ইদ সবার উৎসব হোক, কেন চান না রাজনীতিবিদরাই?

এখন দল সরকারে আছে এবং পুলিশ-প্রশাসন দলের সঙ্গে আছে বলেই এই লড়াই সহজতর হচ্ছে অভিষেকের পক্ষে। দল সরকারে না থাকলে পরিস্থিতি কিন্তু বদলে যাবেই। জনজোয়ারে কত জন থাকবে তা সময়ই বলবে।

তবে রাহুল গান্ধির ভারত-জোড়োর কায়দায় বাংলা চষে ফেলার কর্মসূচিতে তিনি শুধু নিজের ব্র্যান্ডিং ও রাজনৈতিক জল মাপার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেই পারতেন। ওই জনগণের ইচ্ছায় প্রার্থী বাছাইয়ের বুজরুকি না করলেই হতো।

পঞ্চায়েতি রাজের মূল অর্থ যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং এখনও ভারতের অনেক জায়গায় দলহীন গ্রাম পঞ্চায়েতের নজির রয়েছে তা নিশ্চয়ই অভিষেকের অজানা নয়। সুতরাং "তৃণমূল-বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস নয়, দলের পতাকা না দেখে আপনি যাঁকে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান তাঁর নাম বলুন, আমরা তাঁকে প্রার্থী করব"- এসব না বলে গ্রামের লোকের উপরই ছেড়ে দেওয়া যেত যে আপনি পছন্দ করে নির্বাচন করে নিন আপনার প্রার্থী। সরাসরি। দলের প্রতীকে ভোট হোক শুধু জেলা পরিষদে। অতটা বুকের ধক নবীন রাজনীতিকের হয়নি বোধহয়।

প্রশাসনিক বৈঠক হোক বা সরকারি কার্যপদ্ধতি- সবেতেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে আমলাদের সামনে ছোট করার যে রীতি তৃণমূল সরকার চালু করেছে, তাতে অন্যান্য প্রশাসনিক স্তম্ভের সঙ্গে পঞ্চায়েতি রাজের মূল যে বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা তা ধাক্কা খেয়েছে। সঙ্গে সর্বস্তরে ও পঞ্চায়েত স্তরের দুর্নীতি তো রয়েছেই।

তৃণমূলের নবজোয়ার তাই কোনও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য নয়। একদিকে এটি যেমন পরিবারবাদকে শক্ত করার প্রক্রিয়া, অন্যদিকে এটি দলীয় গণতন্ত্রকে (পরিবার বা একনায়কতান্ত্রিক দলে অবশ্য এ শব্দ ব্রাত্য) বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জল মেপে নেওয়ার প্রক্রিয়া। একজন ব্যক্তির বিপণনের প্রক্রিয়া।

যখন দল দুর্নীতির অভিযোগে ধরাশায়ী, তখন কয়েকজনকে বলির পাঁঠা করে এক নতুন পণ্য বাজারে এনে তাকে বেচার এক আপ্রাণ চেষ্টা বাংলা দেখছে। যদি এই নবজোয়ারে পুরনো কালি ধুয়ে মুছে যায়। তাহলে দলও থাকল। সরকারি ক্ষমতাও হাতে থাকল।

More Articles