সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি...
Oppenheimer Review: ওপেনহাইমার যদি নিজেকে ‘ডেথ’ বলে দাবি করেন, তাহলে রাষ্ট্র সেই মৃত্যুর ব্যবসায়ী। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য, শব্দ, সংলাপ, চরিত্র রাষ্ট্রের সন্দেহজনক ছবিকে বাস্তব করে তোলে।
ঠিক তিরিশ-চল্লিশ সেকেন্ড আগে প্রথমবার পরমাণু বোমা পরীক্ষা করা হয়েছে। অন্ধকার রাতকে আলোয় ভরিয়ে লক্ষ সূর্যের মশাল যেন আকাশে জ্বলে উঠল।
And Now I Become Death
The Destroyer of Worlds
আমেরিকার পরমাণু বোমা প্রজেক্টের প্রধান বিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহাইমার উচ্চারণ করে উঠলেন গীতার মহামন্ত্র। ওই চল্লিশ সেকেন্ডের প্রতিটি মাইক্রো সেকেন্ডে নির্ধারিত হয়ে চলছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। তারপরই প্রচণ্ড শব্দে ভয়ানক বিস্ফোরণ। কেঁপে উঠল সিনেমা হলের প্রতিটি চেয়ার, প্রতিটি দর্শকের বুকের ভিতরে গিয়ে আছড়ে পড়ল পরমাণু বোমার আতঙ্ক।
আরও পড়ুন: ওপেনহাইমারকে ‘গোপন চিঠি’ পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু! কী ছিল ওই চিঠিতে?
ব্যাস, এইটুকুই! ক্রিস্টোফার নোলানের বহু প্রতীক্ষিত সিনেমা 'ওপেনহাইমার’-এ পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের ঘটনাটা এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ফুরিয়ে যায়। এমনকী জাপানের হিরোশিমা, নাগাসাকির পরমাণু বিস্ফোরণ ও লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর খবরও জানিয়ে দেওয়া হল সংলাপের মাধ্যমেই। কিন্তু ১৯৪৫-র জুলাই মাসে লস আলামোস অঞ্চলের বোমা পরীক্ষার যজ্ঞ থেকে যে বিষ উঠে এসেছিল, তার প্রভাব জড়িয়ে থাকল সিনেমার পরতে পরতে। আসলে ‘ওপেনহাইমার’ শুধুমাত্র পরমাণু বোমা বানানো বা তার বিস্ফোরণের গল্প নয়। কাই বার্ড ও মার্টিন. জে. শেরউইনের লেখা বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের জীবনী ‘আমেরিকান প্রমিথিউস’-এর উপরে ভিত্তি করে তৈরি করা এই সিনেমা আদতে সময়ের বিশ্বস্ত দলিল। যেখানে ওপেনহাইমারের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে বলা হয়েছে পরমাণু বোমাকে ঘিরে তৈরি হওয়া এক বিশ্বজোড়া রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের গল্প। একই সঙ্গে নোলান লিখে দেন বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে হিটলারের নাৎসি জার্মানি। ভীত, সন্ত্রস্ত্র আমেরিকা হাত দিল পরমাণু বোমা তৈরিতে। শুরু হল ‘ম্যানহাটন প্রজেক্ট’। সেই প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হল ওপেনহাইমারকে। স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রকল্প ঘিরে ছিল প্রবল গোপনীয়তা। শত শত বৈজ্ঞানিকের দিনরাতের প্রচেষ্টায় শেষমেশ সফল হল বোমা বানানো। ১৯৪৫-র জুলাইয়ে ওই পরীক্ষা সফল হওয়ার পর অগস্টেই জাপানের উপরে বোমা ফেলল আমেরিকা। এরই মধ্যে শেষ হল রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে শান্তি ফিরল না। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শুরু হল আমেরিকা-রাশিয়ার ঠাণ্ডা যুদ্ধ। এরই মধ্যে কীভাবে যেন রাশিয়ায় পাচার হয়ে গেল পরমাণু বোমার সূত্র। আর এই গোটা ব্যপারটার সন্দেহ গিয়ে পড়ল ওপেনহাইমারের (কিলিয়ান মারফি) উপরে। আর তার কারণ বোধহয় ওপেনহাইমারের অতীত। তাঁর ভাইয়ের পরিবার থেকে শুরু করে প্রাক্তন প্রেমিকা জিন ট্যাটলক (ফ্লোরেন্স পিউ), এমনকী ওপেনহাইমারের সহকর্মীদের অনেকেই ছিলেন কমিউনিস্ট। তিনি নিজেও ছিলেন লিবেরাল মতবাদে বিশ্বাসী । আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ম্যাকার্থির আমলে কমিউনিস্টদের উপর যে ‘Witch Hunt’ শুরু হয়েছিল, তার ইতিহাস ছবিতে ধরা পড়ল স্পষ্ট। এরই মধ্যে ছবিতে আগমন আমেরিকার অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের প্রধান লিউইস স্ট্রসের (রবার্ট ডাউনি জুনিয়র)।
ক্রিস্টোফার নোলান ইতিহাসের দীর্ঘ গল্পকে সিনেমায় তিনটি স্তরে জড়িয়ে দেন। একটা গল্প সাদা-কালো স্ক্রিনে লিউইস স্ট্রসের বিচার, দ্বিতীয় গল্প পরমাণু বোমার সূত্র গোপনে রাশিয়া পাচারের অভিযোগে ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধে গোপন তদন্ত এবং সেই সূত্র ধরেই উঠে আসে তাঁর অতীত জীবন ও পরমাণু বোমা তৈরির গল্প, যা ছবির তৃতীয় অধ্যায়। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, তার রাজনৈতিক আদর্শ, সাধনা (এক্ষেত্রে বিজ্ঞান) এবং সেই ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রের স্বার্থের মাথাব্যথা হয়ে ওঠে, এই তিনটি গল্পকে একে-অপরের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে জুড়ে দেন নোলান। সিনেমার প্রতিটা অংশে তিনি বিচ্ছিন্নভাবে অসংখ্য সূত্র ছড়িয়ে রাখেন, যেগুলি কখন যে কোনটির সঙ্গে মিশবে তা বোঝা মুশকিল। দর্শকের মনসংযোগে সামান্য ঘাটতি হলেই কিন্তু এই জটিল স্ক্রিন-প্লে ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে।
তবে নোলানের আগের কিছু সিনেমা ‘টেনেট’, ‘ইনটারস্টেলার’ বা ‘ইনসেপশন’-এর মতো বিজ্ঞানের কঠিন তত্ত্ব নিয়ে খেলা করে না ‘ওপেনহাইমার’। ‘টেনেট’-এর মতো সিনেমাগুলো সম্পর্কে একটা প্রচলিত সত্যি হচ্ছে যে এগুলো একবার কেন, একাধিকবার দেখেও পুরোপুরি বোঝা যায় না। 'ওপেনহাইমার'-এ সেই বিপদ নেই। বরং ‘দ্য ডার্ক নাইট’ বা ‘দ্য ডার্ক নাইট রাইজেজ’-এর মতো এখানে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের রাজনীতির জায়গাগুলো নোলান আরেক বার বাজিয়ে দেখে নেন। পরমাণু বিজ্ঞানের সাধারণ জ্ঞান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে 'ওপেনহাইমার' বুঝতে অবশ্যই সুবিধা হবে। তবে মানুষের সম্পর্কগুলোর জটিলতা এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের হিংস্রতাকে বুঝতে পারার মতো ভাবনার গভীরতা থাকা সবচেয়ে বেশি দরকার এই ছবির জন্য। নাহলে এ ছবির বক্তব্য সকলের জন্য নয়।
ওপেনহাইমার যদি নিজেকে ‘ডেথ’ বলে দাবি করেন, তাহলে রাষ্ট্র সেই মৃত্যুর ব্যবসায়ী। সিনেমার প্রতিটি দৃশ্য, শব্দ, সংলাপ, চরিত্র রাষ্ট্রের সন্দেহজনক ছবিকে বাস্তব করে তোলে। কখনও ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র, কখনও ব্যক্তি বনাম পরমাণু বোমার রাজনীতি। আর আমি, আপনি কেউই এর বাইরে নই। তার মধ্যে দাঁড়িয়েও আমরা ভালোবাসি, প্রেম করি, সংসার পাতি, বেইমানি করি; আবার নিজেদের সম্পর্কের রাজনীতির গুটি সাজাই। ১৯৪০-১৯৫০ সালের ‘ওপেনহাইমার’-এর গল্পকে ২০২৩-এ এসে সত্যি ঘটনা বলে মনে হয়। বিশেষ করে আজকের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI)-এর জমানায় দাঁড়িয়ে। কিছুদিন আগেই একটি ইন্টারভিউ-তে ক্রিস্টোফার নোলান এআই-এর বিপদ সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্র যেদিন থেকে ‘AI’-কে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করবে, সেদিন বিশ্বের রাজনীতির চেহারা আবার বদলে যাবে। ঠিক যেমন গিয়েছিল ‘ওপেনহাইমার’-এর সময়ে।
সেই জন্যই কি রবার্ট. জি. ওপেনহাইমারকে নোলান আজ ফিরিয়ে নিয়ে আসেন? তিনি কি সত্যিই মৃত্যুর দূত নাকি লক্ষ মৃত্যুর জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে চাওয়া এক বৈজ্ঞানিক? নোলান তাঁকে দেখান দোষ-গুণ, পাপ-পুণ্য মেশানো একজন মানুষ হিসেবে। একসময়ের জেদি, একগুঁয়ে বিজ্ঞানী; আজ যার জুতোর মধ্যে জাপানের নিরীহ মানুষের কঙ্কাল আটকে থাকে। বিশ্বযুদ্ধের পর যিনি আমেরিকার হাইড্রোজেন বোমা পরিকল্পনার বিরোধিতা শুরু করেন। কিলিয়ান মার্ফি ওপেনহাইমারের চরিত্রের প্রতিটা ক্ষুদ্র বৈশিষ্ট্যকে জীবন্ত করে তোলেন। ব্যর্থ প্রেমিকের হতাশা, বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতায় উদ্বেগহীন, হাতে রক্তের দাগ নিয়ে রাষ্ট্রের চক্রান্তের বিরুদ্ধে ক্রমশ ভেঙে পড়া ওপেনহাইমারকে আবার লড়াইয়ের জন্য তৈরি করে দেন কিলিয়ান মার্ফি। তাঁর প্রতি কি আমাদের সহানুভূতি জাগে? না বোধহয়। পরমাণু বোমার যে 'চেন রিঅ্যাকশান'তিনি নিজে শুরু করেছিলেন, তার গোলকধাঁধায় হারিয়ে মানুষটাকে দেখে কিছুটা ভয় জন্মায়, আতঙ্ক লাগে।
রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের লিউইস স্ট্রস রাষ্ট্রের সেই বিশ্বস্ত সৈনিক। যে নিজের জীবন বাজি রেখেও রাষ্ট্রের গোপন শয়তানিগুলোর জন্য লড়ে যান। রবার্ট ডাউনি জুনিয়রের প্রতিভাকে বহুদিন পর ‘আয়রন ম্যান’-এর মতো চরিত্রের ম্যানারিজম থেকে বেরিয়ে এসে নতুনভাবে দেখতে ভালো লাগে। সাম্প্রতিক সময়ে এটি তার শ্রেষ্ঠ অভিনয়। এই সিনেমায় আইনস্টাইন থেকে শুরু করে হ্যারি ট্রুম্যান, অসংখ্য বাস্তব চরিত্রদের ভিড়। সেই চরিত্রগুলিতে বিখ্যাত অভিনেতাদের উপস্থিতির ফলে সবার অভিনয় প্রতিভা প্রকাশের সমান জায়গা পায়নি। বিশেষ করে সিনেমার দুই প্রধান মহিলা জিন ট্যাটলকের চরিত্রে ফ্লোরেন্স পিউ এবং কিটি ওপেনহাইমারের চরিত্রে ইমিলি ব্লান্টের আরেকটু গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল। সেই তুলনায় ম্যাট ডিমনের লেসলি গ্রোভসের একরোখা, দাপুটে অভিনয় সিনেমায় ছাপ রেখে যায়। চমকে দেয় হ্যারি ট্রুম্যানের চরিত্রে গ্যারি ওল্ডম্যানের সংক্ষিপ্ত অভিনয়।
আরও পড়ুন:স্পাই নাকি প্রেমিক? পারমাণবিক বোমার সূত্র ‘পাচারের অভিযোগে’ মরতে হয়েছিল যাঁদের
সব মিলিয়ে ক্রিস্টোফার নোলানের 'ওপেনহাইমার' ছবিটি শুধুমাত্র একটি বিশেষ সময়ের দলিল হয়ে আর থেকে যায়না। বরং কোথাও গিয়ে তা ছাপিয়ে যায় সময়ের বেড়াজালকে। অস্ত্র বদলায়, সেনার মুখ বদলায়, শাসকের মুখও বদলায় কিন্তু যুদ্ধের চরিত্র আদতে বদলায় না। একটা সময় যা ছিল পরমাণু বোমা, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে তা হয়তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কিংবা আরও ভয়ঙ্কর কোনও বিধ্বংসী হাতিয়ার। আমরা হয়তো বুঝে না বুঝে প্রতিদিন কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি তার সঙ্গে। তার জন্ম দিচ্ছে অন্য কেউ, অন্য কোনও ওপেনহাইমার। যিনি সিনেমা জুড়ে শোনাচ্ছেন আরও কোনও কঠিন ভবিষ্য়তের পদধ্বনি। আদতে তো ইতিহাসেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্য়তের বীজ। তাই নিজের ইতিহাস, শিকড় বা অতীতকে চেনা খুব জরুরি। আর নোলান তাঁর দর্শককে কার্যত সেই অতীতের ভূমিতে চারণ করিয়েছেন ছবি জুড়ে, যা আসলে ভুলে যাওয়ার জন্যই আমাদের মনে রাখাটা ভীষণ জরুরি।