প্রশান্ত কিশোরের প্রত্যাখ্যানই কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেক?
রাতারাতি মিরাকল না ঘটলেও, মরা গাঙে জোয়ার আসবে বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন অনেকেই। কিন্তু যাবতীয় প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর (Prashant Kishor)। কংগ্রেস (Congress) সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর (Sonia Gandhi) প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দিলেন, কংগ্রেসে যোগ দেবেন না তিনি। কোনওরকম রাখঢাকে যাননি প্রশান্ত। সাফ জানিয়েছেন, শুধুমাত্র তাঁকে দিয়ে হবে না। পুনর্জীবন পেতে হলে সবল নেতৃত্ব প্রয়োজন কংগ্রেসের, যে বা যাঁরা শিকড়ে প্রোথিত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে দলের আগাপাশতলা নতুনভাবে সাজানোর সাহস দেখাবেন।
এর আগেও একাধিকবার কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা পাকা হতে হতেও মাঝপথে আলোচনা ভেস্তে গেছে প্রশান্তর। সেই নিয়ে প্রকাশ্যে গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি-র ধ্যানধারণা সম্পর্কে কটাক্ষও করতে শোনা গেছে প্রশান্তকে। কিন্তু এবারের ঘটনাক্রম ছিল সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা। সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে শোচনীয় ফল করেছে কংগ্রেস। রাজস্থান আর ছত্তিশগড় ছাড়া কোনও রাজ্যে একা-র বলে সরকারে টিকে নেই তারা। এমনকী, তৃণমূল এবং আম আদমি পার্টি, তেলঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি-র মতো তথাকথিত ছোট দলও তাদের সমানে সমানে টেক্কা দিচ্ছে।
তাই গোটা সপ্তাহভর ১০ নম্বর জনপথে প্রশান্ত-র আনাগোনা, দেশের প্রাচীনতম দলকে যুগোপযোগী করে তুলতে লোকসভার মোট আসনসংখ্যার চেয়েও বেশি সংখ্যক স্লাইডে ঠাসা তাঁর ডিজিটাল প্রেজেন্টেশন, দিল্লির বাতাসে ভেসে বেড়ানো এসব উড়ো খবর কিছুটা হলেও আশা জোগাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, অযথা গোঁয়ার্তুমিতে না গিয়ে প্রশান্তর সঙ্গে এবার অন্তত সমঝোতাটা যেনতেন প্রকারে সেরে ফেলবে কংগ্রেস। সাম্প্রতিক রেকর্ড খারাপ হলেও, জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রসের হাত ধরে অভিষেক হলে, প্রশান্তরও মান বজায় থাকবে বলে আড়ালে-আবডালে বলতে শুরু করেছিলেন অনেকেই।
আরও পড়ুন: প্রশান্ত কিশোর: ‘ছেড়ে রেখেই ধরে রাখা’-র সিদ্ধান্ত তৃণমূলের?
কিন্তু প্রশান্ত সোনিয়ার প্রস্তাব ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গেই কংগ্রেসের কফিনে শেষ পেরেকটা পোঁতা হয়ে গেল বলে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, প্রশান্তর হাতে যাও বা কিছুটা হলেও সম্ভাবনা ছিল, তিনি সরে দাঁড়ানোয় কোনও ওষুধেই আর চাঙ্গা করা সম্ভব নয় কংগ্রেসকে। প্রশান্ত কংগ্রেসে যোগদান না করায় যে যে সম্ভাবনাগুলি মাঠে মারা গেল, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, কেন্দ্রে বিজেপি-র বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, যারা কিনা প্রতি পদে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি পদক্ষেপকে আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের বিষয করে তুলবে। চোখে চোখ রেখে শাসককে জানান দেবে নিজেদের উপস্থিতির।
সরাসরি লড়াইয়ে বিজেপি-র কাছে বরাবরই পিছিয়ে পড়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস দেশের স্বাধীনতার কারিগর হলেও, নিজেদের সেই ঐতিহ্যকে পুঁজি করে ব্যবসায়িক ফায়দা তুলতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অথচ রাম মন্দির, অনুচ্ছেদ ৩৭০ প্রত্যাহার, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মতো বিতর্কিত ইস্যুকে নিজেদের কৃতিত্ব বলে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। তাই প্রশান্ত এলে হয়ত হাতে-কলমে মার্কেটিংয়ের শিক্ষা পেতে পারত কংগ্রেস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর জোশি-র মতো প্রবীণ খেলোয়াড়দের গ্যালারিতে পাঠিয়ে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ যেভাবে ব্যাটিং করে চলেছেন, আবার টুয়েলফথ ম্যান হিসেবে রেখে দিযেছেন তেজস্বী সূর্য, সম্বিত পাত্র-দেরও (তাঁদের রাজনৈতিক বোধ, ভাষাশৈলি, ধর্মীয় অবস্থান নিযে অবশ্যই প্রশ্ন থাকতে পারে)। অথচ আজ পযন্ত অশোক গেহলটের বিকল্প হিসেবে সচিন পাইলটকে কাজেই লাগাতে পারল না কংগ্রেস। নামসর্বস্ব নেতাদের সরিয়ে কাজকে অগ্রাধিকার দিতে এখনও পরম্পরা, অনুশাসনের গতে বাঁধা পড়ে রয়েছে তারা।
পুনরুজ্জীবিত করা মানেই পুরনো সবকিছু ঝেড়ে ফেলা নয়। বরং স্বাদ-গন্ধ এক রেখে মালমশলায় পরিবর্তন আনা দরকার। প্রথম থেকে তারই প্রেসক্রিপশন দিয়ে আসছিলেন প্রশান্ত। গান্ধী পরিবারকে পুরোপুরি না হটিয়ে, তাদের থার্ড আম্পায়ার নিযুক্ত করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন প্রশান্ত। মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে খেলা পরিচালনার দায়িত্ব পদবিতে নেহরু-গান্ধীর ছোঁয়া না থাকা কারও হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি, যিনি কিনা সর্বক্ষণের নেতা হতে পারবেন, পারিবারিক ঐতিহ্যের বেড়াজাল টপকে যিনি মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন। এর আগে, কংগ্রেসের বিদ্রোহী জি-২১ শিবিরেরও একই দাবি ছিল। তা-ও আর বাস্তবায়িত হল না।
জাতীয় রাজনীতিতে আক্ষরিক অর্থেই এখন নামসর্বস্ব প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে বিজেপি। সেই নিয়ে কংগ্রেসের ওপর খাপ্পা অন্য বিরোধী দলগুলিও। গত কয়েক বছরে কংগ্রেসের সঙ্গে একাধিকবার প্রকাশ্যেই বিরোধ বেধেছে তাদের। তাতে মধ্যস্থতা করতেই পারতেন প্রশান্ত, বিশেষ করে আম আদমি পার্টি, তৃণমূল, তেলঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি-র সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর যেখানে দহরম-মহরম রয়েছে। এর জন্য ছকও তৈরি করে রেখেছিলেন প্রশান্ত। লোকসভার ৩৫৮ আসনে কংগ্রেসকে একলা চলো নীতিতে এগোতে বললেও, ১৬৮ আসনে আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে জোটের পরামর্শই দিয়েছিলেন। প্রশান্ত না থাকায় আঞ্চলিক দলগুলি আগামী দিনে কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতায় যাবে কিনা, তা এখন দেখার।
কংগ্রেসকে বিঁধতে গিয়ে বরাবর পরিবারতন্ত্রকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি। বিজেপি-র বহু নেতার ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-পরিজন বর্তমানে রাজনীতিতে। তাঁরাই আবার কংগ্রেস এবং পরিবারতন্ত্রকে সমার্থক শব্দে পরিণত করেছেন। তাই ঘরের মধ্যে থেকেই বদলের সূচনার পক্ষে ছিলেন প্রশান্ত। এক ব্যক্তি, এক পদ, পরিবার-পিছু একটি করে টিকিট, আজীবন পদ আগলে বসে থাকার বদলে প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। সক্রিয় সদস্য হিসেবে সাত বছর একটানা কাজ করলে তবেই নির্বাচনী টিকিট মিলবে বলে নয়া নীতি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। অপরাধ মামলায় নাম থাকলে টিকিট না দেওয়ার পক্ষে সুপারিশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেসব কিছুই এখন বিশ বাঁও জলে।
অসম্ভব কোনও লক্ষ্য বেঁধে না দিয়ে, ছোট ছোট পা ফেলে কংগ্রেসকে চাঙ্গা করার পরিকল্পনা ফেঁদেছিলেন প্রশান্ত। কংগ্রেস নেতৃত্বকে ভোটবাক্সে ৪৫ শতাংশ সমর্থন হাসিল করার লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি। মহিলা, কৃষক, যুবসমাজ, তফসিলি জাতি ও উপজাতি, ভূমিহীন শ্রমিক, শহুরে দরিদ্র, মধ্যবিত্তদের সঙ্গে জনসংযোগ গড়ে তোলার গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন। বাংলার মতো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের জন্য ক্রেডিট কার্ড, কৃষকদের ভরতুকি, মহিলাদের হাতখরচ, বেকার ভাতার মতো জনমোহিনী প্রকল্পের মাধ্যমে কংগ্রেসকে ২০২৪-এর উপযোগী মেকওভার দিতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত। কিন্তু সূত্রের খবর, নিজের মতো করে সবকিছু সামলাতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত, যেমনটি বাংলা, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশে করে দেখিয়েছেন তিনি এবং সাফল্যও পেয়েছেন।
কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব দখলদারির অভ্যাস ছাড়বেন না, তিনিও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না জেনেই শেষমেশ প্রশান্ত সরে কংগ্রেসের সদস্যপদ গ্রহণ থেকে গা বাঁচিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে খবর। তবে প্রশান্ত কংগ্রেসে যোগ না দিলেও, তাঁর তৈরি করা নীল নকশা কংগ্রেসের হাতে রয়েছে। তাতে কংগ্রেস সুবিধে করতে পারে কি না, তা ভবিষ্যতেই বোঝা যাবে। তবে ভোট ব্যবসায় হাত পাকানো, সর্বোপরি মোদিকে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করার কারিগর প্রশান্তকে পাশে পেলে হয়তো অনেকটাই সুবিধেজনক জায়গায় থাকত কংগ্রেস। সেই সম্ভাবনা আপাতত মাঠে মারা গেল। তবে ২০২৪-এর আগে এখনও গুজরাত, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, হিমাচল প্রদেশ, কর্নাটকের বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে। তার ফলাফলেই কংগ্রেসের ভবিষ্যতের ছবি পরিষ্কার হয়ে যাবে।