লড়াইটা কি সত্যিই ইজরায়েল বনাম হামাস-এর?
Israel-Palestine War: ফিলিস্তিন মানেই একমাত্র হামাস? ‘দ্য জয়েন্ট রুম’ তাহলে কী? ‘আবু আলি মুস্তাফা ব্রিগেডস’ বা ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ব্রিগেডস’-এর মতো সামরিক শাখাগুলিই বা কাদের?
ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ মানেই কি ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ? ফিলিস্তিন মানেই একমাত্র হামাস? ‘দ্য জয়েন্ট রুম’ তাহলে কী? ‘আবু আলি মুস্তাফা ব্রিগেডস’ বা ‘ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ব্রিগেডস’-এর মতো সামরিক শাখাগুলিই বা কাদের? ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধকে ‘ইসলামিক জিহাদ’ বলে দাগিয়ে দিতে পারলে আদতে কাদের লাভ?
শুরুর কথা
গত বছরের অক্টোবর মাসের সাত তারিখের বৈদ্যুতিন মাধ্যম আর আট তারিখের খবরের কাগজের শীর্ষসংবাদ সেই অভিঘাত বয়ে এনেছিল। আমরা জেনে গিয়েছিলাম, ইজরায়েলের সীমানার মধ্যে ঢুকে ফিলিস্তিনি হামাস এক মারাত্মক হামলা হেনেছে, ১১৩৯-জনকে মেরে ফেলেছে তারা, আর পণবন্দি করে তুলে নিয়ে গেছে ২৫১-জনকে। ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা এই অফেন্সিভের নাম ‘তুফাঁ অ্যল-আক্সা’(অ্যল-আক্সা স্টর্ম) নামে চিহ্নিত করলেও সারা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম এই আক্রমণকে হামাস অ্যাটাক বলে চিহ্নিত করে। এই হামলার প্রত্যাঘাত হিসাবে ইজরায়েল কয়েক দিনের মধ্যেই গাজায় আকাশপথে বিধ্বংসী বোমাবর্ষণ শুরু করে, এবং ২৭ অক্টোবর ইজরায়েল ডিফেন্স ফোর্স গাজায় ঢুকে পড়ে। সেদিন থেকে আজ অবধি ইজরায়েল যে গণহত্যা এবং ফিলিস্তিন যে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যে কোনও খবরের কাগজ খুলুন— তাকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ বলে। শব্দ-জোড়টিকে লক্ষ করুন! যদি ভেবে থাকেন যে এটা নেহাতই কথার কথা, এর পিছনে কোনও উদ্দেশ্য নেই, তাহলে ভুল ভাবছেন।
সত্যি কথা
ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ মানেই ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ নয়। কারণ ফিলিস্তিন মানেই একমাত্র হামাস নয়। ২০১৮-য় অ্যল আক্সা মসজিদকে কেন্দ্র করে ইজরায়েলের সঙ্গে নতুন করে সংঘাতের পর থেকে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে যে শীর্ষ নেতৃত্বকারী কমিটি, সেটির নাম তাদের কাজের মতোই বড়সড়— অ্যল-ঘুর্ফত অ্যল-মুশ্তারাকাত লিফাসায়িল অ্যল-মুকাওয়ামাত অ্যল-ফিলাস্তিনিয়া (ইংরিজিতে দ্য জয়েন্ট রুম ফর প্যালেস্টিনিয়ান রেসিস্ট্যান্স ফ্যাকশন্স)। এই জয়েন্ট রুম আদতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের উপর ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে বিশ্বাসী ৯টি ফ্যাকশনের যুক্তফ্রন্ট— যাদের মধ্যে ইসলামিক, সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী, মার্কসবাদী/গেভারাবাদী, মাওবাদী-সহ বিভিন্ন মতাদর্শের শক্তিগুলি রয়েছে। এই ৯টির মধ্যে প্রথম পাঁচটি ফ্যাকশনের পরিচয় এক নজরে দেখে নিলেই এই ভিন্ন ধারাগুলি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা অবশ্যই পাওয়া যাবে, এবং পাওয়াটা জরুরি।
১) যে যুক্তফ্রন্টটির কথা বললাম, তার প্রধান আর সর্ববৃহৎ যোদ্ধা দলটি অবশ্যই ইজ্জ়এদিন অ্যল-কাসাম ব্রিগেডস, এটিই হামাস-এর মিলিটারি উইং (‘হামাস’-এর পুরো নাম হরকত অ্যল-মুকাওয়ামাহ্ অ্যল-ইসলামিয়া, বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন’; ইজ্জ়এদিন অ্যল-কাসাম, একজন সিরিয়ান নেতা, তিনের দশকে ব্রিটিশ এবং ফ্রেঞ্চ ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইনে প্রতিরোধ সংগ্রামের শহীদ)। ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ্ এবং পিএলও (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অরগানাইজ়েশন)-র মেনে নেওয়া আত্মসমর্পণকারী অসলো চুক্তির বিরুদ্ধে হামাস একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এবং ফাতাহ্-র সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও জড়িয়েছিল। ২০০৭ থেকে গাজা স্ট্রিপে বিপুল ভোটে ফাতাহ্কে পরাজিত করে সরকার চালিয়ে আসছে হামাস, যে গাজা লড়াকু ফিলিস্তিনের প্রতীক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। হামাস সুন্নি ইসলামপন্থী দল, আরব জাতীয়তাবাদকে তারা ইসলামের আলোকে বিচার করে। বিধ্বংসী আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়েও তাদের লাগাতার প্রতিরোধ বজায় রাখার ক্ষমতা যুদ্ধবিশারদদের স্তম্ভিত করেছে। সম্প্রতি ইজরায়েল অকুপেশন ফোর্সের সম্মুখ-আক্রমণে হামাসের শীর্ষনেতা ইয়াহিয়া অ্যল-সিনওয়ার-এর বীরোচিত শাহাদাতের ভিডিওটি পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন তুলেছে।
২) ফ্রন্টের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্যাকশনটির নাম অ্যল-কুদ্স ব্রিগেডস, এটি প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ (পিআইজে) দলের সামরিক শাখা। এটিও সুন্নি ইসলামপন্থী দল, মূলগতভাবে ইজিপ্টের মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং ইরানের ইসলামিক বিপ্লবে প্রভাবিত।
৩) কমিউনিস্ট নেতা শহীদ আলি মুস্তাফা-র নামাঙ্কিত আবু আলি মুস্তাফা ব্রিগেডস হচ্ছে পপ্যুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অভ প্যালেস্টাইন (পিএফএলপি)-এর সামরিক শাখা। এই দলটির ঘোষিত নীতি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ, চে গেভারার প্রভাব দলটিতে গভীরভাবে রয়েছে); এঁরা একটি ধর্মনিরপেক্ষ জনগণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে, যেখানে মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর মানুষেরা একসঙ্গে থাকবেন প্রত্যেকের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্ম-আচরণের স্বাধীনতা নিয়ে। পিএলও কোয়ালিশনে ফাতাহ্-র পরেই পিএফএলপি দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি। একদা হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষের ইতিহাসও আছে দলটির; বিশেষ করে হামাস যখন নারীদের উপর শরিয়তি বিধান চাপিয়ে দিচ্ছিল, তখন পিএফএলপি-র স্লোগান ছিল: ‘নারীদের যারা নিশানা করে তারা কোলাবরেটর’ এবং ‘বন্দুকের একটা গুলি শত্রুর জন্য, বাকি পাঁচটা কোলাবরেটরদের জন্য’। নজর করার মতো বিষয় হল, এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা জর্জ হাবাশ নিজে ছিলেন অ-মুসলিম বংশোদ্ভূত। উল্লেখ্য, পৃথিবীতে প্রথম নারী বিমান-হাইজ্যাকার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের ‘পোস্টার গার্ল’ লাইলা খালিদ এই দলটিরই পলিটব্যুরো সদস্যা। পিএফএলপি-র এখনকার সাধারণ সম্পাদক আহ্মদ সা’আদাত ২০০২ থেকে ইজরায়েলি কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
৪) ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্স ব্রিগেডস (কাতা’ইব অ্যল-মুকাওয়ামাহ্ অ্যল-ওয়তানিয়াহ্), যার অন্য নাম মার্টিয়র ওমর অ্যল-কাসেম ফোর্সেস, হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অভ প্যালেস্টাইন-এর সামরিক শাখা। এই দলটি রাজনৈতিক মতানৈক্যের কারণে পিএফএলপি ভেঙ্গে তৈরি হওয়া—এদের ঘোষিত মতাদর্শ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ। জন্মসূত্রে জর্ডানিয় খ্রিস্টান নায়েফ হাওয়াতমাহ্ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এখনও সাধারণ সম্পাদক। ডিএফএলপি-ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণতান্ত্রিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে; পিএলও-তে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি।
৫) অ্যল-আক্সা মারটিয়রস ব্রিগেডস (কাতায়েব শুহাদা অ্যল-আক্সা) হচ্ছে মতাদর্শগতভাবে ফাতাহ্-র দিকে ঝুঁকে থাকা প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দল, যদিও ফাতাহ্ তাদের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্ককেই অস্বীকার করে। বলা যায়, আত্মসমর্পণকারী ফাতাহ্-র মধ্যে রয়ে যাওয়া বা বেরিয়ে আসা যে অংশটি সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের পক্ষে, এটি তাঁরাই পরিচালনা করেন। প্রগতিশীল (কিছুটা বামপন্থী), ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী এই দলটি আকারে ও যোদ্ধা-সংখ্যায় কিছুটা সঙ্কুচিত হলেও ২০২৩ থেকে ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে।
জেনে রাখা দরকার, ৭ অক্টোবরের অ্যল-আক্সা স্টর্ম-এ উল্লিখিত দলগুলিকে নিয়ে মোট সাতটি ফ্যাকশন সরাসরি অংশ নিয়েছিল।
কথার কথা?
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে হামাস সবচেয়ে বড় অংশ বটে, কিন্তু একমাত্র শক্তি অবশ্যই নয়। ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর আক্রমণেও হামাস-এর সঙ্গে উল্লিখিত দলগুলি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। সার্বিকভাবেই ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যুদ্ধটা হামাসের একার যুদ্ধ নয়। এখন, এটা আমরা বুঝছি আর পশ্চিমি মিডিয়া তা সম্পর্কে অন্ধকারে— এ তো হতে পারে না! তাহলে বারবার করে ‘ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ’ এই শব্দবন্ধটা আমাদের মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে কেন? একটা বড় রাজনৈতিক আন্দোলনকে প্রধান শক্তিকে দিয়ে চিহ্নিত করার একটা চল আছে বটে, সে তো আমজনতার অভ্যেস! কারণ সাধারণ মানুষের ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ থাকার দায় থাকে না, মিডিয়ার তা থাকে। যেমন ধরুন, আমরা পশ্চিম বাংলায় ২০১১-র আগের সময়কে বোঝাতে হরহামেশা বলে থাকি ‘সিপিএমের আমলে…’; কিন্তু কোথায় বলি? ট্রেনে-বাসে, চায়ের দোকানে বা ঘরোয়া আড্ডায়। কিন্তু একজন সাংবাদিক এটা কখনওই লিখবেন না; তাঁকে লিখতে হবে, ‘বামফ্রন্টের আমলে…’। ঠিক একইভাবে সংবাদমাধ্যম ‘ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ’ লিখতে পারে না—যুদ্ধটা যখন হামাস একা লড়ছে না!
গত বছর ২৭ অক্টোবরের ঠিক আগে সিএনএন-এ একটা প্রতিবেদন বেরিয়েছিল; এতে স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছিল, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রবেশ করলে ইজরায়েলকে হামাস ছাড়া আর কোন কোন প্রতিরোধ বাহিনীর মুখোমুখি পড়তে হবে। সুতরাং ‘ইজরায়েল-হামাস যুদ্ধ’ বলাটা (এবং তার সঙ্গে শুধু ‘প্যালেস্টিনিয়ান ইসলামিক জিহাদ’ দলটির নাম মাঝে মধ্যে উল্লেখ করাটা) মোটেই অজ্ঞতাপ্রসূত নয়! এটার উদ্দেশ্য হল— হামাস একটি ইসলামপন্থী দল, তার সহযোগী দল পিআইজে-ও তাই, সুতরাং ইজরায়েল একটি (বা একাধিক) ইসলামিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের মোকাবিলা করছে— এটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে এই অন্যায় যুদ্ধ অনেকটা ন্যায্যতা পেয়ে যায় (কে না জানে ‘ইসলামিক টেররিজ়ম’ পশ্চিমের মিডিয়ার সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য)। লড়াইটাও তাহলে একটা জাতির সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ থাকে না, চমৎকার একটা ‘ইসলামিক জিহাদে’ দাঁড়িয়ে যায়। অতএব কমিউনিস্ট বা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী শক্তিগুলিও এ-লড়াইয়ে প্রথম থেকে রয়েছে, সে-কথা উচ্চারণ নৈব নৈব চ!
শেষের কথা
ফিদায়িঁ নেতাদের হাঁড়ির খবর পর্যন্ত যাদের নখদর্পণে, সেই আন্তর্জাতিক মিডিয়ার হামাসের নামে হঠাৎ কণ্বমুনির আশ্রমের হরিণশিশুটির মতো আলাভোলা হয়ে পড়াটা এখন আর ততটা অবাক করে না। কারণ ইজরায়েল শুধুই একটা রাষ্ট্র নয়, ইজরায়েল আসলে পুঁজিবাদী পশ্চিমের একটা প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রাম অনুযায়ী মিডিয়ার পরিসরও একটা রণাঙ্গন। আর গাজ়া স্ট্রিপের ভূখণ্ডে হোক বা গণমাধ্যমের স্ক্রিনে, এতদিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে আসা ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধ পশ্চিমের সেই প্রোগ্রামের সামনে মারাত্মক একটা চ্যালেঞ্জ।