শীর্ষ আদালতের বিচারাধীন বলেই লাইভ সম্প্রচারে বাধা? কী বলছেন আইনজ্ঞরা?

Live Telecast Of Meeting: মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য অন্যতম শর্ত ছিল সরাসরি সম্প্রচার। আর তাতেই আপত্তি জানায় নবান্ন।

আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে গোটা শহর উত্তাল। প্রায় এক মাস ধরে কর্মবিরতির পথে জুনিয়র ডাক্তারেরা। চার দিন ধরে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধর্নায় তাঁরা। ছ'দফা দাবি তোলা হয়েছে তাঁদের তরফে। এ নিয়ে তিন বার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার কথা হলেও শেষপর্যন্ত বৈঠক ভেস্তে গিয়েছে তিন বারই। বৃহস্পতিবার নবান্ন পর্যন্ত এসে ফিরে যান জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের জন্য অন্যতম শর্ত ছিল সরাসরি সম্প্রচার। আর তাতেই আপত্তি জানায় নবান্ন। বৈঠক বানচাল হওয়ার পর সাংবাদিক বৈঠক করে মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, সুপ্রিম কোর্টে মামলাটি বিচারাধীন, তাই সেই সংক্রান্ত বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার সম্ভব নয়।

কতটা সত্যি বললেন মুখ্যমন্ত্রী? সত্যিই কি সুপ্রিম কোর্টে বিচার্য মামলার সরাসরি সম্প্রচার আইনবিরুদ্ধ? নাকি স্বাস্থ্যদুর্নীতি সংক্রান্ত ডাক্তার-মুখ্যমন্ত্রী রুদ্ধদ্বার বৈঠকের খুঁটিনাটি দুনিয়ার সামনে আনতে চাইল না প্রশাসন?

এ বিষয়ে প্রখ্যাত আইনজীবী তথা রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানালেন, এ মুখ্যমন্ত্রীর অজ্ঞতার পরিচয়। সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে একাধিক মামলার লাইভ স্ট্রিমিং হচ্ছে, ফলে সুপ্রিম কোর্ট কখনও কোনও মামলার লাইভ স্ট্রিমিং করতে আপত্তি করেনি বা এ সংক্রান্ত কোনও বিধিনিষেধও নেই। বিকাশবাবু বলেন, "রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অর্ধসত্য এবং অসত্যভাষণে পারদর্শিনী। প্রকৃতপক্ষে সেটারই পুনরুল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এদিন। আইনত সরাসরি সম্প্রচারে কোথাও বাধা নেই।"

আরও পড়ুন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক হলো না! কোন পথে এগোবেন জুনিয়র ডাক্তাররা?


মুখ্যমন্ত্রী  বৃহস্পতিবার নবান্ন থেকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। আর সাংবাদিক বৈঠকও যে সরাসরি সম্প্রচারের নামান্তর মাত্র, তা মানতে কোথাও বাধা নেই। বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যমই মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক সরাসরি সম্প্রচার করে থাকে তাঁদের চ্যানেলে। যদি সেটা তাঁর করতে বাধা না থাকে, তাহলে চিকিৎসকদের সঙ্গে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার করতে আপত্তিটা কোথায়? মুখ্যমন্ত্রী বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘ভিডিয়ো রেকর্ড করা হবে, জানানো হয়েছিল। তিনটি ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। চাইলে ভিডিয়োর রেকর্ড তাঁদের হাতে তুলে দিতাম। সুপ্রিম কোর্ট যে সরাসরি সম্প্রচার করতে পারে, আমরা পারি না। মামলা বিচারাধীন। সিবিআই দেখছে। চাইলে আমরা তাদের ভিডিয়ো রেকর্ড দিতাম। কোর্টকেও দিতে পারতাম।’’

কেন ভিডিও রেকর্ডিংয়ে আপত্তি নেই, সরাসরি সম্প্রচারেই আপত্তি মুখ্যমন্ত্রীর? প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবী ঋজু ঘোষাল। তিনি মনে করছেন,  এর কারণ সম্ভবত একটাই, রেকর্ড হওয়া ভিডিওর ক্ষেত্রে তা এডিট করা সম্ভব। কিন্তু লাইভ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। তা-ই কি ভয় পেল প্রশাসন? ঋজু আরও জানান, সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার পূর্বে নিজে লাইভ স্ট্রিমিং করেছে। সিবিআই এই মামলার ক্ষেত্রে আলাদা ভাবে তদন্ত করছে। অভয়ার ধর্ষণ ও খুনের তদন্তের পাশাপাশি দুর্নীতি মামলার তদন্ত হচ্ছে একদিকে, যেটার ভার রয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। অন্যদিকে আর্থিক দুর্নীতির তদন্ত করছে ইডি। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের যে ছ'দফা দাবি, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান দাবি স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিকর্তার অপসারণ, তারা আদৌ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা, তা এখনও প্রমাণিত নয়। ফলে সেক্ষেত্রে লাইভ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে আইনত বাধার জায়গা আসে কোথা থেকে। সরাসরি সম্প্রচারের দাবির নেপথ্যে মূল কারণ ছিল স্বচ্ছতা। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের কী কথা হচ্ছে, তা যেন বাইরের পৃথিবী জানতে পারে। তবে কি সরকার যে স্বচ্ছতা বজায় রাখছে, সে বিষয়ে নিজেরাই তারা সন্দিহান। কোভিড পরবর্তী কালে লাইভস্ট্রিমিং পুরোপুরি বৈধ, যাতে মানুষ আসল সত্য জানতে পারে। বিচারাধীন মামলা সংক্রান্ত বৈঠকের লাইভ সম্প্রচার করা যাবে না, এমন আইনের উল্লেখ সুপ্রিম কোর্টে আছে বলে মনে হয় না, জানান ঋজু। সেক্ষেত্রে তাঁর প্রশ্ন, "মুখ্যমন্ত্রীর যদি তেমন কোনও আইনের কথা জানা থাকে, তাহলে ধারা, আর্টিকেল উল্লেখ করে জানালেন না কেন তিনি? তৃণমূলে তো বাঘা বাঘা আইনজীবীরা রয়েছেন, তাঁরাই বা কেন নীরব?

আরও পড়ুন: স্নায়ুযুদ্ধে ডাক্তারদের কাছে জিতে গেলেন মমতা?

তবে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের কথাবার্তায় লুকোচুরির জায়গা কোথায়? জুনিয়র ডাক্তারেরা যে আন্দোলন করে চলেছেন, প্রথমে লালবাজার ও স্বাস্থ্যভবনে, সেটা গোটাটাই মানুষের সামনে হয়েছে। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী যা যা বলেছেন, তা-ও সকলের সামনেই হয়েছে। তবে কি প্রশাসন ভয় পেয়েছিল, বৈঠকে এমন কোনও কথাবার্তা হতে পারে, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে, যা নবান্নের পক্ষে অস্বস্তিকর হতে পারে। তা-ই কি আদালত অবমাননার কথা বলে সেই পরিস্থিতি এড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী? উঠে গিয়েছে বড়সড় প্রশ্ন।

More Articles