ভারতে পর্নোগ্রাফি দেখা, শেয়ার করা কি অপরাধ? কী বলছে দেশের আইন?
Pornography Law in India: ভারত সরকার পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটগুলিও ব্লক করেছে। কেউ যখন এই ব্লকড ওয়েবসাইটে ঢুকতে চেষ্টা করেন, তখন ইন্টারনেট সংযোগ কাজ করে না
প্রতিটি ধর্ষণের পরেই পর্নোগ্রাফি নিষিদ্ধ করার ডাক ওঠে। বলা বাহুল্য, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেট যত সহজলভ্য হয়েছে, পর্নোগ্রাফিও ততই সুলভ হয়েছে। কিন্তু পর্নোগ্রাফি দেখার সঙ্গে বিকৃত যৌনতা বা ধর্ষণের কি সম্পর্ক আছে? ভারতে, পর্নোগ্রাফি এবং সেক্স টয় বিষয়গুলি জটিল আইন দ্বারা পরিচালিত। মূলত অশ্লীলতা এবং জনসাধারণের নৈতিকতার সুরক্ষা বিষয়টিকেই এই আইনে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পর্নোগ্রাফি নিয়ে কী বলছে দেশের আইন?
ভারতে কেউ ব্যক্তিগতভাবে পর্ন দেখতেই পারেন। তা বেআইনি নয়। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালে রায় দেয় যে, প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যক্তিগতভাবে পর্ন দেখার অধিকার রয়েছে। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকারের মধ্যেই পড়ে সেটি। তবে ভারতে পর্ন দেখার কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। জনসমক্ষে বা দলবদ্ধভাবে পর্ন দেখা এখানে নিষিদ্ধ। শিশুদের পর্নোগ্রাফি দেখা, বানানো বা শেয়ার করা বেআইনি। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম সহ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পর্নোগ্রাফিক সিনেমার লিঙ্ক শেয়ার করা বেআইনি। ভারত সরকার পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটগুলিও ব্লক করেছে। কেউ যখন এই ব্লকড ওয়েবসাইটে ঢুকতে চেষ্টা করেন, তখন ইন্টারনেট সংযোগ কাজ করে না।
ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) ২০২৩, তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) আইন ২০০০, এবং যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা (POCSO) আইন ২০১২ সহ বিভিন্ন আইন এই প্রসঙ্গে মুখ্য ভূমিকা পালন করে৷ ভারতীয় আইনে অশ্লীল সামগ্রীর উৎপাদন, বিতরণ এবং ব্যবহার রোধ করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বিধান রয়েছে। পর্নোগ্রাফি বিষয়ে ভারতীয় আইন কঠোর। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা-র ধারা ২৯৪ এবং ২৯৫ মূলত অশ্লীল বিষয় প্রকাশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই ধারাতে অশ্লীলতাকে এমন যেকোনও বস্তু হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা ব্যক্তিদের উপর 'খারাপ' প্রভাব ফেলে।
এই ধরনের অশ্লীল বস্তুর বিক্রি, ভাড়া, বিতরণ বা প্রকাশ্যে প্রদর্শন কারাদণ্ড এবং জরিমানাযোগ্য অপরাধ। বিশেষত, ধারা ২৯৫-এ নাবালকদের পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল উপকরণ থেকে সুরক্ষিত করার বিষয়ে বলা আছে। এই ধারা অনুযায়ী, শিশুদের কাছে অশ্লীল সামগ্রী বিক্রি গুরুতর অপরাধ।
আরও পড়ুন- যৌনাঙ্গে ক্ষত, শরীরের ২৪ জায়গায় চোট! নারকীয় অত্যাচারের প্রমাণ ময়নাতদন্তের রিপোর্টে
তথ্য প্রযুক্তি আইন ২০০০
আইটি আইনে ডিজিটাল বিশ্বে পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল পণ্যের বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ধারা ৬৭, ৬৭এ, এবং ৬৭বি-তে অনলাইনে অশ্লীল এবং যৌনতাপূর্ণ বিষয়ের প্রচার বিষয়ে কথা বলা হয়েছে৷ ধারা ৬৭-তে অশ্লীল পণ্যের প্রকাশ বা প্রচার নিষিদ্ধ। ধারা ৬৭এ অনুযায়ী যৌন উত্তেজক বস্তুর ইলেকট্রনিক প্রচার অপরাধ। এতে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং মোটা অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। ধারা ৬৭বি তে শিশুদের পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা হয়েছে। শিশুদের ব্যবহার করে পর্নোগ্রাফির ভিডিও তৈরি ও প্রচার কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
পকসো আইন, ২০১২
যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা বা Protection of Children from Sexual Offences (POCSO) আইন, ২০১২-র ১৪ নম্বর ধারাতে পর্নোগ্রাফি থেকে শিশুদের সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে৷ এই ধারা অনুযায়ী, পর্নোগ্রাফির উদ্দেশ্যে শিশুদের ব্যবহার করলে অভিযুক্তের পাঁচ থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড সহ কঠোর শাস্তি হবে।
আইআরডব্লিউএ আইন, ১৯৮৬
Indecent Representation of Women (Prohibition) আইন ১৯৮৬ অনুযায়ী, অশ্লীল পণ্যের উত্পাদন, প্রকাশ এবং বিতরণ সহ যে কোনও মাধ্যমে মহিলাদের অশালীনভাবে দেখানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মহিলাদের মর্যাদা বজায় রাখা এবং সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে মহিলাদের পণ্য করে তোলার প্রচেষ্টাকে রোখাই এই আইনের লক্ষ্য।
আরও পড়ুন- যৌনতার খেলনা নয়, উন্মাদনার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো ‘রেক্টাল ডাইলেটর’?
সেক্স টয় নিয়ে কী বলছে ভারতের আইন?
যৌন খেলনা বিষয়ে ভারতে সুস্পষ্ট কোনও আইন কিন্তু নেই। কোনও নির্দিষ্ট আইনই সরাসরি সেক্স টয়ের বিক্রি বা বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করে না। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ধারা ২৯৪-তেই অশ্লীলতার ভিত্তিতে সেক্স টয় বিক্রি, প্রদর্শনী, বিজ্ঞাপন এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের কথা বলা আছে। শুল্ক আইনও এক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করে। শুল্ক আইন অনুযায়ী, সরকারকে অশ্লীল বা জনসাধারণের নৈতিকতার বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে, এর মধ্যেই সেক্স টয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
২০১১ সালে, কলকাতা হাইকোর্ট আমদানি করা সেক্স টয় বাজেয়াপ্ত করার জন্য কাস্টমস কর্তৃপক্ষের একটি সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেয়। হাইকোর্ট যুক্তি দেয়, এগুলি প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তৈরি এবং এতে কোনও অশ্লীলতা নেই। এবছরের মার্চ মাসে, বম্বে হাইকোর্ট শুল্ক কর্মকর্তাদের এমনই একটি সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেয়। শুল্ক কর্তৃপক্ষ বডি ম্যাসাজার বাজেয়াপ্ত করেছিল। আদালত বলে, বডি ম্যাসাজার কোনওরকম সেক্স টয় নয়।
সেক্স টয় বিক্রি নিয়ে সামাজিক ট্যাবু কাটেনি এখনও। ফলে সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক বাধার মুখে বারবার পড়েছে এই যৌন খেলনাগুলি। তবে অনলাইন কেনাকাটার বাড়বাড়ন্তের যুগে যেক্স টয় এখন সহজলভ্য। যদিও অনলাইন বিক্রেতাদেরও স্থানীয় আইন এবং শুল্কনীতি মেনেই এই জাতীয় পণ্যগুলির বিজ্ঞাপন করতে হয় এবং বিক্রি করতে হয়৷
অশ্লীল বস্তুর বিক্রি, বিতরণ, প্রদর্শনীর অভিযোগে প্রথমবার দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। দ্বিতীয়বার বা পরবর্তীকালে আবারও দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। ২০ বছরের কম বয়সি কাউকে অশ্লীল বস্তু বিক্রি করা, ভাড়া দেওয়া বা প্রদর্শনী করলে প্রথমবার দোষী সাব্যস্ত হলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ২,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা, দ্বিতীয়বার বা পরবর্তীকালে দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।
অশ্লীল গান, অশ্লীল কথাবার্তার ক্ষেত্রেও তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা দুই-ই হতে পারে। কোনও মহিলাকে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি দেখানো হলে এক বছরের কারাদণ্ড, বা জরিমানা বা দুই-ই হতে পারে।