গাজাকে ঢাল করে লড়ছে হামাস, ইজরায়েল
Hamas-Israel War: সেই অনিশ্চয়তা বা ভয় এখনও পিছু ছাড়ে না আমাদের। কেবলই মনে হয়, কাল হয়তো ঘুম ভাঙবে ফের সাইরেনের শব্দে।
যদি কখনও আপনার সাইরেনের শব্দে আচমকা ঘুম ভাঙে, বুঝতে পারবেন না সেটা সাইরেন নাকি অ্যালার্মের শব্দই? যেমন ভাবে প্রতিটা সকাল হয় তেমন ভাবেই যেন হাত চলে যাবে অ্যালার্মের দিকে, মনে হবে বন্ধ করে আরেকটু বিছানায় গা এলিয়ে থাকি। সব্বাত সপ্তাহান্তের ভোরের সমস্ত নিস্তব্ধতা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে সেদিন যখন বেজে উঠেছিল ওই যুদ্ধের সাইরেন, তখনও ভালো করে ঘুম কাটেনি। আধো ঘুম, আধো তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অ্যালার্মের থেকেও যেন বিরক্তিকর মনে হয়েছিল ওই সাইরেনের শব্দ। বিশেষ করে জেরুজালেমে এমন মনে হওয়াটা আশ্চর্য নয়। কারণ বড় বড় সন্ত্রাস-হামলার মুখেও সেখানে যুদ্ধের অ্যালার্ম বেজে উঠতে শোনেননি কেউ। ফলে ঘড়ির অ্যালার্মের শব্দে ঘুম থেকে জেগে উঠতেই বেশি অভ্যস্ত জেরুজালেম। সেই অ্যালার্মের শব্দ শুনে কেউ শাপ-শাপান্ত করে ফের ঘুমিয়ে পড়েন, কেউ বা অ্যালার্মের শব্দের মধ্যেই ঘুমানো অভ্যেস করে নিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধের সাইরেন শুনে সেদিন ঘুম ছুটে গিয়েছিল জেরুজালেমবাসীর। ঘুমচোখেই বুঝে গিয়েছিলেন সকলে, কোথাও কিছু একটা হয়েছে। ক্রমে পরিষ্কার হয়, ইজরায়েলের উপরে রকেট হেনেছে হামাস। গোটা ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই সকলে ছুট লাগান দরজার দিকে। সিঁড়ি পেরিয়ে কোনওমতে পৌঁছতে হবে আশ্রয়ে। যত সময় যায়, ততই সাইরেনের শব্দ বাড়তে থাকে আর অশুভ চাদরের আস্তরণের মতো বাতাসকে ঢেকে ফেলতে থাকে ওই শব্দ। আমরা কান পেতে প্রতীক্ষা করছিলাম আয়রন ডোমের শব্দ শোনার। ভেবেছিলাম, শত্রুপক্ষের সমস্ত রকেটকে প্রতিহত করতে পারবেই ওই শক্তিশালী আয়রন ডোম। দশটি মতো বিস্ফোরণের শব্দও তো পেয়েছিলাম।
ততক্ষণে হামাস-বাহিনীর ইজরায়েল আক্রমণের খবর ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে শুধু সেই খবর। আমরা যে যার নিজেদের আবাসনে ফিরে এসেছি। ততক্ষণে ইজরায়েলের দক্ষিণ সীমান্ত দিয়ে ঢুকতে শুরু করেছে হামাসবাহিনী। ইজরায়ের বিভিন্ন অংশে নৃশংস ভাবে হামলা চালাচ্ছে তারা। ইজরায়েল এই হামলাকে চিহ্নিত করেছে 'অপারেশন আল আকসা ফ্লাড' নামে। এই আল আকসা জেরুজালেমের পবিত্রতম মসজিদ। মক্কা ও মদিনার পরে ইসলামদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান এই মসজিদটি। হামাসরা ততক্ষণে অন্তত একটি সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে। বহু কিবুটজ এবং দক্ষিণ ইজরায়েলের অধিকাংশ এলাকাই তাদের দখলে। নেগেভ মরুভূমিতে আয়োজিত একটি সঙ্গীতানুষ্ঠানে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালিয়েছে তারা। অপহরণ করা হয়েছ বহু মানুষকে, বহু বাসিন্দাকে পণবন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গাজায়। আর বাকিদের মেরে ফেলা হয়েছে পথের মধ্যেই। মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে গাজা উপত্যকা থেকে ইজরায়েলের দিকে ছুটে এসেছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি রকেট। হামাসদের এই ভয়ঙ্কর হামলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে ইজরায়েলের, সেটা বোঝার চেষ্টা করছি সবে আমরা। ততক্ষণে ফের বেজে উঠল যুদ্ধের সাইরেন। অর্থাৎ ফের আমাদের আশ্রয়ে গিয়ে মাথা গুঁজতে হবে। প্রায় দুপুর পর্যন্ত এই চলল দফায় দফায়। এরই মধ্যে হঠাৎ জানতে পারি, ইজরায়েল সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে গাজার বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: হামাস-ইজরায়েলের সবচেয়ে বেশি ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে কোন দেশ? উত্তর অবাক করবে…
জেরুজালেমের মতো শহর কিন্তু এই বিপর্যয়ের অভিকেন্দ্র ছিল না কখনওই। তা সত্ত্বেও আমাদের সমস্ত দিনের নেপথ্যে বাজতে থেকেছে একরোখা ওই যুদ্ধের সাইরেন। বন্ধুবান্ধব থেকে আত্মীয়স্বজন, সকলে নানা ভাবে যোগাযোগ করেছেন, জিজ্ঞেস করছেন, কেন আমরা শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নিইনি! সত্যি বলতে, যে আবাসনে আমরা থাকি তার নিচে তেমন কোনও শেল্টার বা আশ্রয় নেই। এই শহরের বেশিরভাগ আবাসনেই নেই। যেহেতু এই শহরের বুকেই ইসলামদের পবিত্র আল আকসা মসজিদটি রয়েছে, সে কারণেই সম্ভবত সেভাবে জেরুজালেমের উপর তেমন ভাবে ধ্বংসলীলা চালায়নি হামাসরা। ২০২১ সালে হামাস-ইজরায়েল সংঘর্ষের সময়ে তেল আভিভ ও সীমান্তবর্তী শহরগুলিতে প্রায় এক মাস ধরে রকেট ব্যারেজ বানিয়ে রাখা হয়েছিল। বহু শহরে যুদ্ধের সাইরেন বাজতে থাকলেও ব্যতিক্রম ছিল শুধু জেরুজালেম। সেই পরিস্থিতিতেও শেল্টারের প্রয়োজন হয়নি জেরুজালেমে। তবে ইদানীং নতুন নতুন করে গড়ে উঠেছে যে বহুতলগুলি, সেগুলিতে নিরাপদ কক্ষ রয়েছে বেশ কিছু। যেগুলো সেখানে পরিচিত 'মামাদ' নামে। যে কোনও রকম সমস্যায় জেরুজালেমের বেশিরভাগ বাসিন্দাই আশ্রয় নেন সিঁড়িতে। মোটামুটি জানলা থেকে ও কাচবিশিষ্ট আসবাব থেকে দূরে থাকা আর বাড়ির ভিতরের দেওয়ালে লেপ্টে থাকাটুকুই একমাত্র সুরক্ষাকবচ এখানে। আর সেদিনও সেটাই করেছিলাম আমরা সকলে।
একবার সাইরেন বেজে ওঠা থেকে আরেকবার সাইরেনের বেজে ওঠার মধ্যের যে সময়টা, সেটা যেন দুঃসহ মনে হত। যুদ্ধের সাইরেনের মতোই অশুভ যেন সেই নিস্তব্ধতাও। যে যতই শান্ত আর যুক্তিবাদী হোন না কেন, ওই সাইরেন বন্ধ হওয়ার সময়টুকুতে শরীরের মধ্যে যেন কী একটা স্রোত বয়ে যেত। মনে হত শরীরে আর এক ফোঁটা সার বেঁচে নেই। অন্যদিকে, মস্তিষ্কের একটা অংশ যেন আরও প্রবল সতর্ক হয়ে উঠত অজানা এক আতঙ্কে। সব মিলিয়ে ভয় আর হতাশার একটা মিলিত ঢেউ যেন আছড়ে পড়বে আপনার সারা শরীর জুড়ে। মনে হবে, আর কোনও রাস্তা খোলা নেই আর বেঁচে থাকা ছাড়া। আর আমরা সেটাই করেছিলাম। শুধু সেই দিনটাই নয়, তার পরের বেশ কয়েকটা দিনই ভয়াবহ দোলাচলে কাটিয়েছি আমরা এবং কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি বলা যেতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি স্ক্রিন জুড়ে বসা একাধিক ভিডিও, ছবি আমাদের কাছে বারবার হিংসার সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্যটাই আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। ইজরায়েলের সঙ্গে হামাসদের সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রতিটা সংবাদমাধ্যমেও সেই একই হিংসার ছবি, গোলাগুলির শব্দ আর মানুষের আতর্নাদ। যার মধ্যে সত্যিই কি সবকিছু আগের মতো চালিয়ে যাওয়া সম্ভব! প্রশ্নটা মাথায় ঘুরতেই থাকে। গাজায় ইজরায়েল যেভাবে হামলা করেছে, তা হামাসদের বর্বরতার চেয়ে কোনও অংশে কম বলে মনে হয়নি। ইজরায়েলের পাল্টা হামলা 'অপারেশন আয়রন সোর্ডস' শুরু হওয়ার পর থেকে গাজা শহর কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ছ'দিনের মধ্যে গাজায় ৬ হাজার বোমা ফেলা হয়েছে। একাধিক অঞ্চলে বন্ধ করে দেওয়া হয় পানীয় জল, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ, যা ২০ লক্ষ নিরপরাধ মানুষের জীবনকে অন্ধকার ঠেলে দিয়েছে। আর এই ভয়াবহতা কল্পনাও করা যায় না। হামাস ইজরায়েলি সরকারের উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইজরায়েলের সাধারণ নাগরিক ও সেনাদের উপর আঘাত হেনেছে। আর ইজরায়েল ও তার ডি-ফ্যাক্টো সরকারও কিন্তু সেই একই কাজ করেছে। হামাসকে শাস্তি দিতে তারা নিশানায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গাজার অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। আর গাজাবাসীরা, একদিকে তারা হামাসদের জন্য হয়ে উঠেছে মানব ঢাল, অন্যদিকে ইজরায়েলি বাহিনীর জন্য তারা 'কোলাটেরাল ড্যামেজ' মাত্র।
যুদ্ধের সপ্তম দিনে বসে আমি এত সব কথা লিখছি। আমি এমন অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি, যারা হামাস-হামলার মুখ থেকে বেঁচে ফিরেছেন। যাঁরা ফিরতে পারেননি, তাঁদের অনেকেরই খোঁজ নেই এখনও। অনেকেরই বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাঁদের বাড়িতেই বন্দি করে রেখেছিল আতঙ্কবাদীরা। তাঁদের সেখান থেকে উদ্ধার করে আনে আইডিএফ সেনা। তার পাশেই কোনও একটি বাড়ির বাসিন্দারা বেরোতে না চাওয়ায় তাঁদের পুড়িয়ে মেরেছে জঙ্গিরা। এক হামাস জঙ্গি খুনের পরে মৃতের পেজে গিয়ে খুনের ভিডিওটি আপলোড করে। সেই দেখে এক ব্যক্তি জানতে পারেন, তাঁর দিদাকে হত্যা করা হয়েছে। আসলে দু-পক্ষই ভয়াবহ নৃশসংতার নজির রেখেছে। আর সেই পরিসংখ্যান সামনে এনে পরস্পরের নৃশংসতা ঢাকার চেষ্টা করে চলেছে মাত্র।
আমার থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে গাজা শহরে আপাতত আইসক্রিম ট্রাকগুলোকে দিয়েই চালানো হচ্ছে এখন মর্গের কাজ। কারণ হাসপাতালে জায়গা নেই বললেই চলে। দক্ষিণ ইজরায়েলের শহরগুলিতে সেনা ও উদ্ধারকারী দলগুলি জানাচ্ছে, তারা এই পরিমাণ রক্ত তাঁদের গোটা চাকরিজীবনে কখনও দেখেননি। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে একের পর এক বহুতল। এই কয়েকদিনে যে কত শিশুকে আমরা হারিয়েছি, কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার প্রাণ গিয়েছে, তার হিসেব গুলিয়ে গিয়েছে। হয় মানুষ পালাচ্ছে, নয় মানুষ মরছে। গুলি-বোমার শব্দ বাদ দিয়ে আর কিছু যদি শোনা যায় এখানে এখন, তবে তা মানুষের হতাশা, কান্না আর যন্ত্রণার আর্তনাদ।
আরও পড়ুন: Hamas-Israel War: এই যুদ্ধে প্যালেস্টাইনের পক্ষে কারা?
যবে থেকে যুদ্ধ লেগেছে, বহু পরিচিত, বন্ধুবান্ধব, স্বজন জিজ্ঞেস করেছেন ঠিক আছি কিনা। উত্তরে জানিয়েছি, 'এখনও ঠিক আছি।' চেয়ে বা না-চেয়েও যেন ওই 'এখনও' শব্দটা যোগ হয়ে গিয়েছে উত্তরের সঙ্গে। আসলে সেই অনিশ্চয়তা বা ভয় এখনও পিছু ছাড়ে না আমাদের। কেবলই মনে হয়েছে, কাল হয়তো ঘুম ভাঙবে ফের সাইরেনের শব্দে। যদিও তেমনটা হয়নি আর গত কয়েকদিনে। চার বছর ধরে আছি জেরুজালেমে। আর সেই থাকার মেয়াদ শেষ হল বলে। আর মাত্র দু'দিন। এই সেই জেরুজালেম যেখানে তিনটি 'আব্রাহামিক' বিশ্বাস একসঙ্গে এসে মিলেছে। আমার জেরুজালেম ছেড়ে আসার পিছনে যুদ্ধের কোনও ভূমিকা নেই। তবে যে দেশটাকে ছেড়ে আমি যাচ্ছি, তার সঙ্গে এতদিনের চেনা দেশটার এত অমিল, এই ভাবনাটা আমাকে বড়ই কষ্ট দিচ্ছ। মনে হচ্ছে, আমি যেন ঠিক করে বিদায়টুকুও জানিয়ে আসতে পারলাম না এই দেশ, এই শহরটাকে। দু'টো যুদ্ধ, একটা অতিমারি সত্ত্বেও এই দেশটা আমাকে অনেক দিয়েছে। আমি আমার শহর বা সেই শহরের বন্ধুদের সঙ্গে শেষ দু-একটা ছবি তুলে আসতে পারলাম না, ভালো করে বিদায়টুকও জানিয়ে আসা হল না। এই দুঃখই আমার মনকে ভারী করে তুলছে। তবু আমি জীবনের দিকে ছুটছি। সেই বিমানটি আমাকে এই যুদ্ধক্রান্ত দেশ থেকে উড়িয়ে নিয়ে আসবে, ফিরিয়ে আনবে জীবনের কাছে। আর সেই ফেরার আশাটুকুই আমাকে মনোবল জোগাচ্ছে। একবার আমার এক বন্ধু বলেছিল, 'যদি তুমি ঠিক করে বিদায় বলে না আসতে পারো, তাহলে জানবে বিদায়ের মুহূর্ত নয় এটা।' সেই লাইনটাই শুধু আমার কানে ভাসছে এখন। তাহলে কি...