গাজায় যুদ্ধবিরতি! বন্দি মুক্তিতে হামাসের সঙ্গে চুক্তিতে কেন রাজি হলো ইজরায়েল?
Israel Hamas ceasefire : হামাস জানাচ্ছে ১৫০ জন ফিলিস্তিনিকেও ইজরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।
টানা ৫৪ দিনের যুদ্ধের পর ৪ দিনের বিরতি! ইজরায়েল এবং হামাস অবশেষে চার দিনের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এর আগে ইজরায়েল জানিয়েছিল, কোনওরকম যুদ্ধবিরতির পথে হাঁটবে না তারা কারণ তা হামাসের কাছে আত্মসমর্পণের নামান্তর। তবে এই যুদ্ধবিরতিতে দুই পক্ষই রাজি কারণ ফিলিস্তিনি জঙ্গিগোষ্ঠী ৭ অক্টোবর অপহরণ করা বহু ইজরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। পাল্টা রাজি হয়েছে ইজরায়েলও। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভা প্রায় সারা রাত ধরে বৈঠক শেষ এই যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে রাজি হয়েছে। বেঞ্জামিন বলছেন, কঠিন সিদ্ধান্ত তবে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন তারা। যে ইজরায়েল হামাসের সঙ্গে মৌখিক কোনও বোঝাপড়াতেই রাজি ছিল না তারা কেন হঠাৎ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো?
মন্ত্রিসভার ৩৮ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র তিনজন যুদ্ধবিরতির বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন - জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-ভির এবং উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের অন্য দুই সদস্য। ইজরায়েল জানাচ্ছে, এই চুক্তির ফলে নারী ও শিশু সহ অন্তত ৫০ জন ইজরায়েলি এবং বিদেশি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। বদলে চার দিন গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ রাখবে ইজরায়েল। প্রতি ১০ জন অতিরিক্ত বন্দি মুক্তির জন্য একটি অতিরিক্ত করে দিন যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে।
হামাস এই 'মানবিক যুদ্ধবিরতি'-কে স্বাগত জানিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। হামাস জানাচ্ছে ১৫০ জন ফিলিস্তিনিকেও ইজরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হবে। এক মাসেরও বেশি সময় আগে অপহরণের পর থেকে হামাস মাত্র চার বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে এতদিনে, একজন আমেরিকান মা এবং তার মেয়ে এবং দুই বয়স্ক ইজরায়েলি মহিলা। দেড় মাস ধরে চলা এই নারকীয় যুদ্ধে গাজার ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণ গিয়েছে। মৃতের অধিকাংশই শিশু।
আরও পড়ুন- ওষুধ নেই, কেমোথেরাপি নেই! যেভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগোচ্ছেন গাজার ক্যান্সার আক্রান্তরা
হামাস এবং আরেকটি ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ইসলামিক জিহাদ জানাচ্ছে, যুদ্ধবিরতিতে স্থলভাগে সম্পূর্ণভাবে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে এবং দক্ষিণ গাজার উপর ইজরায়েলি বিমান অভিযানও বন্ধ থাকবে। ইজরায়েলের মন্ত্রিসভা এই চুক্তি অনুমোদন করে কিনা তাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, তবে কাতার এই আলোচনায় মধ্যস্থতার কাজ করেছে।
তবে ইজরায়েলের পক্ষে এই অনুমোদন মোটেও সহজ ছিল না। নেতানিয়াহুর ডানপন্থী জোটের অনেকেই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি হননি কারণ তারা মনে করেন ইজরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ হামলার জন্য দায়ী হামাসকে এক্ষেত্রে সুযোগ দেওয়া হয়ে যাবে৷ জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক কট্টরপন্থী মন্ত্রী ইতামার বেন-ভির ইঙ্গিত দেন, যুদ্ধবিরতির চুক্তির বিরুদ্ধেই তিনি ভোট দেবেন। তাঁর দাবি, এই চুক্তিতে ইজরায়েলি সৈন্যদের মুক্তির বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
৭ অক্টোবর হামাসের অভিযানে ইজরায়েলে প্রায় ১৪০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং প্রায় ২৪০ জন অপহৃত হয়। এই হামলার জবাব দিতে ইজরায়েল হামাস শাসিত গাজায় অপারেশন সোর্ডস অফ আয়রন শুরু করে। ইজরায়েলের এই প্রতিশোধমূলক হামলায় ১৪০০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। ইজরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট বৈঠকের আগে জানান, এই চুক্তির মানে এই নয় যে হামাসকে নিকেশ করতে শুরু হওয়া যুদ্ধের অবসান ঘটবে। চার দিনের বিরতি শেষ হলেই গাজায় সামরিক অভিযান ফের পুরোদমে চলবে বলে জানান মন্ত্রী। নেতানিয়াহুর সরকারও বিবৃতিতে জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি মানে যুদ্ধের সমাপ্তি নয়। ইজরায়েলি সরকার, ইজরায়েলি সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনী অপহৃত সকলকে ফিরিয়ে আনবে। তবে, হামাসকে নির্মূল করতে এবং গাজার তরফ থেকে ইজরায়েল রাষ্ট্রের জন্য আর কোনও হুমকি যাতে না থাকে তা নিশ্চিত করতে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
তবে এই দেড় মাস পর চার দিনের বিরতি গাজার মানুষদের কাছে অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র ফিনফিনে আলো হয়ে দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার বিমান হামলায় গাজার বড় অংশই একেবারে গুঁড়িয়ে গেছে। বাঁচার জন্য ন্যূনতম খাদ্য, জল এবং জ্বালানিরও প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে ইজরায়েল। হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ সূত্রে জানা গেছে, এই প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির চুক্তির ফলে গাজায় ৩০০ টি ট্রাক ঢুকবে খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে।
আরও পড়ুন- সন্তানের মৃতদেহও আসবে যে কোনওদিন! রোজ ২০০ লাশকে কাফন পরাচ্ছেন গাজার এই বৃদ্ধ
ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী জানাচ্ছে হামাসের প্রায় ২৫০ লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালানো হয়। জাবালিয়া এলাকায় তিনটি ভূগর্ভস্থ শ্যাফ্ট ধ্বংস করা হয়েছে। জাবালিয়ার ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতালে এই হামলায় বহু মানুষের প্রাণ গেছে। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরের আল-আওদা হাসপাতালে ইজরায়েলি হামলায় দুইজন চিকিৎসকসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। ইজরায়েল জানিয়েছে, হামাস নিজের জঙ্গিদের লুকিয়ে রাখতে এবং অপারেশনের ঘাঁটি হিসাবে এই হাসপাতালগুলিকেই ব্যবহার করছে। তাই হাসপাতালে হামলা চালানো হচ্ছে হামাসকে নির্মূল করতে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা, অর্থাৎ ব্রিকস গোষ্ঠী মঙ্গলবার গাজায় অবিলম্বে দীর্ঘস্থায়ী মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। এই বৈঠকের সভাপতি দক্ষিণ আফ্রিকা, ইজরায়েলয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগও এনেছে। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এই সম্মেলনের সময় সাধারণ নাগরিক বন্দিদের মুক্তি এবং ইজরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দাবি জানান।